[স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উন্নত মেধা ও শ্রম সম্পদ সত্ত্বেও বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন মতবাদের সংগঠিত রাজনৈতিক দল গুলি এবং তাদের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি অথবা তাদের নানা কিশিমের আন্দোলন ও বিদ্রোহ – বিপ্লব গুলি ভূমি সংস্কার; সম্পদ বণ্টন; দারিদ্র মোচন; পানীয় জল, খাদ্য, গৃহ ও কর্মস্থানের ব্যাবস্থা; স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ; নাগরিক বিশেষত শিশু ও নারীর নিরাপত্তা; পরিবেশ সংরক্ষণ প্রভৃতি নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিই পূরণ করতে পারলেন না। কেবল গালভরা বুলির অন্তরালে সুবিধাবাদ, স্বৈরাচার, অবহেলা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, পরিবারতন্ত্র, দলবাজি, ঘৃণা, হিংসা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, ধর্মীয় বুজরুকি, জাতি দাঙ্গা, যে কোন মুল্যে ভোটে জেতা, ক্ষমতা দখল ও রক্ষা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, আর্থিক প্রতারণা ও তছরুপ, তোলাবাজি প্রকট। সেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং পরবর্তী স্বাধীন ভারতে এই ক্ষমতালোলুপ আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক মাফিয়া এবং তাদের আমলাতন্ত্র ও পশ্চাদপদ ব্যাবস্থাপনাকে সামলে; এরা সকলেই ব্রিটিশ লগ্নি পুঁজির সহযোগী হলেও বিড়লা – ঠাকুরদাস এবং ইস্পাহানি আদমজী হাজি দাউদদের মত স্বাধীনতার আগে থাকতেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে মাখামাখি না করে কিংবা আম্বানি – আদানিদের মত স্বাধীনতা পরবর্তী শাসকদল কংগ্রেস – বিজেপির একান্ত ঘনিষ্ঠ না হয়ে; সর্বোপরি বিশ্ব পুঁজিবাদের আঙিনায় প্রথম বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির কর্পোরেট বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে একটি ভারতীয় শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীর বিগত ১৫৭ বছর ধরে উত্থান এবং তার অন্যতম কুশীলবের শিল্প – বাণিজ্যের দুনিয়া জুড়ে বিস্তার অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। এখানে আমরা সেটি শুরু করলাম মাত্র।]
টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীর উত্থানঃ ইতিহাস জানাচ্ছে সপ্তম শতাব্দীতে পারস্যে আরব ইসলামি বিজয়ের পর ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে জোরাস্ট্রান ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ ভারতের গুজরাত ও বোম্বাই তে আশ্রয় নেন এবং পার্সি নামে পরিচিত হন। ক্ষুদ্র জনসংখ্যা হলেও তারা শিল্প বাণিজ্যে সফল হন এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা সহ বিভিন্ন জনহিতকর ও উন্নয়নমূলক কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। একইসময়ে বাংলার ব্রিটিশ সহযোগী মুৎসুদ্দি বানিয়া, মহাজন, জমিদার ও বিশিষ্ট শিল্পপতি দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪ – ১৮৪৬) যখন চিনে আফিম রপ্তানি করে ফুলে ফেঁপে উঠে উত্তর কলকাতায় একের পর এক গণিকালয় প্রতিষ্ঠা করছেন এবং বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণ নৈশ মেহফিলে ও পরে বিলেতের হোটেলে ব্যয়বহুল পার্টি ইত্যাদির আয়োজন করে সমস্ত অর্থ উড়িয়ে দিচ্ছেন, তখন একইভাবে চিনে আফিম রপ্তানি করে বিপুল মুনাফা করা পার্সি ব্যাবসায়ী জামশেদজী জিজিবয় (১৭৮৩ – ১৮৫৯) ও তাঁর স্ত্রী বোম্বাই তে হাসপাতাল নির্মাণ ও পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য তখনকার মূল্যের এক কোটি টাকা দান করেন।
পরবর্তী প্রজন্মের আরেক পার্সি ব্যাবসায়ী, শিল্পপতি ও দাতা জামশেদজী টাটা (১৮৩৯ – ১৯০৪) বস্ত্র কারখানা, হোটেল ও চিনে রপ্তানি ব্যাবসায় সফল হয়ে বিখ্যাত ভুতাত্বিক প্রমথনাথ বসুর (১৮৫৫ – ১৯৩৪) পরামর্শে সিংভুমের বিশাল খনিজ ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে সাকচিতে প্রথম স্বদেশী ইস্পাত কারখানা গড়ার উদ্যোগ নেন। জামশেদজী ছিলেন টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীর প্রথম চেয়ারম্যান (১৮৬৮ – ১৯০৪)। গোষ্ঠীর পরবর্তী চেয়ারম্যান জামশেদজীর জ্যেষ্ঠ পুত্র দোরাবজী টাটার সময়ে (১৯০৪ – ‘৩৪) ১৯০৭ এ টাটার ইস্পাত কারখানাটি (টিসকো, ২০০৫ থেকে টাটা স্টিল) গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বাধার মধ্যে ১৯১১ থেকে পিগ আয়রন এবং ১৯১২ থেকে ইস্পাত উৎপাদন শুরু হয়। ১৯১৯ এ সাকচির ইস্পাত কারখানাটিকে ঘিরে উদীয়মান নগরীর নাম হয় জামশেদপুর। দোরাবজীর পর চেয়ারম্যান হন তাঁর পিসতুতো ভাই নাওরজি সাকতাওয়ালা (১৯৩২ – ‘৩৮), তারপর দোরাবজীর খুড়তুতো ভাই জে আর ডি টাটা (১৯৩৮ – ‘৯১)।
দক্ষ পাইলট জে আর ডি – র হাত ধরে ১৯৩২ এ প্রথম স্বদেশী টাটা এয়ারলাইনসের সুচনা। ১৯৪৬ এ এটির নামকরণ হয় এয়ার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল। পরে ১৯৫৩ তে ভারত সরকার এটি অধিগ্রহণ করে। নাম হয় এয়ার ইন্ডিয়া। ১৯৪৫ এ জামশেদপুরে প্রথম স্বদেশী লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরি করে টেলকো। ১৯৫৪ থেকে সেখানে মার্সিডিজ – বেঞ্জের সাহায্যে প্রথম স্বদেশী ভারী ট্রাক তৈরি শুরু হয়। ২০০৩ থেকে টেলকোর নাম হয় টাটা মোটরস। এরপর জামশেদপুর ছাড়াও পন্থনগর, লখনউ, সানন্দ, ধারওয়ার ও পুনেতে এবং বিদেশে ইউরোপ সহ ছটি দেশের কারখানায় ট্রাক ছাড়াও বাস, ভ্যান, এস ইউ ভি, যাত্রীবাহী ছোট গাড়ি উৎপাদন হতে থাকে। ততদিনে খাদ্যের অঙ্গাঙ্গী লবণ থেকে গৃহ আচ্ছাদনের মেটালিক শিট, নিত্য প্রয়োজনীয় কোদাল – বেলচা – বালতি থেকে পর্দা – ঘড়ি – গয়না প্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যের সঙ্গে টাটা ব্র্যান্ডের নাম, উৎকর্ষ ও বিশ্বাসযোগ্যতা তামাম ভারতীয়র মননের গভীরে পৌঁছে গেছে। এর সঙ্গে টাটা সংস্থায় কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা এবং বিভিন্ন সমাজকল্যাণ প্রকল্পে উদার দাতা হিসাবে পুঁজিবাদী শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠী এক ব্যাতিক্রমী সুনাম, ঐতিহ্য ও পরম্পরার জন্ম দিল। এর সঙ্গে সঙ্গে টাটাদের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স (IISc), টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার (TMC), টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR) প্রভৃতি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণার উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলিও গড়ে ওঠে।
টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীর রতনঃ জামশেদজী টাটার কনিষ্ঠ পুত্র রতনজী টাটা নিঃসন্তান ছিলেন। বৃহৎ পরিবারের মধ্যে থেকে নাভাল টাটাকে দত্তক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। নাভাল টাটা ও সুনি কমিশারিয়েটের সন্তান রতন নাভাল টাটা। রতনের পর জন্মায় তাঁর ভাই জিমি টাটা। রতনের যখন ১০ বছর বয়স তখন তাঁর পিতা মাতার বিচ্ছেদ হয়। এটি বালকের মধ্যে এমনই ক্ষত সৃষ্টি করেছিল যে তিনি সারাজীবন অকৃতদার রইলেন। রতনের সৎমাতা সিমোনে নাভাল (টাটা)-র একটি পুত্র হয় – নোয়েল টাটা। বম্বেতে জন্মানো রতনকে কার্যত মানুষ করেন তাঁর ঠাকুমা রতনজী টাটার স্ত্রী নভজভাই শেট (টাটা)। রতনের শিক্ষা বম্বের ক্যাম্পিয়ন এবং ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন কোনান স্কুলে, তারপর সিমলার বিশপ কটন স্কুলে। স্নাতক হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যু ইয়র্কের রিভারডেল কাউন্টি স্কুল থেকে ১৯৫৫ তে। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক হয়ে ১৯৬২ তে পারিবারিক টাটা গ্রুপে কর্মজীবন শুরু করেন।
টিসকোর জামশেদপুর কারখানার একদম শপ ফ্লোর স্তর থেকে উঠে এসে তিনি ১৯৭০ এ টাটা গ্রুপের নেলকোর ম্যানেজার হন। নেলকোর উন্নতি ঘটান, যদিও পরবর্তীতে নেলকোকে সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। এখন নেলকো একটি শীর্ষস্থানীয় স্যাটেলাইট পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা। এরপর রতন টাটা হাভারড ম্যানেজমেন্ট স্কুল থেকে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম করে জোন্স অ্যান্ড এমন্স আরকিটেকচার সংস্থায় যোগ দিয়ে লস এঞ্জেলসে থিতু হন। কিন্তু তাঁর ঠাকুমার ডাকে দেশে ফিরে এসে টাটা গ্রুপের কাজে যুক্ত হন। ১৯৯১ তে টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীর মূল দুটি সংস্থা টাটা গ্রুপ ও টাটা সন্স এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তী চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রির অপসারণের পর্যায়ে তিনি পুনরায় টাটা গ্রুপ ও টাটা সন্স – র চেয়ারম্যান (অন্তর্বর্তী)এর দায়িত্ব পালন করেন। তারপর নির্বাচিত চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখর কে দায়িত্ব অর্পণ করেন। আমৃত্যু টাটা গ্রুপ ও টাটা সন্স – র এমেরিটাস চেয়ারম্যান এবং স্যার দোরাবজী টাটা ট্রাষ্ট এবং স্যার রতনজী টাটা ট্রাষ্ট – টাটাদের দুটি প্রধান দাতা সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৯১ তে রতন টাটা যখন টাটা গোষ্ঠীর দায়িত্বভার নেন তখন টাটার অধীনস্থ স্বায়ত্বশাসন পাওয়া সংস্থাগুলির প্রধানদের তরফ থেকে জোরালো বাধা আসে। কারণ রতন টাটা অধীনস্থ সমস্ত সংস্থাগুলির কর্তাদের মূল গ্রুপ অফিসে ব্যাবসার অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত রাখা, সংস্থাগুলির মুনাফার একটা অংশ টাটা ব্র্যান্ডিং ও সমাজ কল্যাণে ব্যয় করা, সব পদে অবসরের বয়স নির্দিষ্ট করা প্রভৃতি সংস্কারগুলির সঙ্গে প্রতিভাবান তরুণদের তুলে আনা, নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছিলেন। নিজে সংস্থাগুলির জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন; সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থাকতেন; পরিস্থিতি বুঝতে ও কর্মীদের উৎসাহ দিতে শপ ফ্লোর অবধি চলে যেতেন। প্রচার বিমুখ ছিলেন। মুম্বাই এর একটি মাঝারি মানের ফ্ল্যাটে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। অন্যদিকে ১৯৯১ তে তিনি যখন টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীর হাল ধরলেন তখন ভারতীয় অর্থনীতি উদারীকরণ ঘটিয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির অঙ্গে সংপৃক্ত হতে শুরু করায় ব্যাবসার সমূহ পতনের বিপদ ছিল। পাশাপাশি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাবসাকে বাড়ানোর সুযোগও ছিল। আমরা দেখতে পেলাম সমস্ত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে রতন টাটা এমন এক শিল্প – বাণিজ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন যা রূপকথাকে হার মানায়।
রতন টাটার শিল্প – বাণিজ্য সাম্রাজ্যঃ একটি পরিসংখ্যান বলছে তিনি যখন ১৯৯১ তে সংস্থার চেয়ারম্যান হন তখন টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠীর মূল্য ছিল চার বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলার। ২০১২ তে তিনি চেয়ারম্যানের পদ ছাড়ার সময় মূল্যায়ন দাঁড়ায় ৭৭ বিলিয়ন বা ৭৭০০ কোটি ডলার। ২০২৪ এ এমেরিটাস চেয়ারম্যান হিসাবে চলে যাওয়ার সময় দাঁড়ায় ৪০০ বিলিয়ন বা ৪০ হাজার কোটি ডলার। তাঁর নেতৃত্বে ১০০ – র বেশি সংস্থা ১০০ – র বেশি দেশে ব্যাবসা করছিল। ২০২৩ – ‘২৪ আর্থিক বর্ষে সংস্থার আয় ছিল ১৬৫ বিলিয়ন বা ১৬৫০০ কোটি ডলার। তাঁর সময়ে ইউরোপ, ভারত ও দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার উৎপাদন কেন্দ্রগুলি মিলিয়ে টাটা স্টিল বিশ্বের সবচাইতে বৃহৎ ইস্পাত নির্মাণ সংস্থা। তাঁর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় নেমেও টাটা সফল। বর্তমানে টাটা গ্রুপের লাভ্যাংশের অর্ধেকের বেশি আসে টাটা কনসাল্টিং সার্ভিস (TCS) থেকে। ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত হয়েছে টাটার ২৭ টিরও বেশি বড় সংস্থাঃ (১)Tata Steel, (২)Indian Hotels, (৩)Tata Chemicals, (৪)Tata Motors, (৫)Tata Power, (৬)TCS, (৭)Tata Elxsi, (৮)Tata Energy, (৯)Tata Communication, (১০)Tata Consumer Products, (১১)Titan, (১২)Voltas, (১৩)Tata Coffee, (১৪)Tata Investment, (১৫)Jaguar Land Rover, (১৬)Tata Autocomp Systems Ltd., (১৭)Trent, (১৮)Nelco, (১৯)Tata Advanced System, (২০)Tata Dawoo, (২১)Tata Hispana, (২২)Tata Hitachi Construction Machinery, (২৩)Tata Housing, (২৪)Tata Metaliks, (২৫)Rallis India, (২৬)Tata Housing, (২৭)Tata Capital ইত্যাদি। এছাড়াও বিনিয়োগ করেছিলেন Snapdeal, Tata CLiQ, Tata Neu, Teabox, CashKaro, Ola Electrics, Xiaomi, Nestaway, Zenify, Paytm, CarDekho, Urban Company, FirstCry, Zivame, Urban Ladder, Abra, Lenskart প্রভৃতি ৪০ টির বেশি স্টার্ট আপ কোম্পানিতে। তাঁর সময়ে টাটা শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠী বৃহৎ ভারতীয় শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠী থেকে হয়ে গেল বিশ্বময় শিল্প ও বাণিজ্য করা একটি বৃহৎ ভারতীয় শিল্প – বাণিজ্য গোষ্ঠী।
তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৮ এ টাটা মোটরস তৈরি করল প্রথম স্বদেশে তৈরি ডিজেল চালিত গাড়ি টাটা ইন্ডিকা এবং ২০০৮ এ সাধারণের সাধ্যের মধ্যে মাত্র এক লাখ টাকা মূল্যের স্বপ্নের গাড়ি টাটা ন্যানো তৈরির কাজ শুরু হল। এই দুটি প্রকল্প যথাক্রমে প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে ধাক্কা খেলেও পরবর্তীতে টাটা – সুমো, সাফারি, স্করপিও, পাঞ্চ, নেক্সন, হ্যারিয়ার প্রভৃতি এস ইউ ভি সেক্টরে টাটা সফল। টাটা – তিয়াগো ও অ্যালট্রজ হ্যাচব্যাক মডেল; টাটা টাইগর সাব কম্প্যাক্ট সেডান জনপ্রিয়তা পায়। এরপর টাটা মোটরস ২০১৯ থেকে প্রস্তুত করতে শুরু করে প্রথম স্বদেশে প্রস্তুত ইলেকট্রিক গাড়ি নেক্সন ইভি, পাঞ্চ ইভি, টাইগর ইভি সিরিজ। এছাড়াও যৌথভাবে তৈরি করতে থাকে Tata Dawoo ট্রাক; Tata Marcopolo Bus; Tata Hispana, Tata Fiat, Tata Hundai গাড়ি। ইতিমধ্যে ২০০৮ এর মহামন্দায় মার্কিন বৃহৎ অটোমোবাইল সংস্থা ফোরডের দেউলিয়া হওয়ার মুখে ২.৩ বিলিয়ন ডলারে রতন টাটা কিনলেন ফোরডের ব্রিটেন কেন্দ্রিক দুটি আইকনিক ব্র্যান্ড – জাগুয়ার এবং ল্যান্ড রোভার। ২০০০ এ অধিগ্রহণ করেছিলেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদন কোম্পানি টেটলি কে। ২০০৭ এ অধিগ্রহণ করেছিলেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্রিটিশ – ডাচ ইস্পাত সংস্থা কোরাস কে ১৩ বিলিয়ন ডলারে। তাঁর এরকম প্রায় ৬০ টি অধিগ্রহণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেয়ু, সেন্ট জেমস কোর্ট, ব্রিটিশ সল্ট, এইট ও ক্লক, ন্যাটস্টিল, টাইকো। ব্রিটেনের সবচাইতে বেশি সংখ্যক কর্মী কাজ করেন টাটার সংস্থাগুলিতে। দেশ বিদেশে সব মিলিয়ে কর্মীর সংখ্যা ১০ লক্ষের বেশি। ভিস্তারা ও এয়ার এশিয়া ইন্ডিয়া আগেই নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছিল, এরপর ২০২২ সালে ১৮০০০ কোটি টাকায় ভারত সরকারের থেকে কিনে নেওয়া হল ধুঁকতে থাকা এয়ার ইন্ডিয়াকে। গুজ্ররাতের ভাদোদরায় এয়ারবাসের সঙ্গে টি এ এস এল Air – 295 মালবাহী যুদ্ধ বিমান তৈরির এবং অসমের মরিগাঁও তে টি ই পি এল এর সেমিকন্ডাক্টার চিপ তৈরির কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
দেশহিতৈষী দানশীল রতন টাটাঃ রতন টাটা দিল্লির শিখ বিরোধী দাঙ্গা, মুম্বাই এর তাজমহল হোটেল হামলা, কোভিড অতিমারি বিভিন্ন সংকটের সময় আক্রান্ত এবং সাধারণ মানুষের পাশে উদার হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গ্রামীণ উন্নয়নে বিপুল পরিমান দান করেন। দরাজ হাতে দান করেন দেশ বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়কেই দিয়েছিলেন ৫০ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি ডলার এবং সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন Tata Innovation Center। আই আই টি মুম্বাই কে দিয়েছিলেন ৯৫ কোটি টাকা এবং সেখানে গড়ে তুলেছিলেন Tata Centre for Technology & Design (TCTD)। ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতেও স্থাপন করেন TCTD। IISc তে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ব মানের Indian Centre for Neuro Science। Tata Memorial Hospital, Mumbai (TMH) এর উন্নত্ মানের ক্যানসারের চিকিৎসা কে সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। পশুদের কল্যাণে Dog Spot এবং বয়স্কদের জন্য Good Fellows পোর্টাল নির্মাণ করেন। দেশ বিদেশের বহু নামী প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত বোর্ড সদস্য ছিলেন। পেয়েছেন পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সহ দেশ বিদেশের বহু সম্মাননা। তাঁর যা কিছু ব্যক্তিগত সম্পদ উইল করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দান করে গেছেন।










