সেটা শীতের সন্ধ্যা । দুপুর থেকে আকাশের মুখ ভার – ছিঁচকাঁদুনি বৃষ্টি ঝরছে । রাস্তার হ্যালোজেন আলো ভেজা পিচ রাস্তায় পিছলে পিছলে যাচ্ছে । একটা দুটো গাড়ি – জল ছিটিয়ে হুশহাশ বেরিয়ে যাচ্ছে । জীবনদীপ নার্সিং হোমের গ্লো সাইনবোর্ড জ্বলছে নিবছে । দূরে কোথাও কারো কৌমার্যের অন্তিম লগ্ন ঘোষণা করতে প্যাঁ প্যাঁ করে সানাই বেজে যাচ্ছে । সামনে শেডে বসে নীলু সিং – দ্বারওয়ান চাদর মুড়ি দিয়ে জিলিপি আর ফিশ ফ্রাই খাচ্ছে । ভেতর থেকে আধবুড়ো একটা টাকলা এসে কি যেন বললো ; নীলু সিং মনের আনন্দে আরেক দফা ফিশফ্রাই নিয়ে খেতে আরম্ভ করলো ।
এই নার্সিং হোমটা ছোটখাটো , চারতলা – সবচে’ ওপরের তলায় ডাক্তার থাকে , তার পরমা সুন্দরী বৌ পরমার সঙ্গে – সঙ্গে ফাউ – দ্য গ্রেট , সবার প্রিয় চার বছরের সায়নদীপ , ডাক্তার বিভাসের কার্বন কপি । তিন তলাটা ওটি আর ছোট্ট আইটিইউ । দোতলা পুরো আর একতলার অর্দ্ধেক কেবিন । একতলায় রিসেপশন আর এক্সরে আল্ট্রা সাউন্ড রুম । আজ রিসেপশনের আধবুড়ো টাকলা লোকটার বিবাহ- বার্ষিকী । সেই আনন্দে সব স্টাফদের ফিশফ্রাই আর জিলিপি বিতরণ করা হয়েছে ।
আধবুড়ো ভদ্রলোক হলেন অশোকবাবু – একাধারে রিসেপশনিস্ট এবং ক্যাশিয়ার । রিসেপশন ডেস্কে বসে আছে প্রিয়াঙ্কা – মধ্য তিরিশ ,পৃথুলা এবং সাজুনি ।এছাড়া আছে ড্রেসার এবং কম্পাউনডার দীপু । আরএমওও একজন আছে – সদ্য ডাক্তার কৃষ্ণেন্দু ।
অশোকবাবু বিভাসকে বললেন ” স্যর পেশেন্ট ডিসচার্জ হয়েছে তার টাকা ড্রয়ারে রাখা আছে , আর ল্যাবের টাকা বিলের সঙ্গে মিলিয়ে তোলা আছে । ”
বিভাস বললো ” ঠিক আছে । ও হ্যাঁ কাল কিছু পেমেন্ট করতে হবে নাকি ? ”
অশোকবাবু জানালেন ” কাল সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টের পেমেন্ট হবে – তবে চেকে ; আর স্যর ডক্টর মুখার্জি একটা পেশেন্ট পাঠিয়েছেন , একশো দুই খালি আছে – ওতে দীপু অ্যাডমিট করে দেবে – ডক্টর মুখার্জি আসা পর্যন্ত কৃষ্ণেন্দু সামলে দেবে – বোধহয় ডায়রিয়া কেস । ”
এমন সময় নীলু মানে নীলকমল সিং বৃষ্টি ভেজা চাদর মুড়ি দেওয়া চারজন মানুষকে ভেতরে নিয়ে এলো ।
অশোক বললো ” ঐ যে ডক্টর মুখার্জির কেস চলে এসেছে , তাহলে আমি আসি ? ”
বিভাস বললো ” নিশ্চয়ই , রাতও হলো আর দেরী করলে আবার বৌদি ফুলশয্যা ক্যানসেল করে দেবেন ”
পাশ থেকে পরমা ধমক দিলো ” আঃ , কি হচ্ছে কি ! ”
রিশেপনিস্ট প্রিয়াঙ্কা ওই চাদরমুড়ি লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো ” কৈ প্রেশক্রিপশন দেখি ? ”
ওদের থেকে একজন এগিয়ে এলো, শক্ত পেটানো চেহারা, বেশ লম্বা – মাথা মুখ চাদরে ঢাকা। প্রিয়াঙ্কা হাত বাড়িয়ে দিলো, লোকটাও চাদরের তলা থেকে তার লম্বা হাতটা বার করলো। তারপর সেই হাত দিয়ে এক টানে টেলিফোনের তারটা ছিঁড়ে ফেললো। অন্য হাতে একটা লোকাল মেকের ওয়ান শটার। এযুগে টেলিফোনের তার ছিঁড়ে কিছু লাভ নেই, ওটা জাস্ট ভয় পাওয়ানো । ” টাকা কড়ি যা আছে সব বার করে দে ।”
এই সময় চার বছরের ছোট্ট সায়নদীপ একটা কান্ড করলো । লম্বা লোকটার কাছে গিয়ে তার খেলনা পিস্তলটা বার করে বলে উঠলো” হ্যান্ডস আপ , নইলে গুড়ুম করে দেবো ” ।
লম্বা লোকটা – সম্ভবতঃ দলের সর্দার – এক ঝটকায় চাদরটা ফেলে বাঁ হাতে টান মেরে সায়নদীপকে ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেললো । সবাই বুঝে গেলো মানুষের প্রাণ বা শিশুর জন্যে মায়া দয়া আর যারই থাকুক এই লোকগুলোর নেই । সায়নদীপ মাটিতে পড়ে আছে ওর ঠোঁট দুটো ফুলে উঠছে কিন্তু কাঁদছে না ।
বিভাস খসখসে গলায় বললো ” ও ছোট ছেলে – এতটা বোধহয় না করলেও হতো । ”
সর্দার দাঁড়িয়ে আছে – ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে – গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে – কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম । হাপরের মতো বুকটা উঠছে নামছে – জামাটাও ঘামে ভেজা । দম নিয়ে নিয়ে ভাঙা গলায় হিসহিসিয়ে উঠলো” বেচাল চললে কোনও শালা বাঁচবি না , বুঝলি হারামির বাচ্চা ? ” কথাটা বিভাসকে বলা । উত্তেজনায় লোকটার কপালের শিরাও ফুলে উঠেছে । সে একটা চেয়ারে বসলো । দৃশ্যতঃ তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । কপাল দিয়ে ঘাম জলের মতো গড়িয়ে পড়ছে । লোকটি এখন হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে ।
বিভাস একটুও না নড়ে ডাকাতের দলের লোকেদের বললো “এক্ষুনি চিকিৎসা না করলে আর কিন্তু কয়েকটা ঘন্টা ওর আয়ু । ”
সবাই নিশ্চল – পাথরের মতো – কি হতে চলেছে কেউই বুঝতে পারছে না ।
” কার স্যর ? ” প্রিয়াঙ্কা প্রশ্ন করে ।
বিভাস প্রিয়াঙ্কার কথায় পাত্তাও দ্যায় না।” ভয় নেই ডাকাতবাবু পুলিশ ডাকবো না”। বিভাস রিসেপশন টেবিলে কনুই রেখে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ” তোমরা কি এই ডাকাতটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে ? নাকি আমিই চিকিৎসা করবো ? ”
ডাকাতরা কিছুটা থতমতো খেয়ে গ্যাছে , কাজেই উত্তরের আশা না করে বিভাস সায়নদীপকে কোলে তুলে নিলো । তারপর নীলু সিংকে বললো ” ওকে ধরে ট্রলিতে শুইয়ে দাও আর কৃষ্ণেন্দু তুই একটা ডেরিফাইলিন আর দুটো ল্যাসিক্স আইভি দিয়ে দে।”
নীলু সিং হতভম্ভ ভ্যাবাচ্যাকা দাঁড়িয়ে ছিলো , একটা কাজ পেয়ে সর্দারকে শুইয়ে দিলো ।
বিভাস তারপর ছোট্ট সায়নদীপকে মায়ের কোলে তুলে বললো “ব্রেভ ম্যান”।
ওকে প্যাট করে সর্দারের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো “কিহে ডাকাতবাবু তোমার প্রেশার কতদিনের ? রাতে শুলে শ্বাসকষ্ট হয় ?”
ডাকাতের সর্দার অস্ফুটে জানালো হয় এবং এখনও ওর খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ।
কৃষ্ণেন্দু ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় বিভাস ওকে বোঝাতে থাকে “দ্যাখ কৃষ্ণেন্দু এই লোকটা মিনিটে না হলেও তিরিশ বার নিশ্বাস নিচ্ছে … ঘড়ঘড়ে আওয়াজ তো বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছে। ওর গলার শিরাগুলো সব বিভৎস ফোলা ফোলা … …হ্যাঁ পাল্স অক্সিমিটারটা লাগিয়ে দ্যাখ রক্তে কতভাগ অক্সিজেন … ওর পা দুটো দ্যাখ বেশ ফোলা ফোলা তাই না ?”
কৃষ্ণেন্দু সায় দ্যায় তারপর প্রশ্ন করে “আর ঐ ব্লাড প্রেসার … ওটা কি ভাবে বুঝলে ? ….. এই দীপু অক্সিজেন মাস্ক লাগা .. স্যাচুরেশন সেভেন্টি ফোর …. ” দীপু অক্সিজেন দিতে বা ইঞ্জেকশন পড়তে ডাকাত সর্দার একটু আরাম পেয়েছে ।
বিভাস বলতে থাকে “ব্লাড প্রেসারের ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজিফিকেশন .. এই কুচকুচে রংএ লালচে গাল দেখেছি এটা বলবো না ..তবে আন্দাজ করেছি …..”
শুরু হলো চিকিৎসা পর্ব – ডাকাতের বুড়ি বৌ এসে রোজ রিসেপশনে বসে থাকে । প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে কথা বলে টাকার অঙ্কটা জেনে নেয় আর মুখ চুন করে বাড়ির পথ ধরে। বিভাস কথা রেখেছে – পুলিশকে জানায়নি তবে দলের বাকি ডাকাতগুলো কিন্তু আর একদিনও এদিক পানে ঘেঁষে নি।
পনেরো দিন পরে একটা ঘুপচি মতোন ঘরের বারান্দায় সেই ডাকাতটা – যার নাম হীরু ওর্ফ সাকমল ওর্ফ ন্যাটা দীনেশ বসে আছে। মুখটা চুপসে গেছে , গলার শিরা আর দেখা যায় না – নিঃশ্বাসও ধীর লয়ে চলছে – মাথার কাঁচা পাকা চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কত টাকা লাগলো মোটামুটি ? ”
বুড়ি বললো ” নব্বই হাজার – ঘরে যা সোনা ছিলো বেচে দিলাম ” বুড়োর মুখটা ম্লান হয়ে গেলো ।
বুড়ি সান্ত্বনা দিয়ে বললো “যাই হোক না কেন তুমি তো বেঁচে ফিরেছো ! ডাক্তারবাবু বলেছে তুমি তো আর ঐসব করতে পারবে না তাই তোমাকে নার্সিং হোমের দ্বরোয়ানের কাজে রাখবে ….ডাক্তারবাবু মানুষ নয়কো ভগমান গো ভগমান …” বলে কপালে হাত ঠ্যাকালো ।
বুড়ো ডাকাতও দুহাত জোড়া করে কপালে ঠেকালো ।
বুড়ি অবাক হয়ে বললো “অমা ….তুমি আবার কাকে অসময়ে পেন্নাম করলে ? তোমায় তো কখনো কারুক্কে পেন্নাম করতে দেখি নি … ”
বুড়ো বললো “আমার গুরুদেবকে।”
অবাক বুড়ি একটুখানি ভেবে বললো “তাকে আবার কোথায় পেলে ?”
ডাকাত সর্দার খানিক অন্যমনে তাকিয়ে থেকে বললো “ঐ পেলাম কোথাও আরকি । ধরে নে নার্সিং হোমেই পেইছি …”
বুড়িও আবার কপালে হাত ঠ্যাকালো । সন্ধ্যা নেমে এলো । দুজনেই চুপ করে বসে রইলো ।
খুব ভালো লাগলো। ভালো ছাত্র দের সব কিছু ভালো।