১.
আইসোলেশন ওয়ার্ডে কোভিড রোগী নেই বললেই চলে। কোনো কোনোদিন এক-দু’জন করে ভর্তি হচ্ছে। বেশিরভাগ দিনই ওয়ার্ডে তালাবন্ধ। টিমটিমে আলোর তলায় ভুতুড়ে চেহারা। অথচ, ক’দিন আগেই চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্না, ভেন্টিলেটরের অ্যালার্ম, ইনফিউশন পাম্পের পিঁকপিঁক, ইঞ্জেকশন ভাঙার খট, পিপিই-র খস, দরজা খোলার ক্যাঁচ… আরও হাজারো আগডুম-বাগডুম-ঘোড়াডুম মিলিয়ে হইহই-রইরই করতো এই জায়গাগুলো। আমরা পিপিই-র তলায় ঘামতে ঘামতে হাঁফাতাম আবার হাঁফাতে হাঁফাতে ঘামতাম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আমাদের সেসব দিন ‘একেবারেই গেছে’। ‘রাতের সব তারা’ কিংবা ‘দিনের আলো’ সেসব যুদ্ধদিনের ইতিহাস ধরে রাখে।
কোভিড পরিস্থিতি একটু সহজ হতেই এতদিন যারা যানবাহনের অভাব ইত্যাদি মিলিয়ে আসতে পারে নি তারা আবার হাসপাতালমুখো হচ্ছে। অনেকেরই অবস্থা পুরো ঘেঁটে ঘ। খিঁচুনি-রোগের বাচ্চা আট-ন’মাস ধরে হাসপাতালে আসে নি। স্বাভাবিকভাবেই ওষুধপত্র সব বন্ধ। হঠাৎ সাংঘাতিক রকম খিঁচুনি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। কিডনি-রোগের বাচ্চার স্টেরয়েড ওষুধ জগাখিচুড়ি। কবে শুরু, কী ডোজ তার ঠিকঠিকানা নেই। ডাক্তার দেখাতে না পেরে যে যেমন পেরেছে ওষুধ খাইয়ে গেছে। খুদে মারণ ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল, কেন স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। সাধারণ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ও চিকিৎসা বাড়ির পাশের হাসপাতালটিতেই সহজলভ্য হ’লে একশো-দু’শো কিলোমিটার উজিয়ে শহরের বড় হাসপাতালে আসার দরকার পড়তো না। শহরের ঝলমলে মোড়কের বাইরে থাকা সত্তর শতাংশ মানুষ ও তাঁদের স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
২.
শীত শেষ ক’দিনে বেশ জাঁকিয়ে পড়েছিল। নিভে যাওয়ার আগে দমক দিয়ে জ্বলে ওঠা প্রদীপ শিখার মতো। হাসপাতালে আমার থাকার জায়গায় মেরামতির কাজ চলছে। পাথর কাটার খ্র্যাঁররর আওয়াজ, রঙের সাথে কেরোসিন গন্ধ, ধুলো-ধোঁয়ার অন্ধকার…
আমার বিছানার পাশের জানলার একটা পাল্লা খোলা থাকে। মশা আটকাতে জাল দিয়ে ঘেরা জানলা। যে পাল্লাটা বন্ধ থাকে সেখানে জাল আর পাল্লার মাঝে সামান্য কিছুটা জায়গা। বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম সেখানে সকাল হলেই কে যেন কয়েকটা করে ডালপালা ফেলে যায়। রোজ ফেলে দিই। আবার পরের দিন যে কে সেই। ব্যাপারটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম, এসব দুই কপোত-কপোতীর কান্ড। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। গোটা বাড়িটা জুড়ে মেরামতির লণ্ডভণ্ড। তাই বেচারারা ডিম পাড়ার জায়গা খুঁজে না পেয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। জাল আর জানলার পাল্লাঘেরা ছোট্ট জায়গাটা তাদের খুব মনে ধরেছে। এরপর আর বাধা দেওয়া চলে না।
দু’দিনের মধ্যেই বাসায় দুটো ডিম। পালা করে দু’জনে তা দিতে শুরু করলো। আমার ঘরে কেউ এলে আমি আস্তে কথা বলতে বলি। বেশি হল্লা করলে তা দেওয়া ছেড়ে ভয়ে উড়ে পালাবে।
ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন… ওরা তা দিয়ে যায়। রাস্তার বড় আলোগুলোও তখন কুয়াশায় ধোঁওয়া ধোঁওয়া।
৩.
আমরা সবাই জানি, কোণের বেডের ওই পুচকে বাচ্চাটা বাঁচবে না। হার্টের জটিল রোগ। ওজনেও বারোশো গ্রাম মাত্র। রক্তের অক্সিজেন নিভু নিভু। নিজে শ্বাস নিতে পারে না। রোজ বাবা-মা’কে জানানো হয়, এ বাচ্চার বাঁচা মুশকিল। হয়তো আজকেই…
তবুও সেই ‘আজ’টা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। নয় নয় করে প্রায় সপ্তাহখানেক গেল। রক্তের অল্প অক্সিজেন নিয়েই সে লড়ে যাচ্ছে।
যে কোনোদিনই নিভে যাবে সে। তবু পুচকে শরীরের ওই লড়ে যাওয়াটা বিস্ময় জাগায়। এত মায়া পৃথিবীর! তাই নিশ্চিত মৃত্যুর আগে আরও কয়েক দন্ড বেঁচে নেওয়া…
“তবুও তো প্যাঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়- অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে”
৪.
আজ পায়রাগুলোর ডিম ফুটে বাচ্চা হয়েছে। দুটো সদ্যোজাত শিশু। লালচে। চোখ ফোটে নি। এখনো মা-বাবার বুকের ওমে।
চোখ ফুটবে, ডানা গজাবে। তারপর একদিন সমস্ত বিরুদ্ধতার হাওয়া ঝাপটে সোজা উড়ে যাবে।
মারীর দেশে ‘জীবন’ মানে স্রেফ ‘লড়াই’।