যতদিন যাচ্ছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী নতুন রূপে ধরা দিচ্ছে। একটা আদর্শ পৃথিবী সম্বন্ধে যে ধারণাগুলো খুব সচেতনভাবেই লালনপালন করে এসেছি এতকাল, সেগুলো খুব দ্রুত পাল্টে ফেলতে হচ্ছে। আমি জেনেছি রাষ্ট্র তার জনগণের অভিভাবক এবং জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা তার কর্তব্য। শিক্ষা-স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক-ভাবে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যই হয়তো এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসা।
শিক্ষাক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে লিখে লিখে হদ্দ হয়ে অবশেষে এই আমিই ১০ জানুয়ারি নীট-সুপারস্পেশালিটি পরীক্ষা দিয়ে ফিরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে একটা কোচিং কোর্সে নাম লেখাই। অনুভব করলাম, কোভিডের কারণেই হোক, বা অন্য কোনো কারণে- পড়াশোনায় একটা বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। একটা বস্তাপচা আদর্শকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য আর দশটা মানুষের থেকে পিছিয়ে পড়ার কোনো অর্থ হয় না। আজ থেকে এক দশক পর মেডিক্যাল শিক্ষা হয়তো পুরোটাই বেসরকারি হয়ে যাবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা। এম.ই.এস.-এ অস্তিত্ব বজায় রাখার একমাত্র ক্রাইটেরিয়া হবে শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা। কলেজগুলো হবে ডিগ্রি লাভের মাধ্যম মাত্র, শিক্ষালাভের জন্য থাকবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। স্বাভাবিকভাবেই তাতে ক্লিনিক্সের কোনো ছোঁয়া থাকবে না। অবশ্য আমরা ভবিষ্যতে যে চিকিৎসাব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছি তাতে ক্লিনিক্সের বিশেষ স্থানও থাকবে না, সে কথায় পরে আসছি।
মেডিক্যাল শিক্ষার বেসরকারিকরণের প্রথম ধাপ হলো ঢালাও রিজার্ভেশন। এতে ভোটের পথটাও প্রশস্ত হয়, অন্যদিকে গুটিকয়েক সিটের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতাও বাড়ে- কর্পোরেটের অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়; আবার সামাজিক বৈষম্য ও ঈর্ষাও বৃদ্ধি পায়। সরকার এই উপায়টা বেশ ভালোই রপ্ত করতে পেরেছে। এবারে নীট-পিজি পরীক্ষায় তার ছাপ স্পষ্ট।
ভবিষ্যতে আরো বিবিধ সংরক্ষণের জন্য আমাদের মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, কারণ আমরা নিজেরাই নিজেদের এই সরকার উপহার দিয়েছি। মেডিক্যাল শিক্ষা দূর অস্ত, আজকাল তো স্কুলশিক্ষাতেই পিপিপি মডেল আসতে চলেছে শুনলাম। মদমাতাল বাপ যেমন তার বাচ্চার শিক্ষায় টাকা যোগাতে পারে না, সরকারের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা তাই। অবশ্য যে দেশে শিক্ষিত মানুষকে চপ ভাজতে আর চা বানাতে অনুপ্রাণিত করা হয়, সে দেশে স্কুলে গিয়ে লাভটাই বা কি!
স্বাস্থ্যক্ষেত্রও দিনদিন গোলমেলে হয়ে পড়ছে। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এদেশে স্বপ্নই থেকে যাবে, এটা বুঝতে বিশাল বৈজ্ঞানিক হওয়ার দরকার নেই। সরকার সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব কতটুকু নেবে, সেটা স্বাস্থ্যখাতে খরচের বহর দেখলেই ঠাহর করা যায়। অন্তত প্রাইভেট চেম্বারে কিছু টাকা দিয়ে মানুষ সঠিক চিকিৎসাটুকু পায়। কিন্তু সেই চেম্বার প্র্যাকটিস যে কি কঠিন জিনিস সেটা স্বয়ং বনফুল সেই জমানায় বলে গেছেন, আজও সেটা কী অদ্ভুতরকম সত্যি!
সবচেয়ে বড় কথা মানুষ বোঝে কতটুকু! ডাক্তারিতে তো দু’য়ে দু’য়ে চার হয় না- অথচ এই যোগফলের সূত্র দিয়ে একশ্রেণীর মানুষ ঠিক করে খাচ্ছে। গুচ্ছের কোয়াক, এই প্যাথি- সেই প্যাথি, বলতে নেই পাশ করা ডাক্তারও চিকিৎসা চালাচ্ছে অদ্ভুত অদ্ভুত। উইডাল পজিটিভ ভাইরাল জ্বরে এন্টিবায়োটিক, সাবক্লিনিক্যাল হাইপোথাইরয়েডে গঙ্গাজলের মতো থাইরয়েডের বড়ি, আকাশ থেকে পড়া এ.এস.ও. টাইটার বেশি আসার জন্য পশ্চাৎদেশে পেনিসিলিন ফুটছে আকছার। এভিডেন্স বেসড মডার্ন মেডিসিনের এরকম শ্রাদ্ধ অন্য কোনো দেশে হয়েছে কিনা সন্দেহ, এই এলোপাথাড়ি চিকিৎসার নাম ‘এলোপ্যাথি’ হওয়াই ভালো। তাই এই নামে আর প্রতিবাদও করি না।
অবশ্য কার জন্য গলা ফাটানো! মানুষ যেমন চায়, তেমনটাই পায়। হয় কোয়াক দেখাবো, নয় পিজি, নয়তো ভেলোর। এরাজ্যের মানুষ আর কিছু বোঝে না। ভেলোরে আলাদা ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে বাঙালিদের জন্য, এরাজ্যের ডাক্তার তা দেবে কী করে! দালালের খপ্পরে ভেলোর ফেরত কত রুগীই না দেখলাম, সেই গল্প না হয় অন্য কোনোদিন হবে। কিন্তু এই মানুষগুলোকেই সামান্য রোগে সঠিক মতামত দিলে এদের পছন্দ হয় না, ভেলোরে গিয়ে শুনলে তখন অমৃতবাণী মনে হয়।
যেমন দেশের লোক, তেমনি তাদের রাজা। তার এখন চরকের চিকিৎসা পছন্দ। চরকের চিকিৎসা জনপ্রিয় করার জন্য দরকার হলে মডার্ন মেডিসিনের অন্তিম সংস্কার অব্দি করে ফেলতে পারেন। নাড়ি টিপে গোমূত্র খাইয়ে দেশের লোককে শান্ত রাখতে পারলে নিজেদের চিকিৎসা না হয় মেদান্তায় সেরে নেবেন। অবশ্য আয়ুর্বেদও কিছু ছোটখাটো ব্যবসা নয়, সেটা গুরুদেব নিজে করে দেখিয়েছেন।
মডার্ন মেডিসিন কি রাষ্ট্রের পছন্দ নয়! সেটা একদমই না, তুমি পাঁচ টাকায় রুগী দেখো, পিঠে ঝোলা করে ওষুধ বিতরণ করো, পদ্মশ্রী দেবে। চিকিৎসা দেওয়া দিয়ে কথা, গরিব লোকজন ডাক্তার দেখানোর আনন্দটা পেলেই হলো, সেই চিকিৎসার কোয়ালিটি রাষ্ট্রের দেখার দরকার নেই। কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগের মডার্ন মেডিসিনে পাঁচ টাকার চিকিৎসা নেই, সেটা বোঝার বুদ্ধি সবারই রয়েছে। গ্রামের প্রান্তিক মানুষটার স্বাস্থ্যের দায়িত্ব তুমি নিতে পারোনি, তাই সেই চিকিৎসাটাকে তুমি গ্লোরিফাই করছো। তোমার মন্ত্রীর পান থেকে চুন খসলে এইমসে ছোটে, আর গ্রামের লোকটা কোন দোষে এভাবে চিকিৎসা করাবে?
গ্রামের প্রান্তিক মানুষের কথা ছেড়েই দিলাম। রাতের ট্রেনে হসপিটালে এসে লাইনে দাঁড়িয়েও এদেশের মানুষ অপ্টিমাম চিকিৎসা পায় না। ডায়বেটিসের আন্তর্জাতিক সমস্ত গাইডলাইনে যেসকল ওষুধের কথা বলা আছে, তার বেশির ভাগই হাসপাতালে অমিল। কেন অন্তত স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটির জেনেরিক ওষুধটুকু মানুষ পাবে না? যেসব ওষুধের পেটেন্ট রয়েছে, সেগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম। হার্ট ফেইলিওরে যে ওষুধগুলো ‘স্ট্যান্ডার্ড অফ কেয়ার’ বলা হচ্ছে, এদেশে তার জেনেরিক ওষুধ পেতে মানুষ এখন বসে থাকবে। অথচ এসব রোগ কিন্তু এমন কিছু বিরল রোগ নয়, একটা বিশাল পপুলেশন এসব রোগের শিকার। স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকে আমাদের দেশে ক’টা মানুষ স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা পায়?
এসব নিয়ে প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন করতেও ভুলে গেছি, করে লাভও নেই। সমাজে চিকিৎসকদের ক্রেডিবিলিটি কতটুকু রয়ে গেছে এটা একটা বড় প্রশ্ন। আজকাল কারো শরীর খারাপ হলে মানুষ আগে ডাক্তার খোঁজ করে না, আগে মন্ত্রী খোঁজ করে, কোন সোর্সে হাসপাতাল গেলে বেড পাওয়া যাবে সেটা চিন্তা করে। এতো অনেক বড় কথা, নিত্যদিনের অসুখে রথী-মহারথী ডাক্তাদের প্রেসক্রিপশনও কেউ কেউ আমার মতো নব্যকে দিয়ে ক্রস-চেক করাতে চায়। এই অসুখটাকে কী নাম দেব? এর কী চিকিৎসা করবো? জানিনা, আর এক দশক পর ডাক্তারি পেশাটার কী ভবিষ্যৎ জানিনা। ঈশ্বরই বলতে পারবেন আমাদের জন্য কী সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।