তখন আমি ইন্টার্ন। যেকোনও জায়গায়, যদি বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটানোর প্রশ্ন থাকে, এমনকি হাসপাতালের ডিউটিতেও, আমি সঙ্গে একখানা বই নিয়ে যাই। সবসময় যে খুব পড়া হয়ে ওঠে এমন নয়, তবুও… বলা তো যায় না, যদি কিছু ফাঁকা সময় পাই, মূলত এমন ভাবনা থেকেই বইটা সাথে রাখা।
তো সেদিনও ওরকমই। ইন্টার্নের যে কাজ, সেসব শেষ করে অপেক্ষায় আছি, কখন স্যার রাউন্ডে আসবেন। স্যারের দেরি হচ্ছে, বইটা খুলে পড়ছি – আলবেয়ার কামু-র দ্য প্লেগ। কামু-র নামটি ইংরেজিতে Albert Camus হিসেবে লেখা হয়, এটা অনেকেই জানেন। বই পড়তে পড়তে মশগুল হয়ে খেয়ালই করিনি, কখন স্যার এসে পড়েছেন। চটক ভাঙল স্যারেরই ডাকে – এটা কী বই পড়ছ, বিষাণ? অ্যালবার্ট ক্যামাস??
বলাই বাহুল্য, একেবারে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম। স্যার কামু-র নাম শোনেননি! প্লেগ-এর মতো বইয়ের নামটুকুও জানেন না!! বিশেষ করে এমন একজন স্যার, যিনি ডাক্তারিটা সত্যিই ভালো জানেন এবং ভালো পারেন, তিনিও…
তবে ডাক্তারিজীবনে আরেকটু এগোনোর পর দেখলাম, এত বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। অনেক খ্যাতিমান চিকিৎসক-অধ্যাপকই ডাক্তারির বাইরে কিছুই জানেন না, জানা প্রয়োজন এমনও মনে করেন না। (এদিকে ডাক্তারিটা ভালো জানেন বলে বাকি সব বিষয় – যেসব কিনা তাঁদের চোখে ‘ও আর জানার কী আছে’ – সেসব নিয়ে ভয়ানক বোকা বোকা ও অগভীর বক্তব্য রেখে বসেন। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।)
এমডি করার সময় আমার আরেক স্যার আমার হাতে জন গ্রিবিন-এর দ্য বার্থ অফ টাইম দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন। বাহ্, বিষাণ, দারুণ বিষয় নিয়ে পড়ছ। খুব গুরুত্বপূর্ণ টপিক, খুব প্র্যাক্টিকাল বিষয়। আমার স্যার গ্রিবিন এবং পপুলার সায়েন্সের এসব বিষয় নিয়ে খবর রাখেন ভেবে খুবই চমৎকৃত হচ্ছিলাম, কেননা ইতোপূর্বে এ নিয়ে তাঁর কোনও রকম আগ্রহের খবর পাইনি – কিন্তু ওই প্র্যাক্টিকাল টপিক পয়েন্টটায় খটকা লাগল। তা প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, টাইম অফ বার্থ, অর্থাৎ জন্মক্ষণ, যা কিনা ওই বইয়ের বিষয়, তা আমাদের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। সে নিয়ে জানার চাইতে কাজের পড়া আর কী-ই বা হতে পারে! বলাই বাহুল্য, স্যার জ্যোতিষে বিশ্বাসী। বার্থ অফ টাইম আর টাইম অফ বার্থ – সময়ের জন্ম আর জন্মের সময় – যে একই নয়, স্যারকে আর সেসব কথা বলিনি।
কিন্তু, দেখুন, বুঝতে পারছি, আমার বয়স হচ্ছে। বলতে চাইছিলাম দ্য প্লেগ উপন্যাস নিয়ে। ধরতাই হিসেবে প্রথম গল্পটা বলছিলাম, কিন্তু দ্বিতীয় গল্পটা স্রেফ গল্প বলার ফ্লো-তে চলে এলো।
তো আর বাজে হ্যাজ নয়। আলবেয়ার কামু-র দ্য প্লেগ আমার জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ কিছু উপন্যাসের অন্যতম। ডাক্তারি ছাত্র মাত্রেরই এই বই পড়ে দেখা উচিত বলে আমার মনে হয়। আর কোভিড কাটিয়ে ওঠার পরের বিশ্বে যাঁরা যাঁরা লিখতেপড়তে পারেন, তাঁদের সবারই এই বই পড়া উচিত বলে আমার ধারণা। আগের দুটি বাক্য বাড়াবাড়ি বলে মনে হলে বইটা পড়ে তারপর বলুন। The Plague, by Albert Camus. (ফরাসী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ) বাংলায় একটা অনুবাদ আছে, মূল ফরাসী থেকে বাংলা করেছিলেন দেবীপদ ভট্টাচার্য – বইয়ের প্রকাশক, র্যাডিক্যাল, দাম ১৭৫ টাকা – অনুবাদ বইটির নাম, মারী – অনুবাদের মান মোটামুটি। বাংলায় আরও অনুবাদ রয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
ইংরেজি অনুবাদ দ্য প্লেগ থেকে কিছু অংশ আপনাদের পড়তে দিলাম – আমার মতো করে অনুবাদ করে – আমার খুব প্রিয় এই অংশটি। মঁসিয় তারু আর ডা রিও-র কথোপকথন :
– ডাক্তার, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
– না, করি না। কিন্তু তাতে কী আসে যায়! আমি এখনও অন্ধকারের মধ্যে আলো খুঁজে চলেছি, ব্যাস এটুকুই। এই খোঁজার মধ্যে যে আলাদা করে গৌরব করার মতো কিছু আছে, সে অহঙ্কার আমার অনেকদিনই ভেঙে গেছে।
– কিন্তু এই বোধটাই তো ফাদার পানেলু-র থেকে আপনাকে আলাদা করেছে, তাই না?
– নাহ্, ওরকম কিছু দাবি আমার নেই। তিনি পণ্ডিত মানুষ, হয়ত মৃত্যুর সঙ্গে তেমন পরিচিত নন, তাই তিনি জোর গলায় ‘সত্য’ বিষয়ে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু গ্রামের যেসব যাজক সাধারণ মানুষের শোক-দুঃখে সান্ত্বনা দেন, যাঁরা দিনরাত মৃত্যুপথযাত্রীর দীর্ঘশ্বাস শোনেন, তাঁরা হয়তো আমার মতো করেই ভাবেন। দুঃখের মাহাত্ম্য নিয়ে আলোচনা করার অনেক আগে তাঁরা দুঃখ দূর করার কথা ভাবেন।
– আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, সত্যিই যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেন, তাহলে কর্তব্যের ব্যাপারে আপনি এতখানি সিরিয়াস কেন?
– আমার আগের কথায়ই তো এর উত্তর আছে। সত্যিই যদি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে পারতাম, তাহলে মানুষের রোগ সারানোর চেষ্টা করতাম কি? রোগ সারানোর ভার সেই সর্বশক্তিমানের উপরেই ছেড়ে দিতাম। কিন্তু, হয়ত, পৃথিবীতে কেউই সেরকম কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। এমনকি ফাদার পানেলু-ও না, যদিও তিনি নিজে বিশ্বাস করেন যে ওরকম সর্বশক্তিমানের অস্তিত্ব বিষয়ে তিনি একেবারে নিঃসন্দেহ।
– তাহলে নিজের পেশা বিষয়ে আপনার মতামত এরকমই?
– মোটামুটি তা-ই বলতে পারেন। নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমার খুব অহঙ্কার। ভাবছেন, অহঙ্কারী না হলে কেউ এরকম করে ভাবতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নিজের কাজটুকু চালিয়ে যেতে পারার জন্য যেটুকু অহঙ্কার জরুরি, তার বেশি অহঙ্কার আমার নেই। আমার নিজের ভবিষ্যত বা এই মহামারী কাটিয়ে ওঠার পর সামগ্রিকভাবে কী হবে, সে নিয়ে আমার কোনও ধারণাই নেই। শুধু জানি, এই মুহূর্তে অনেক মানুষ ভয়াবহ এক রোগের পাল্লায় পড়েছে আর আমাকে তাদের সারিয়ে তুলতে হবে। এই খারাপ সময়টা কেটে গেলে হয়তো তাঁরা এই দুঃসময়ের তাৎপর্য নিয়ে ভাববেন – আমিও হয়ত সেসব নিয়ে ভাবতে বসব – কিন্তু তার আগে আমার কর্তব্য তাঁদের সারিয়ে তোলা। আমি আমার সাধ্যমতো তাঁদের রক্ষা করার চেষ্টা করছি, এটুকুই।
– কিন্তু, ডাক্তার, কীসের হাত থেকে আপনি এদের রক্ষা করতে চাইছেন?
– সে সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। বিশ্বাস করুন, একেবারে কোনও ধারণাই নেই। যখন ডাক্তারিতে ঢুকেছিলাম, অতকিছু ভেবে ঢুকিনি। হয়তো জীবনযাপনের জন্য কিছু একটা করার দরকার ছিল, হয়তো আর পাঁচটা পেশার মতো এটাকেও আরেকটা পেশা হিসেবে দেখেছিলাম, হয়তো অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যেসব কারণে ডাক্তার হতে চায় আমিও সেকারণেই ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। আমার মতো একটা দিনমজুরের ছেলের পক্ষে ডাক্তার হওয়াটা কঠিন, তাই হয়তো আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছিলাম। আর তাছাড়া আমার দেখার দরকার ছিল, মানুষ কীভাবে মরে। জানেন, এমন অনেক মানুষ আছে যারা কিছুতেই মরতে চায় না? মৃত্যুশয্যায় এক নারী চীৎকার করে বলছে, না না, আমি বাঁচতে চাই, আমি কিছুতেই মরতে চাই না – আপনি শুনেছেন সেই চীৎকার? আমি শুনেছি। আর এও বুঝেছি, এত মৃত্যু দেখেও আমি আজও মৃত্যুতে অভ্যস্ত হতে পারিনি, মৃত্যু আজও আমার কাছে একইরকম রহস্যময়। যখন বয়স কম ছিল, পৃথিবীর যাবতীয় প্রথা আর নিয়মের বিরুদ্ধে আমার মন বিদ্রোহ করত – অন্তত আমি তেমনই ভাবতাম – কিন্তু এখন আমি অনেক শান্ত সহিষ্ণু অনেক সংযত হয়ে গেছি, শুধু মৃত্যুর দৃশ্যে অভ্যস্ত হতে পারিনি। এর বেশি আর কিছু জানি না। তবু… এত কিছুর পরও…
– এত কিছুর পরও কী, ডাক্তার?
– দেখুন, আপনার মতো লোক হয়তো বুঝবেন, মৃত্যুই পৃথিবীর নিয়ম স্থির করে। যদি আমরা ভগবানে বিশ্বাস না করি, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভগবানের ভরসায় বসে থাকার পরিবর্তে যদি আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, তাহলে তা, হয়ত, ভগবানের পক্ষেও ভালো।
– হ্যাঁ, আপনার কথা বুঝতে পারছি। শুধু দুঃখের কথা, এ যুদ্ধে আপনার জিত স্থায়ী হবে না।
– ঠিকই। তাই বলে তো হাল ছেড়ে দিতে পারি না।
– সেকথাও ঠিক। কিন্তু এও বুঝি, তারপরও আপনার কাছে এই মহামারীর তাৎপর্য।
– তাৎপর্য? হার। হেরে যাওয়া। এমন এক পরাজয়, যা অন্তহীন।
– ডাক্তার, এমন কথা আপনাকে কে শেখাল?
– শোক…