- অভয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর এখনও পর্যন্ত প্রধান অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়। কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ রচনার দায় তার একার নয়। সে একাই হত্যাকারী না আড়ালের কোনও সঙ্গী ছিল তার–তা এখনও স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু সে যে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পেয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ডিউটি না থাকা একজন সিভিক পুলিশ কীভাবে কোনও বাধা ছাড়াই মধ্যরাতে হাসপাতালের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে পারে? কেউ তাকে আটকায় না? কেউ তার কার্যকলাপ খেয়াল করে না? এমনকি সিসিটিভিও তার গতিবিধির পর্যাপ্ত প্রমাণ ধরে রাখে না? কী ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাহলে চিকিৎসকের এবং রোগীদেরও থাকতে হয় হাসপাতালে? রোগীর বিক্ষুব্ধ পরিবারই কেবল নয়, সরকারের নিজের লোকও এসে তাহলে নির্মম হত্যা ও ধর্ষণ চালাতে পারে? এসবের পিছনে আপনাদেরই দায়ী করছি স্বাস্থ্যসচিব, মন্ত্রী ও পারিষদবর্গ। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালগুলিকে এইরকম নিরাপত্তাহীন করে তোলার দায় আপনাদেরই।
- হত্যাকাণ্ডের পরেও একাধিক ক্ষেত্রে তদন্ত বিপথে চালিত করার চেষ্টা করেছেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও স্থানীয় পুলিশ। প্রমাণ যথাযথ ভাবে সংরক্ষণের চেষ্টা করেননি আপনারা, মানুষকে ভুল তথ্য দিয়েছেন, হত্যাকান্ডের পাঁচ দিন পরে ১৪ আগস্ট মাঝরাতের ভাঙচুর ঠেকাতে পারেননি। আবার প্রমাণ হয়েছে রোগী ও ডাক্তার উভয়েরই জীবন হাসপাতালের মধ্যে ঠিক কতটা বিপন্ন। পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের সচিব ও মন্ত্রী, এর জন্য আপনাদেরই দায়ী করছে জনতা।
- দীর্ঘকাল ধরে সমগ্র স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অজস্র দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে–উপাচার্যের গোচরে আনা হয়েছে পরীক্ষা ও নিয়োগ সংক্রান্ত নানা দুর্নীতির তথ্য ও প্রমাণ। জাল ওষুধ এবং বায়ো মেডিক্যাল ওয়েস্ট নিয়ে চরম অসৎ ব্যবসাচক্রের ফলে সাধারণ দরিদ্র রোগীর জীবন বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। সমাজের আর পাঁচটা দুর্নীতির তুলনায় এর তাৎপর্য অনেক বেশি–কেননা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা এর সঙ্গে জড়িত সরাসরি। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের এই চরম দুর্নীতির পাঁক রক্ষণাবেক্ষণ করেন আপনারাই–মহামান্য স্বাস্থ্য দফতর, আপনাদের বশংবদ শাসক-ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির মধ্যস্থতায়। সন্দীপ ঘোষ, সুহৃতা পাল ও তাঁদের সহযোগীরা অসংখ্য দুর্নীতির পাণ্ডা, কিন্তু এই সমস্ত দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য আপনাদেরও এই জনতা সরাসরি অভিযুক্ত করছে।
- দেশের অন্যত্র নারী এবং প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের উপর যে অত্যাচার চলে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এ রাজ্যেও যে বেড়েই চলেছে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা–প্রায়ই সেসব ক্ষেত্রে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করেছে সরকার ও পুলিশ। যথেষ্ট কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা দেখিয়েছে। কর্মক্ষেত্রের ভিতরেও যে নারী নিরাপদ নয় তা সরাসরি প্রমাণ হল এবার। যার রক্ষক হওয়ার কথা, সে-ই হত্যাকারী হয়ে উঠছে, এমনকি হত্যার আগে সচেতন ভাবে যৌন হেনস্থা করতে ভুলছে না। এই গা-গোলানো মনোভাবকে যথাযথ ভাবে প্রতিহত করার বদলে প্রায়ই প্রশ্রয় দেওয়া হয়। থ্রেট কালচার ও রেপ কালচার–একে অপরের সঙ্গী হয়ে রাজ্যের নানা প্রতিষ্ঠানে এবং পাড়ায় ফেঁপে উঠছে। কখনও প্রশয় দিয়ে, কখনও উদাসীন থেকে আপনারাই আজ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন মহামান্য শাসক। জনতার এই দুর্দশার দায় আপনাদেরই।
- যথাযথ তদন্ত ও ন্যায় বিচারের জন্য মানুষ যাঁদের উপর ভরসা করেছিল, তাঁরাও হতাশ করছেন। তদন্ত প্রক্রিয়া এবং পেশ করা চার্জশিট নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এত দায়সারা, এত আলগা, এত অপেশাদার ভঙ্গিতে সিবিআই আধিকারিক ও আইনজীবীরা গোটা প্রক্রিয়ায় উপস্থিত আছেন যে, অভয়ার পরিবার এবং জনতা শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পাবে কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে। মহামান্য আদালতের নজরদারিতে এই তদন্ত হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত এইটুকুই আশার কথা। কিন্তু অন্য যে-কোনও অপরাধের সঙ্গে এই নারকীয় ঘটনার তফাত আছে। সমস্ত সমাজ দিন কাটাচ্ছে উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কে–প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা বজায় রেখেও তদন্তের গতিপ্রকৃতি কেন মানুষের সামনে তুলে ধরা যাবে না? একের পর এক অপরাধী অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় সমাজে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াছে–নাগরিকের কাছে এটি চরম উদ্বেগ ও অশান্তির বিষয়। ক্ষমতাশালীর পক্ষ অবলম্বন করার অভিযোগ আছে আপনাদের বিরুদ্ধেও। নিশ্চিত অপরাধীও অতীতে অনেক সময় আপনাদের তদন্তের মধ্যে দিয়ে ক্লিন চিট পেয়েছে। জনতার এই সঙ্গত অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করতে এখনও কোনও কার্যকর পদক্ষেপ আপনারা নেননি। আরও স্বচ্ছতা, আরও পেশাদারিত্ব, আরও সংবেদনশীলতা আপনাদের কাছে প্রত্যাশিত। তা নইলে অচিরেই আপনারা অপরাধের পরোক্ষ সঙ্গী হিসেবে অভিযুক্ত হবেন।
- সিবিআই এবং বিচার-ব্যবস্থা শেষ অব্দি হত্যাকারী এবং তার সহযোগীদের যথাযথ শাস্তি দেবে–এই প্রত্যাশা এবং দাবির অর্থ এই নয়, সরকারি যে-ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির যে আবহ এই হত্যা ও ধর্ষণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল তার দায় ও দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাও বন্ধ করে দিতে হবে, তাকে আর অভিযোগের আওতায় আনা যাবে না। অপরাধী চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া খুব জরুরি, কিন্তু অপরাধীদের মৃগয়াক্ষেত্র রচনাকারীদের চিহ্নিতকরণ ও অভিযুক্ত করাও একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়। সারা রাজ্যের স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং হাসপাতালগুলিতে বহু জায়গায় সরকারি জমি, বাড়ি, যন্ত্রপাতি, ওষুধ এবং বায়ো মেডিক্যাল বর্জ্য পদার্থ নিয়ে যে চরম দুর্নীতি চলছে, অর্থের তছরুপ চলছে, পরীক্ষা-দুর্নীতি চলছে—এবং তার ফলে সাধারণ মানুষের জীবন প্রতিদিন যেভাবে বিপন্ন হচ্ছে তা বে-আব্রু হয়ে পড়েছে আজ। এর দায়ও নিতেই হবে স্বাস্থ্য সচিব, সমগ্র দফতর এবং মন্ত্রীকে। এখনও পর্যন্ত এই তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে বিচলিত ও কিছুটা হতাশ হলেও সাংবিধানিক অধিকার ও বিচারব্যবস্থায় আমরা আস্থাশীল এবং সকলেই আশা করি, আদালতে এই নৃশংস অপরাধের যথাযথ বিচার একদিন হয়তো হবে–অভয়াদের অত্যাচারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে—সব ষড়যন্ত্র, দুর্নীতির সব কৌশল একদিন হয়তো আইনের সক্রিয়তায় পরাভূত হবে, কিন্তু আজ জনতা সরাসরি আপনাদেরকে চিহ্নিত করে জানাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাজি রেখে শাসক-ঘনিষ্ঠ মুষ্টিমেয় লোভী ও তঞ্চকের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছেন বলে আপনারাও চরম অপরাধের অংশীদার।
থ্রেট সিন্ডিকেটের পাঁচালি (৭)
আরও কয়েকদিন পরে থ্রেট সিন্ডিকেটের পাঁচালি লেখার ইচ্ছা ছিলো। সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনা এমনভাবে ঘটে গেলো যে, আরেকটি কিস্তি আজকে লিখতেই হচ্ছে। থ্রেট সিন্ডিকেটের একজন কেষ্টবিষ্টু