১০.১০.২০২৪
১১৭. মহালয়ার দিন কলকাতায় হলো মহা-মিছিল। কলেজ স্কোয়ার থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো হয়ে ধর্মতলা অব্দি পদযাত্রা- তাতে সামিল কমপক্ষে ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। কার্যত সেন্ট্রাল এভিনিউ স্তব্ধ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ আওয়াজ তুলেছে বিচারের দাবিতে। কলকাতার বুকে যে কত প্রকারের সংগঠন রয়েছে, এই মিছিলে না এলে বুঝি জানা যেত না!! মিছিল শেষ হলো ধর্মতলায় মহাসমাবেশের মাধ্যমে। বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন, সমাজসেবামূলক সংগঠন তাদের মতামত রাখলো। জুনিয়র ডাক্তারেরা জানিয়ে দিল, নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে তারা নিজেদের জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত- পরবর্তীতে কী আস্তে চলেছে সেটা খুব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। তবে মহাসমাবেশে একটাই ছন্দপতন হয়- যে আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের স্থান হয়নি, শুধু ‘গো ব্যাক’ শোনা গেছে- সেই আন্দোলনের মঞ্চেই মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন ডা. বিপ্লব চন্দ্র, যিনি আসলে রাজনৈতিক ভাবে এসইউসিআই দলের সঙ্গে যুক্ত। যদিও উনি নিজের রাজনৈতিক পরিচয়ে বক্তব্য রাখেননি, তবুও এই নিয়ে বিরাট সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
১১৮. আন্দোলন একটা ফিরে না আসার পর্যায়ে চলে গেছিলো, সরকারও অনড়। এদিকে কর্মবিরতিও আর টানা উচিত নয়- পরবর্তী পদক্ষেপ তাহলে কী!! এই নিয়ে সব কলেজে জিবি মিটিং হয়। এই ধাপটাই আন্দোলনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ধাপ ছিল, কারণ আমাদেরই কিছু সদস্য নিজেদের শেষ করে ফেলার স্তরে যেতেও রাজি হয়ে গেছিল। কিন্তু এতদিনের আন্দোলনে মনোমালিন্যের জায়গা, মান-অভিমানের জায়গা, নেতৃত্বের সঙ্গে বাকিদের দূরত্বের জায়গাও একটা তৈরি হচ্ছিল। সব মিলিয়ে সুদীর্ঘ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে সাধারণ অবস্থান মঞ্চ হবে এবং প্রয়োজনে সেখান থেকেই অনশন সভার আয়োজন হবে। যদিও এই অবস্থানের জায়গা বিভিন্ন জায়গায় কালীঘাট বলে ঠিক হয়, তবুও শুধু রাজনৈতিক তর্জা এড়াতে এবং শহরের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় ধর্মতলাই অবস্থান মঞ্চ হিসাবে ঠিক হয়। তবে উল্লেখ্য, এখনো জুনিয়র ডাক্তারদের নেতৃত্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা পুলিশমন্ত্রীর অপসারণের কোনো দাবি তোলেনি- কারণ অজানা।
১১৯. পরদিন সব কলেজের গন্তব্য ছিল এসএসকেএম- কারণ এখান থেকেই মিছিল যাচ্ছিল ধর্মতলার দিকে। কর্মবিরতি কার্যত উঠে গেছে সর্বত্র, পরপর মিছিলে হেঁটে সকলে ক্লান্তও বটে- তবুও শেষ মিছিলে স্লোগানে ভাটা পড়েনি একদমই। তবে এবার শুরু হলো যা আগে কখনো এতটা নির্লজ্জ ভাবে হয়নি। জুনিয়র ডাক্তার আপনকে একা পেয়ে তার উপর শারীরিক অত্যাচার চালালো কলকাতা পুলিশ, জুটলো সিভিক পুলিশের লাথিও। প্রতিবাদে মেট্রো চ্যানেলেই অবস্থানে বসে পড়ি আমরা। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বাদানুবাদের মাঝেই নামে প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টির মাঝেই সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারকে চব্বিশ ঘন্টার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়- যার পরে অনশনের দিকে যেতে বাধ্য হবে জুনিয়র ডাক্তারেরা। এর সাথে সাথে কর্মবিরতি তুলে নেওয়ার ঘোষণাও করা হয়। একটা ঘৃণ্য ঘটনার পঞ্চাশ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও যে সরকারের ঘুম ভাঙেনি, তার ঘুম ভাঙাতে রোগীদের হয়রানি করা যায়না, নিজেদের জীবনই বাজি রাখতে হয় অগত্যা, দধীচির মতো নিজেকে শেষ করে নতুনের স্বপ্ন দেখতে হয়- আর কোনো উপায় থাকে না।
১২০. ৫ই অক্টোবর, দেবীপক্ষের তৃতীয়ার দিন রাত সাড়ে আটটায় আমরণ অনশনে বসলেন ছয় জন ডাক্তার- স্নিগ্ধা হাজরা, তনয়া পাঁজা, সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা, পুলস্ত্য আচার্য্য, অনুষ্টুপ মুখার্জি ও অর্ণব মুখার্জি। সামনে টাঙানো রইলো ঘড়ি- যার প্রতিটা সেকেন্ডের গতি সরকারের গলার কাঁটাটা আরো একটু বেশি করে গেঁথে দিচ্ছিল। ভাগ্যের পরিহাসে তার পাশেই রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ২৬ দিনের অনশনের স্মারক, যে অনশনে স্যান্ডউইচ ও চকোলেট খেয়ে মমতা ব্যানার্জির ওজন আদতে বেড়ে গেছিলো। সেই স্মারকের পাশে এই আমরণ অনশন নিয়তির পরিহাস ছাড়া আর কীভাবে বয়ান করবো জানিনা। ছয় জন ডাক্তারের জীবন বাজি রেখে আন্দোলন মানতে কষ্ট হয়, বেশ কষ্ট হয়। কারণ এই আন্দোলন কোনো একজনের বিরুদ্ধে নয়, সামগ্রিক সামাজিক অবক্ষয়ের এবং সেই অবক্ষয়ে সরকারি মদতের বিরুদ্ধে। কিন্তু যে সমাজের মূল্যবোধই ভেন্টিলেশনে চলে গেছে, তাকে বেদানার রস খাইয়ে বিশেষ লাভ আছে কি!! কিন্তু এরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- শেষ দেখে তবেই ছাড়বে…
১২১. শেষ দেখার অবশ্য অনেক বাকি ছিল। এরপর শুরু হলো সরকারি লেঠেলবাহিনীর দাপট। কখনো তারা অবস্থান মঞ্চ তুলে দেওয়ার জন্য লোক পাঠাচ্ছে, কখনো সেখানে আসার চৌকির গাড়ি আটকাচ্ছে, কখনো বায়ো টয়লেট বসাতে বাধা দিচ্ছে, কখনো বা মঞ্চ বাঁধার বাঁশ আনতেও প্রতিরোধের সৃষ্টি করছে। শাসক তার সমস্ত নখদন্ত বের করে আক্রমণ সেঁধেছে- রাস্তায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, কোর্টে মামলা দিয়ে- যতভাবে সম্ভব। কিন্তু আন্দোলন দমানো যায়নি। অনশনকারীর সংখ্যা বেড়েছে, আরজিকরের অনিকেত মাহাতো যোগ দিয়েছে, নর্থ বেঙ্গলে অনশনে বসেছেন ডা. আলোক ও ডা. সৌভিক। মানুষ পুজোয় মেতেছে হয়তো, কিন্তু একটা বড় অংশের মানুষ ধর্মতলার এই মঞ্চকেই পুজোর গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন- মানুষ জাগছে, সরকার জাগবে কবে!! উত্তরটা সময়ের হাতে তোলা থাক…