শারীরিক গঠন ও শারীরবৃত্তের বিচারে একটি শিশু একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা। আবার নবজাতক অন্যান্য শিশুদের তুলনায় ভিন্নরকম। এজন্যই মাতৃগর্ভের নিরাপদ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে বাইরের পৃথিবীর সাথে নবজাতকের প্রাথমিক মোলাকাতের সময়টায় শিশু-চিকিৎসায় অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্য প্রয়োজন হয়। একটা ছোট্ট তথ্য দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে- পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি হয় নবজাতক মৃত্যু!
পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রধান শ্বাসঅঙ্গ ফুসফুস কিন্তু নবজাতকের ক্ষেত্রে এই শ্বাস আদান-প্রদানের কাজটি করে গর্ভফুল বা প্লাসেন্টা। জন্মের আগে নবজাতকের ফুসফুস তরল পদার্থে ভর্তি থাকে এবং সেখানে খুব সামান্য পরিমাণ রক্ত সঞ্চালন হয়। জন্মের পর প্রথম শ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে ফুসফুসে বাইরের হাওয়া ঢোকে এবং রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। কোনও কারণে ফুসফুসে হাওয়া ঢোকার এই স্বাভাবিক পদ্ধতি ব্যাহত হ’লে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ফুসফুসে হাওয়া ও রক্ত সঞ্চালন করানোর প্রয়োজন হয়। এটি ভীষণভাবে আপৎকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হ’লে অনেক শিশুকেই বাঁচিয়ে তোলা যায়।
অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন, শিশুর রোগের ইতিহাস জানার সময় চিকিৎসক ‘বাচ্চা জন্মের সময় সঙ্গে সঙ্গে কেঁদেছে কিনা’ সেটা জিজ্ঞেস করেন। এটি জানার উদ্দেশ্য হ’ল- সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ওঠা মানে ফুসফুসে হাওয়া প্রবেশ। লেবার রুমে বাচ্চা না কাঁদলে স্বাস্থ্যকর্মীদের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা শুরু করতে হয়। ফুসফুসে হাওয়া না ঢুকলে অক্সিজেনের অভাবজনিত কারণে মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড, কিডনিসহ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে চিরস্থায়ী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ফোলানো ব্যাগ টিপে ফুসফুসে বাইরে থেকে হাওয়া ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়। বুকের মাঝের হাড়ের ওপর চাপ দিয়ে বন্ধ বা দুর্বল হৃৎপিণ্ডকে সচল রাখা হয়। প্রয়োজনে গলায় নল পরানো হয়। শিরায় হৃৎস্পন্দন বাড়ানোর ওষুধ দেওয়া হয়। যত সহজে কথাগুলো লিখে ফেললাম আসলে কাজটা তার থেকে বহুগুণ কঠিন। পুরো কাজটা সঠিকভাবে করতে অন্তত তিনজন স্বাস্থ্যকর্মীকে গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয়। দুঃখের বিষয় তার পরেও অনেক শিশুকেই বাঁচানো যায় না।
একটা সত্যি গল্প বলে লেখা শেষ করবো। আমার এক সিনিয়রের মুখে শোনা। এরকমই এক শিশুকে হাজারো চেষ্টার পরেও বাঁচানো যায় নি। বাচ্চার শারীরিক অবস্থার কথা আগে থেকেই বারবার জানানো হয়েছিল। তারপরেও খান কুড়ি-পঁচিশ লোক এসে হাসপাতাল ভাঙচুর করে যায়। যুক্তি ছিল- ডাক্তার আর নার্স মিলে বাচ্চার বুকে চাপ দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলেছে! প্রাণপণ চেষ্টা করা ডাক্তারের কপালেও খানকতক চড়-থাপ্পড় জোটে।
সবাই জানেন, এদেশে রোগীমৃত্যু মানেই চিকিৎসায় গাফিলতি!