এই ক্ষুদ্র তুচ্ছ চিকিৎসক জীবনে আমি যে একটা প্যানডেমিক দেখে যেতে পারব, এবং সেই প্যানডেমিকের সময়েও কাজ করতে পারব, স্বপ্নেও ভাবিনি। যদি মহামারী শেষে বেঁচে থাকি, তাহলে এই সময়টা সারাজীবনের এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়ে থেকে যাবে।
আজ আমার প্রথম পোস্টিং খড়গ্রাম হাসপাতালের গল্প শোনাতে ইচ্ছে করছে। ২০০৮ সালে খড়গ্রাম হাসপাতালে যখন যোগ দি, তখন বার্ড ফ্লুর সিজিন চলছে। এবং সেবারের মুরগীদের বার্ড ফ্লু পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ধরা পড়েছিল এই খড়গ্রামেই। সকালে যখন কালিং টিমের সদস্যরা পিপিই পরে মুরগী মারতে যেত, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ওষুধ খাওয়াতাম। ফেরার পরে আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
সে সময় বয়স কম ছিল। কোনও দিনও সিরিয়াস ভাবে ভেবে দেখিনি এই বার্ড ফ্লু মানুষের ছড়িয়ে পরলে কি হতে পারে। উল্টে তখনও আমার রান্নার দিদির পোষা হাঁস গুলোকে আদর করেছি, খাওয়া শেষ করে তাদের নিজের থালাতেই খেতে দিয়েছি। আসলে মহামারী সম্পর্কে কোনও ধারণাই তখনও ছিল না।
মহামারী যে কি বুঝলাম কয়েকদিন পরে। খড়গ্রাম ব্লকে শনিগ্রাম বলে একটি গ্রাম আছে। তার পাশেই আর একটি গ্রাম। কয়েকঘর আদিবাসী মানুষ বসবাস করেন। খবর এলো সেখানে এনকেফালাইটিসের মতো একটি রোগে পরপর ছয়জন মারা গেছেন।
এসিএমওএইচ এর নির্দেশে সেখানে হেলথ ক্যাম্প করতে যেতে হবে। জ্বরের রোগী থাকলে তাদের তথ্য আনতে হবে। আউটডোর শেষ করে কিছু ওষুধপত্র নিয়ে সরকারি জীপে রওনা দিলাম। প্রফুল্লদা জীপ চালাচ্ছে।
জীপটা অন্তত পঞ্চাশ বছরের পুরনো। চললে যা ঝাঁকুনি হয়, বয়স্ক লোকের ভার্টিব্রাল ডিসলোকেশান হয়ে যাবে। কিন্তু গ্রামের রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে খুব কার্যকরী। নদী বাঁধের উপর দিয়ে গর্তে ভরা রাস্তায় এই গাড়ি ছাড়া গতি নেই।
অবশেষে দ্বারকা নদীর বাঁধের উপর এক নির্জন স্থানে প্রফুল্লদা জীপ থামাল। বলল, ‘এবার নদী ধরে হেঁটে যেতে হবে।’
ওষুধের বাক্স প্রফুল্লদার মাথায়। আমার কাঁধের ব্যাগে টুকটাক ডাক্তারি পরীক্ষার জিনিস পত্র। বেশ কিছুক্ষণ শুকনো নদীখাত ধরে হাঁটার পরে অন্যপারে এলাম। আরও কিছুক্ষণ হেঁটে গ্রামে পৌঁছলাম।
পরপর কয়েকটা মাটির বাড়ি। একটাই বাড়িরই শুধু ইটের দেওয়াল, এসবেস্টসের চাল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।
প্রফুল্লদা ওষুধের বাক্স একটা বটগাছের গোড়ায় নামিয়ে রাখল। তারপর বাড়িগুলোতে একটু উঁকি ঝুঁকি মারল। ফিরে এসে বলল, ডাক্তারবাবু, সবাই রোগের ভয়ে পালিয়েছে।
সেই খাঁ খাঁ ভৌতিক গ্রামের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুঝেছিলাম, মহামারী ঠিক কি জিনিস। আণুবীক্ষণিক জীবের সামনে মানুষ কতটা অসহায়। জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরদোর ছেড়ে, জমির শস্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষ স্বেচ্ছায় দেশান্তরি হয়।
সেই প্রথম মহামারীকে ভয় পেতে শিখলাম।
খড়গ্রামে চাকরিতে জয়েনিং এর প্রথম দিনেই আরও একটা জিনিসকে চিনেছিলাম। সেটা হল খিদে। চিনিয়েছিল একজন সিনিয়র দাদা। যার বদলি হয়ে আমি ওখানে গেছিলাম।
খড়গ্রাম মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমার একটি গ্রাম। এখানে প্রতি বছর বন্যা হত। বলা ভাল বন্যা করা হত। ম্যাসাঞ্জোর থেকে জল ছাড়লেই শঙ্করপুর, সাদল এই সব অঞ্চলে দ্বারকা নদীর বাঁধ কেটে দেওয়া হত। কারা কাটত? যাদের বন্যা হলে লাভ হয়। যাদের হাত দিয়ে বন্যা ত্রাণের টাকাটা খরচ হয়। বন্যা বন্ধের জন্য ‘কান্দি অ্যাকশন প্লান’ কার্যকরী হওয়ার পর এখন আর বন্যা বিশেষ হয় না।
এই ঘটনাটা আমি আগেও শুনিয়েছি। সেই সিনিয়র দাদার জবানবন্দীতেই আরেকবার শোনাই।
“সাত সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বিএমওএইচ জানাল সাদলে মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে হবে। ওদিকে হেব্বি বন্যা হয়েছে। গ্রাম জলের তলায়। বাঁধের উপর সব লোকজন আশ্রয় নিয়েছে।
কিছুটা পথ প্রফুল্লদার জিপে গিয়ে আমি নৌকায় উঠলাম। প্রফুল্লদা দেখি নৌকাতে সারি সারি বোতল ভর্তি সাদা ফিনাইল তুলছে।
‘কি ব্যাপার প্রফুল্লদা, এত ফিনাইল নিয়ে কি হবে?’
‘আজ্ঞে স্যার, বিএমওএইচ ম্যাডাম বললেন প্রচুর ফিনাইল পরে রয়েছে, নিয়ে যেতে।’
আসলেই আমাদের হাসপাতালে অফুরন্ত ফিনাইল। জেলাতে ওষুধ চাইলে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না, রেবিস ভ্যাকসিন যা দরকার মিলছে তার দশ ভাগের একভাগ। কিন্তু না চাইতেই ফিনাইল পাওয়া যাছে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে ‘মানকচু’ নাকি বত্রিশ কোটি টাকার(!) ফিনাইল কিনেছে।
যাই হোক প্রচুর পরিমাণে ফিনাইল আর অল্প পরিমাণে সেপট্রান আর প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাঁধের কাছাকাছি পৌঁছলাম। সেখানে তখন অগুনতি মানুষের ভিড়।
নৌকা কাছাকাছি আসতেই চিৎকার শুনলাম, ‘ওরে হাসপাতাল থেকে বাচ্চাদের দুধ পাঠিয়েছে রে…’
কিছু লোক জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং মুহূর্তের মধ্যে ফিনাইলের বোতল গুলি লুঠ হয়ে গেল।
আমি তখন পাগলের মত নৌকায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছি, ‘ওগুলো দুধ না। ওগুলো ফিনাইল। কেউ খেও না।’
সাথে সাথে খিস্তির বন্যা বয়ে গেল…’ তিনদিন ধরে বাচ্চাগুলোর পেটে এক ফোঁটা দুধ পড়েনি। আর তুই শালা বো+++ ফিনাইল নিয়ে ++ মারতে এসেছিস।’”
এরপর দাদাটি আমাকে বলল, ‘সত্যি বলছি ঐন্দ্রিল, আমার নিজেকে তখন ওই গালাগালির যোগ্য বলেই মনে হচ্ছিল। পেট ফোলা, কাঠি কাঠি হাত পায়ের বাচ্চা গুলোর সামনে সেপট্রান আর প্যারাসিটামল হাতে নিজেকে সার্কাসের ক্লাউন মনে হচ্ছিল। যদি তুই কখনও বন্যাতে যাস নিজের পয়সায় এক দু বস্তা মুড়ি কিনে নিয়ে যাস। প্যারাসিটামল ট্যাবলেট না দিয়ে বরঞ্চ বাচ্চাগুলোকে একমুঠো করে মুড়ি দিস।’