শীতের ভোর। অল্প কুয়াশার আস্তরণ পৃথিবীর ওপর ছড়িয়ে আছে। আধবুড়ো মানুষটা একটা গ্যারেজের শেডের নীচে ঘুমিয়ে ছিলো। উঠে বসে। ঠান্ডার কামড়টা ভোর বেলায় বেশী থাকে। গা ঢাকা দেওয়া চাদরটা ভালো করে শরীরে পেঁচিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিহারের শেষ ডিসেম্বর বড্ড ঠান্ডা। একটু চা পেলে হতো। বহুদিনের বেড টি’র অভ্যেস।
আধবুড়ো লোকটা মাথার তলা থেকে নাইকির জুতো জোড়া বার করে’ পায়ে গলিয়ে ন্যায়। পকেট হাতড়ে একটা চ্যাপ্টানো সিগারেট বার করে আগুন ধরায়। প্রায় অন্ধকার ভোরে দেশলাইএর আগুন ওর পাকা দাড়ি কোঁচকানো চামড়ার মুখটা পরিস্কারভাবে দেখা যায়। চোখ দুটো উজ্জ্বল । দেখা যাক কোনও চায়ের দোকান পাওয়া যায় কিনা – বুড়ো ভাবে। আবার একদিনের টানা হাঁটা।
শূন্য রাস্তায় কিছু দূর হাঁটতেই দেখা যায় একটা দোকানে উনুন ধরাচ্ছে। নিশ্চয়ই চা পাওয়া যাবে।
সামনের গলি থেকে কয়েকজন বেরিয়ে আসে – “এ কওন বা রে?”
লোকটা তাকিয়ে দেখে ফেজ টুপি পরা সোয়েটার চাদরে ঢাকা তিন চার জন মানুষ। লোকটা নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয় “রমজান আলী – কলকাতাসে”
এরপর দ্বিতীয় প্রশ্ন আসবে। আসবেই। দীর্ঘ পথযাত্রার অভিজ্ঞতায় এটা লোকটা জানে। ও দাঁড়িয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে অপেক্ষা করে। মহামারী আর ভয়ঙ্কর জাতিদাঙ্গা দেশের মানুষকে দুটো আলাদা ভাগ করে দিয়েছে। কতো কোটি মারা গেছে কেউ জানে না। খবরের কাগজ টিভি একই খবরের পুনরাবৃত্তি করছে অবিশ্বাস আর ভয়ের বাতাসে ট্রেন বাস সব বন্ধ। কারো গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সাহস নেই।
ধোঁয়া ছেড়ে লোকটা বলে যায় “বাপজান রওশন আলী … বর্ধমান বাবুরবাগসে আয়েঁ হ্যায় … বেটাকো ঢুন্ডনে ..” লোকটার চোয়াল শক্ত হয়
“সাজ্জাদ… উসকা কোঈ পতা নেহি .. অব যাঁউ ? থোড়া চায়ে পীনা হ্যায় .. বহৎ থকে হুয়ে ….”
“আল্লাহ মেহেরবান তেরা বেটা ঠিক্কেহি হ্যে …”
“শুকর করো ভাই …আদাব” লোকটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। চারপাশে কেউ নেই শুধু শূন্যতা। একটা ফাঁকা পুরোনো বাড়িতে দেওয়াল চিরে অশত্থের পাতা আকাশ দেখছে। নির্মল আকাশ। লোকটা বসে রুকস্যাক থেকে সুগার মাপার যন্ত্র বার করে’ আঙ্গুলে ফোটায়।
“আপ বীমার হ্যে?”
লোকটা হাসে “মেরা সুগার কা বিমারী…”
“পড়ে লিখ্যে হ্যো?”
“থোড়া বহৎ”
দোকানী চা এগিয়ে দ্যায়।
“দুটো বিস্কুট দিজিয়ে”
আকাশ চিরে একপাল টিয়া চিৎকার করে করে চলে যায়। সামনের গাছে দুটো কাঠঠোকরা টটটটটটট করে ঝগড়া করে। লোকটা সাবধান হয়। এর আগে একবার ওর সব টাকাকড়ি আর একবার আঙ্গুলের একটা আংটি ছিনিয়ে নিয়েছে। এখন পকেটে সামান্য টাকা রাখে। পথ হাঁটার প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেছে। ওকে ওর সন্তানের কাছে পৌঁছতেই হবে।
ব্যাগে শুগারের যন্ত্রটা ঢুকিয়ে ওষুধের কৌটো বার করে “থোড়া পানি” দোকানদার সামনের কলটা দেখিয়ে দ্যায়। লোকটা আঁজলা ভরে জল খায় – মুখে চোখে দ্যায়। তারপর বোতলটা ভরে আবার হাঁটতে শুরু করে। খাগারিয়া সমস্তিপুর হাজিপুর মুজফ্ফরপুর। কোনটা আগে কোনটা পরে সব গুলিয়ে গেছে। একটা গাছের তলায় এসে বসে। এক ঢোঁক জল মুখে দেয়। মোবাইল ফোন খুলে দেখে ন্যায় কোথায় আছে। চার্জ ফুরিয়ে এসেছে। সামনে কোনও রেল স্টেশন পেলে চার্জে বসাতে হবে। আমেরিকা থেকে সব দেশেই জাতিদাঙ্গা চলছে। কোথাও ধর্ম কোথাও বর্ণ। মহামারী মানুষকে আদিম স্তরে নামিয়ে এনেছে। হত্যার নেশা – সবাইকার রক্তে হত্যার নেশা জেগে উঠেছে। লোকটা মানি ব্যাগ খুলে দেখে ন্যায় কতো টাকা আছে। ফুরিয়ে গেলে আবার টাকা তুলতে হবে। শরীর আর চলছে না। ও বোতলটা শেষ করে ফ্যালে। চারপাশে তাকায় কে জানে আবার কোথায় একটা জলের কল পাওয়া যাবে? লোকটা ভাবা ছেড়ে দিয়েছে। ওকে পৌঁছতেই হবে ওর সন্তানের কাছে। আবার উঠে পড়ে। কোত্থাও কোনও লোক নেই। মৃত্যুপুরি। সত্যজিতের একটা বই ছিলো না – হত্যাপুরি? এ্যাতো দুঃখেও লোকটা একটু হাসে।
দুপুর যখন লী লী করছে যখন সূর্য তার শীতের রোদ বিছিয়ে দিয়েছে লালচে পাথুরে মাটির ওপর তখন আবার কিছু লোকের দেখা পায়। এরা আবার অন্য মানুষ। অন্য ধর্ম।
“কওন বা?” একই প্রশ্ন চলতে থাকে। উত্তরগুলো শুধু দুএকটা মাত্র বদলে বদলে যায়। বরেন ঘোষ – কলকাতাসে – সৌকালিন গোত্র পিতা খগেন ঘোষ বেটা বিজন ঘোষ….” লোকটা পুরি সবজি খেয়ে পুকুরে স্নান করে করে আবার চলতে থাকে।
এই দেশটা ওর চেনা হয়ে গেছে। বাঁচতে হলে যেখানেই যাবে শুধু পরিচয়টা বদলে দিলেই বাঁচতে পারবে। ও আত্মজের সন্ধানে দেশ জুড়ে খুঁজতে থাকে।