নবজাতকের এই রোগকে অনেকেই ‘মাসি-পিসি’ বলে থাকেন। কে যে কেন এই নাম দিয়েছিল, তা গবেষণার বিষয়। এটিকে আবার ঠিক রোগ বলাও ঠিক নয়। প্রায় ৫০ শতাংশ স্বাভাবিক শিশুর ক্ষেত্রে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে যেহেতু অনেক মা বাবাই এর জন্যে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হন, এবং ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হন, তাই একে আমরা রোগই বলব।
কাদের হয়?
একেবারে সদ্যজাত শিশুদের এই রোগ হয়। সুস্থ, স্বাভাবিক শিশুদের ক্ষেত্রে ৪৮ থেকে ৭২ শতাংশ শিশুর এই রোগ হয়। আবার গবেষণায় দেখে গেছে, তুলনামুলক ভাবে ছেলেদের বেশি হয়। এও দেখা গেছে, যে সব শিশুর ওজন ২৫০০ গ্রামের কম, বা যে সব শিশু নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মেছে, যাদের ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘প্রি-ম্যাচিওর’ শিশু তাদের এই রোগ কম হয়।
কি হয়?
শিশুর চামড়ায় সাদা বা হলদেটে-সাদা এক ধরণের ছোট ছোট গুটি (Papule) বা ফুস্কুড়ি দেখা দেয়। সংখ্যায় কয়েকটি অথবা অনেক হতে পারে। কখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, আবার কখনও এক সাথে পাশাপাশি থাকে। সাধারণতঃ প্রথমে দেখা দেয় গালে, তারপরে কপালে এবং মুখের অন্যত্র। এর পর বুকে বা শরীরের মধ্যবর্তী অংশে- অর্থাৎ পেটে বা পিঠে, এমনকি হাতের উপরের অংশে বা পাছায় ও থাইয়ের কাছেও দেখা যেতে পারে। এই গুটির চারিদিকের চামড়া লালচে হয়ে যায়। যখন অনেক বেশি গুটি হয়, তখন তার চারিদিকের চামড়া লাল হওয়ার ফলে দেখে মনে হয় ঘা হয়েছে।
তবে এই গুটি বা প্যাপিউল একই স্থানে হবে এমন কোনও কথা নেই। সময়ের সাথে সাথে এর অবস্থানও পাল্টাতে পারে। দেখা গেল হয়েছিল মুখে, পরে সেখানে সেরে গিয়ে কপালে বা ঘাড়ের কাছে হ’ল। গুটির বা প্যাপিউলের সংখ্যার ও হের ফের হতে পারে।
কখনও কখনও এমনও হতে পারে, প্রায় সারা গা ফুস্কুড়িতে ভরে যায় এবং লালচে হয়ে যায়। দেখতেও বেশ ভয়ঙ্কর লাগে, মনে হয় মারাত্মক কোনও চর্মরোগ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন না থাকলে এই সব ফুস্কুড়ি পেকে গিয়ে চর্মরোগ হতে পারে। তবে হাতের তালু, পায়ের তালুতে হয় না।
কখনও কখনও এর সাথে হাল্কা জ্বর থাকতেও পারে।
কেন হয়?
এই রোগের বর্ণনা পাওয়া যায় ১০০০ বছর আগের থেকে। নির্দিষ্ট কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। নানা জনে নানা কথা বলেছেন।
কেউ বলেছেন, মায়ের দুষিত খারাপ রক্ত এর কারণ, আবার কেউ বলেছেন অপরিস্কার থাকার কারনে এই রোগ হয়, আবার কারও মতে এটি একটি এলার্জিক ঘটনা, আবার কেউ বলেছে পেটের গলমালের কারণে এই রোগ হয়। তবে সে সব পুরানো কথা। বর্তমানে উন্নত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, এই রোগের কারণ ভিন্ন। এই ফুসকুড়ি বা প্যাপিউল দেখা যায় লোমকুপের গোড়ায়। ধরে নেওয়া হয়, শিশুর ইমিউনিটি বা অনাক্রমতার সাথে এর সম্পর্ক আছে। এই প্যাপিউলের মধে ‘ইওসিনোফিল’ নামক রক্ত কনিকা অনেক পাওয়া যায়। এই রক্ত কনিকা এলার্জি সংক্রান্ত ঘটনার সাথে জড়িত। এ ছাড়াও ‘নিউট্রোফিল, ম্যাক্রোফেজ নামক কোশও পাওয়া যায়, তারাও শিশুকে রোগ থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও ইন্টারলিউকিন নামক রাসায়নিক পাওয়া যায়, তারা শিশুকে বাইরের ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়ের আক্রমন থেকে রক্ষা করে।
শিশু জন্মানোর সাথে সাথে তাকে আক্রমন করতে আসে বাইরের ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস সহ অন্যান্য জীবানু। শিশুকে ঘিরে ধরে তারা, এবং শিশুর লোমকুপের গোড়া দিয়ে প্রবেশ করতে চায়। বড়দের অপেক্ষা শিশুদের গায়ে লোমকুপের ঘনত্ব অনেক বেশি থাকে। একটি শিশুর শরীরে কম-বেশি ৫০ লক্ষ লোমকুপ থাকে। মনে করা হয়, শিশুর বাইরের জীবানুর সাথে প্রথম যুদ্ধের ফল এই রোগ। তবে এখনও অনেক গবেষনা বাকী।
কোন বয়সে হয়?
জন্মের কয়েক ঘন্টা পরেই এই ফুস্কুড়ি (Papule) দেখা দিতে পারে। তবে সাধারনতঃ এক দিন পরে থেকে দেখা দেয় এবং বেশ কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। দুই সপ্তাহ বয়সের পরে আর এই রোগ হয় না এবং আগে যা হয়েছিল, তা সেরে যায়। যদিও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। তার বেশি থাকলে অন্য রোগের কথা চিন্তা করতে হবে।
চিকিৎসাঃ
কোনও চিকিৎসার দরকার নেই। তবে অন্য কিছু রোগও একই রকম ভাবে শুরু হতে পারে, সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তাই সত্যি এটি মাসি-পিসি রোগ কি না দেখে নিতে হবে। আর শিশুকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। না হলে চামড়ায় অন্য জীবানুর ‘সেকেন্ডারী ইনফেকশান’ হবে।
ভবিষ্যৎঃ
এই মাসি-পিসি সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়। একবার সেরে গেলে এর কোনও দাগ বা চিহ্ন থাকে না। চামড়ারও ভবিষ্যতে কোনও ক্ষতি হয় না। এই রোগের থেকে অন্য কোনও রোগ হয় না।
আর এই রোগ হলে মা নিশ্চিন্ত ভাবে শিশুকে তার স্তনদুগ্ধ পান করাতে পারেন, কোনও বাধা
নানা নাম
ডাক্তারী ভাষায় এই রোগের অনেক নাম। যেমন- Erythema toxicum neonatarum (ETN), Toxic erythema, Erythema toxicum, Flea bite dermatitis ইত্যাদি। নামেরও কিছু গোলমাল আছে। ডাক্তারী ভাষায় ‘Toxic’ মানে ইনফেকশান জাতীয় কিছু। যখন নামকরণ হয়েছিল, তখন হয়ত সেই ধারণা ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখা গেছে সেরকম কিছু নয়। তাই এখন ডাক্তারেরা ওই ‘Toxic’ কথাটি বাদ দিয়ে শুধু ‘Erythema neonatarum’ বলার পক্ষপাতী।
পরিশেষে
এই রোগ বা মাসি-পিসি নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই। যদি সন্দেহ হয় অন্য কোনও রোগ কি না, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।