না, না, কাল যে কিছু পাবলিক সম্পূর্ণ বিনা দোষে নিমতায় ডাঃ গৌতম রায় এবং তাঁর বাবা সমেত পরিবারের অন্য সদস্যদের আড়ংধোলাই দিল, বাড়িঘর তছনছ করল, এসব নিয়ে কিছু বলছিই না। গুন্ডামি এবং উচ্ছৃঙ্খলতা যে রাজ্যে প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় তলায় বসে মুড়ি-নারকোল খেয়ে বেড়ে ওঠে ভোটে খেলা দেখানোর জন্য, যে রাজ্যে ধর্ষণের হয়ে সাফাই আসে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে, সে রাজ্যে ডাক্তার পেটানো বড়জোর ‘দুষ্টু ছেলেমেয়েদের একটু গন্ডগোল’ কিংবা অত গুরুতরও কিছু না। কারণ, ডাক্তার নিগ্রহের এই গণ-লুম্পেনপনা বরদাস্ত না করার কোনও কড়া বার্তা গত এগারো বছরে একবারও প্রশাসনের কাছ থেকে আসেনি, অন্তত আমার জানা নেই। কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে বাধিত হব। অতএব ওসব কথা বেকার সময় নষ্ট।
তার চেয়ে বরং নিচের কথাগুলো একটু শুনুন।
আপনারা, যাঁরা গুগল পড়ে, অর্ধেক, কিংবা তারও কম বৈজ্ঞানিক ইংরেজি শব্দগুলো বুঝে উঠতে পেরেই, ডাক্তারীটা খুব ভালো করে শিখে নিয়েছেন, তাঁদের বলছি।
আপনারা, যাঁরা পায়ের বুড়ো আঙুলের গাঁটের ব্যথা থেকে শুরু করে কষা পায়খানা (সরি, পটি), কোমরের ডানদিকে ব্যথা, বুকের ব্যথা, ঘাড় যন্ত্রণা, মাথাঘোরা, মৃগী এমনকী সম্পূর্ণ জ্ঞান হারানোকেও “গ্যাসের পবলেম” বলে “ডায়াগোনিসিস” করে ফেলেন এবং প্রথম কয়েক ঘন্টা, কখনও সারাদিন ধরে বাড়ির লোককে টিটমেন হিসেবে ‘প্যানফট্টি’ কিংবা ‘প্যান্ডি’ খাওয়ান, তাঁদের বলছি।
আপনারা যাঁরা নিজের বা বাড়ির কারুর হঠাৎ কোনও ভয়ানক শারীরিক কষ্ট হলে আশেপাশের যে কোনও একজন ডাক্তার – তিনি চোখ, চামড়া, হাড়, গাইনো, প্যাথোলজি যা কিছুর ডাক্তার হতে পারেন – তাঁর বাড়িতে পাড়ার চাট্টি হুব্বা ছেলে (এখন পাঁশশো টাকার গুণে মহিলাবাহিনীও পাওয়া যায়) জুটিয়ে হুজ্জুতি করতে থাকেন ‘একবাট্টি বাড়িতে গিয়ে দেখে আসা’র জন্য, তাঁদের বলছি।
জেনে রাখুন, হঠাৎ বুক মুচড়িয়ে ব্যথা হলে হার্ট অ্যাটাকটাই আগে ভাবুন। রোগীর বয়স আঠেরো হলেও ভাবুন, কারণ এই বয়সেও এগুলো ঘটে এবং সেটা হার্টের ধমনী-শিরায় জন্মগত দোষের জন্য – ডাক্তারের ভুলে নয়। আর অল্পবয়সের হার্ট অ্যাটাক মেরে ফেলার আগে সময় দেয় বড্ড কম। ইয়োরোপ-আমেরিকার হেলিকপ্টার সার্ভিসেও এসব রোগী বাঁচানো বড় কঠিন হয় – এটা একটু জেনে রাখুন।
হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলে, কথা জড়াতে থাকলে, একটা পাশ অবশ হলে বা খিঁচুনি হতে থাকলে স্ট্রোকের কথাটাই মাথায় রাখুন। ওটা ‘গ্যাসের পবলেম’ নয়। গ্যাস মাথায় ওঠে না – ও’রম কোনও রাস্তা শরীলে নেই। আপনাদের সর্বজ্ঞ নেতারা মাঠে দাঁড়িয়ে গলার শির ফুলিয়ে বললেও না। হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকে অ্যান্টাসিড খাওয়ালে রোগী মারা যাবেই – ডাক্তারকে খুন করলেও সে রোগী, আপনাদের ভাষাতেই, ‘মায়ের ভোগে’ চলে যাবে।
যদি রোগীকে বাঁচাতে চান, যদি তাঁর জীবনবীমার টাকাটার আশু প্রয়োজন না থাকে, যদি বৃদ্ধ রোগী বাড়ির একটি প্রয়োজনীয় ঘর আগলে না বসে থাকেন – এ সব ঘটলে হাসপাতালে ছুটুন, কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি মিনিট মূল্যবান। অ্যান্টাসিড খাওয়ানো, ডাক্তারকে বাড়িতে ডেকে এনে ‘একবার দেখিয়ে নেওয়া’, পাড়ার চেম্বার খুললে তখন গিয়ে দেখানো – এসব স্রেফ সময়ের অপচয়। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের চিকিচ্ছে বাড়িতে হয় না, হবেও না। ‘অগ্নীশ্বর’ ফিলিমে দেখালেও – না এবং না। আমার অনেক পরিচিত মানুষ এবং হাসপাতালের রোগী এসব করতে গিয়ে স্রেফ মরে গেছেন।
এবারে আপনি কোন হাসপাতালে যাবেন, সেটা আপনার ব্যপার। আমজনতা হলে পাড়ায় পাড়ায় সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল আছে, হাতে পাঁচলাখ টাকার ম্যাজিক কার্ড আছে। মালদার পার্টি হলে ক্যাশলেস থাকবে, নাহয় ক্রেডিট কার্ড। আর এর একটিও আপনার না থাকলে সে দায় ডাক্তারদের নয়। কেন নেই, সে প্রশ্ন জায়গামতো করতে শিখুন।
আর, মানুষমারা ‘এলোপ্যাথি’ ডাক্তারদের এবং তাঁদের হাসপাতালের উপরে বিশ্বাস না থাকলে আরও অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞান আছে। সরকার তাঁদের রীতিমতো প্রোমোট করছেন। তাঁরা হয়ত পারবেন। আমরা, মানে আপনাদের ঘেন্না ও নিন্দার পাত্র ‘এলোপ্যাথ’রা বাড়িতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক সারাতে পারি না। কারণ, পৃথিবীতে কোথাও সেটা হয় না।
আর এ লেখা পড়ার পরেও যদি আপৎকালে বাড়ির লোককে হাসপাতালে নিয়ে না যান, তবে গাফিলতি আপনার। খুন ডাক্তার করেননি, আপনার বাবা-মাকে, ভাই-বোনকে, ছেলে-মেয়েকে আপনি খুন করেছেন আপনার মূর্খামির জন্য অথবা কোনও নোংরা ধান্দায়। কিছু বেকার, ফালতু-জীবন লোককে জোগাড় করে ডাক্তারকে পেটালেও আসল খুনি আপনিই।
*************************************************
পুনশ্চঃ নিচের ছবির লোকগুলিকে দেখুন। এরা সেদিনের গুন্ডাবাহিনী। জবরদখল জমিতে শিক্ষাহীন, বোধহীন, ভবিষ্যৎহীন, জন্মনিয়ন্ত্রণহীন বাড়বাড়ন্ত। স্রেফ পেটের ভাত, মৈথুনের ছাউনি আর নেট ভরানোর সংস্থানের জন্য কাল লাল, আজ ঘাস, পরশু পদ্মের ছায়ায় নিরুপায় আশ্রয় খোঁজা। এর দায় ডাক্তারদের নয়। কিন্তু তাঁরাই এদের ঈর্ষার সহজ টার্গেট। মাথা ও গতর খাটিয়ে, রাত জেগে রোজগার করা ডাক্তারের কেন বাড়ি হবে, কেন সে গাড়ি চড়বে, কেন সে লোকনাথপুজোর খিচুড়িটা স্পনসর করবে না! এদিকে পাড়ার কোনও ঘুষখোর কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত সদস্যকে একটা প্রশ্ন করারও মুরোদ নেই – তাহলে ভিক্ষার ডালা বন্ধ। সুতরাং, ঈর্ষা পুঞ্জীভূত হয়। সামান্য অছিলায় ডাক্তারকে মারো, তাঁর বাড়ি ভাঙচুর করো – অপ্রাপ্তির আফশোসকে হিংসা দিয়ে পুষিয়ে নাও। আজ ডাক্তাররা কেলানি খাচ্ছে, আগামীতে শিক্ষিত, স্বচ্ছল প্রতিটি মানুষ এরকম হামলার শিকার হবেন তুচ্ছ অজুহাতে। বেশি দেরী নেই।
ঘটনা হল, এই নষ্টরাজ্যে এরাই পনেরো আনা। আর এদের কাঁধে ভর দিয়েই শাসকের সিংহাসন। অতএব…. এগিয়ে বাংলা।