★
– হাজারদুয়ারী দেখবি বলে বায়না করতিস, এই দ্যাখ, এই হল গে সেই হাজারদুয়ারি।
বাবা কথাটা আমাকে বলল বটে, কিন্তু সত্তরভাগ গর্বিত তৃপ্তি আর তিরিশ ভাগ প্রেম মেশানো দৃষ্টিটা মায়ের দিকে ফেরানো।
ষাট বছর আগে। আমি তখন অবাক হয়ে সেই বিরাট বাড়িটা দেখছি। টিকিটের ব্যবস্থা ছিল কিনা মনে নেই। ভেতরে ঢুকে এলাহি ইতিহাসের ভোজ। কত ছবি, অস্ত্রশস্ত্র। সব ছাপিয়ে ভারি মন টেনেছিল একটা প্লেট। যে মানুষটি সব দেখিয়ে গল্প বলে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, বাবা পরে বলেছিলেন ওঁকে গাইড বলে।
প্লেটটার আজব ক্ষমতা বললেন সেই গাইড। নবাব যা খাবেন, সেটা প্রথমে ওই প্লেটে ঢেলে দেখে নেওয়া হত। নবাবের তো গুপ্তশত্রুর অভাব নেই। খাবারে যদি বিষ থাকত তবে নাকি ওই থালা ফেটে যাবে, এমন ক্ষমতা সেই সেই থালার।
গাইড যা বলবেন, নত মাথায় মেনে নেওয়াই দস্তুর। আমার চোখ গোল হয়ে গেছিল। পরে বেরোবার পর, বাবাকে শুধোতে বললেন
– মনে হয় গল্পই, বুঝলি। তবে অন্য ভাবে করা হত ব্যাপারটা।
মাও উৎসুক জানতে।
বাবা বললেন,
– রাজারাজড়ারা খাবার আগে দাস-দাসী বা পোষা বেড়ালটেড়ালকে খাইয়ে দেখে নেওয়া হত বিষ আছে কিনা।
বহুদিন পরে চাকরিতে ঢুকে এইরকমের এক অদ্ভুত নিয়ম শুনতে পেলাম। দমদম এয়ারপোর্টে রাষ্ট্রীয় ভিআইপিদের আনাগোনা চলে হরবখত। তাদের খাবার যথাবিহিত নিরাপদ কিনা তা বলতে হবে জেলার স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে ।
তা তাঁর না আছে টক্সিকোলজি জানা লোকজন, না আছে ল্যাব। কলকাতা বোম্বেতে স্যাম্পল পাঠিয়ে টেস্ট করিয়ে আনা যায় বটে কিন্তু ততক্ষণে ভিআইপি সাহেবের ফেরত যাবার ফ্লাইটের বেলা পেরিয়ে যাবে। আর তা ছাড়া খিদের মুখে খাবার না পড়লে সেই বাছার পিত্তি উঠবে যে। কী আর করা। সেই কালের সেই নিরীহ স্বাস্থ্যকর্তা তাই নিজে সেই রাজভোগ্য খাবার প্রত্যেকটা অল্প অল্প করে চেখে আধঘণ্টা বাদে রায় দিতেন,
– না, খাবারে বিষ নেই।
স্বস্তির শ্বাস ছাড়ত সমবেত পাত্র মিত্র অমাত্য। যাক, হুজুরের ক্ষতি হবে না।
তবু, হুজুর প্রথম গেরাস মুখে তোলার আগে অভাগাকে জিজ্ঞেস করত সন্দেহাকুল গোয়েন্দা আমলা,
– কী ডাক্তারসাহেব, শরীর কিছু খারাপ লাগছে না তো আপনার?
রাজভোগ খেয়ে তৃপ্ত পোষা বেড়ালটি উদ্গত ঢেকুর চাপতে চাপতে ফিরে আসার জিপে উঠতেন,
– নাঃ, এমনিতে সব ঠিকই আছে। ওই একটু বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েচে, এই যা!
আমার মতন লোভী, সদ্য চাকরিতে জয়েন করারা, বেশ একটু হিংসেই করতাম সেই কর্তার খাদ্য-ভাগ্যকে। আহা রাজ-ভোগ বলে কথা!
একজন অতি সাবধানী স্বাস্থ্যকর্তা নাকি পকেটে করে বাড়িতে তৈরি স্যান্ডউইচ নিয়ে যেতেন। টেস্ট ডোজের সময় গোপনে সেইটি খেয়ে লোক দেখিয়ে টিস্যুতে মুখ মুছে ভান করতেন।
যতদিন না, এই জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা এর প্রতিবাদ করলেন এই রাজকীয় ব্যাপার চলছিল। আমাদের সংগঠন এএইচএসডির তরফেও আপত্তি তোলা হল, এই নিয়ম বদলাতে হবে। স্বাস্থ্যকর্তা কি প্রশাসনের পোষা বেড়াল নাকি যে রাজপুরুষ/নারী খাবার আগে তাকে খেয়ে বলতে হবে খাবারে বিষ নেই! অনেক দূর জল গড়িয়েছিল সেবার। বিধান সভা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর, আরও কোথায় কোথায়।
আমরা বঞ্চিতরা মনে মনে বললুম,
– বেশ হয়েছে। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না।
সেই নিয়ম পাল্টালো সেই আপত্তি শুনে। এখন অবশ্য কী করা হয় জানি না।
আজ বহুদিন পর খবরের কাগজ পড়ে সেই পুরোনো কথা মনে পড়ল।
কোন কোন স্বাস্থ্য আমলা নাকি খবর অনুযায়ী সন্দেহ মোচল করতে দেহে নিয়েছেন মুচলেকা দেওয়া সেই ইয়ে। সাবাস দিতেই হবে। সাহসের জন্য।
কেন জানি না, আমার আবারও প্রাচীন রাজগৃহের সেই হতভাগা বেড়ালদের কথা মনে পড়ল।