একটি স্বপ্নাদ্য ত্রিধারা নাটক
____________
সপ্তমীর রাত্তিরে সামান্য পেট গরম হয়েছিল। তারই তাড়সে সেই রাত্তিরে এক স্বপ্ন দেখলাম। পুরো কোর্ট সিন।
মহা বিজ্ঞ জজ হুজুর- ওই বদমায়েশ আসামি কটা কে একদম শেষে রেখে দিয়েছো তো? সবকটাকে একসঙ্গে তোলো এবার।
পাজি সরকারি কৌঁসুলি – এই যে হুজুর আসামিগণ হাজির।
মবিজহুঃ- কী ধারা দিয়েচ হে?
পাসকৌঁঃ- আজ্ঞে হুজুর, যে সে ধারা নয়, ত্রিধারা। ওই নামের প্যান্ডেলের কাচেই গোল করছিল কী না!
সব আটঘাট বেঁধে করেচি হুজুর। আপনি তো জানেনই পুলিশের কাজ একেবারে যাকে বলে ফুল প্রুফ। এরা প্রমাণ মোছে যখন কেস ঝকঝকে তকতকে পুরো আরজিকর। আবার প্রমাণ বানায় যখন তখন ওই কী বলে স্যার খুঁতটি পাবেন না। সেই নন্দকুমারের সময় থেকে হাত পাকিয়েচে কিনা!
মবিজহুঃ- তা এদের জামিন দিতে হবে নাকি শেষমেশ?
পাসকৌঁঃ-( লজ্জিত ভাবে) আঃ কী যে বলেন মি লর্ড। সেই কবে থেকে কেস সাজাচ্চি। বললামই তো, সব কটাকে ন্যায় সংহিতার ত্রিধারার কেস দিয়ে দিইচি।
মবিজহুঃ- ওভাবে ত্রিধারা বললে হবে না। ধারার নম্বর বলো। কত নম্বর?
পাসকৌঁঃ- হুজুর, সে আমরা ন্যায় সংহিতার একটা স্পেশাল অ্যামেন্ডমেন্ট করে নিইচি লোকালি। আমাদের হার হাইনেসও ওই কী বলে, বেজায় টুকে-পাস-আইনজ্ঞ কী না। ম্যাডামের লেকচার শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে ধারার নাম দিইচি ইস্পেশাল ভৌ ভৌ ধারা। খামোকা ভৌ ভৌ কল্লেই ক্যাচ কট কট। সিভিক রুলের দুচ্চারটে গুঁতো। আর একেবারেই নন বেলেব্ল্ স্যার। এই ধারাটা সেটিং-দাদাকে বলে পার্লামেন্টেও পাশ করিয়ে নেব স্যার।
মবিজহুঃ- ঠিকাচে ঠিকাচে। এবার বলো, কী করেচিল এই পাজিগুলো?
পাসকৌঁ- (লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে) সে কথা আপনার সামনে এই পাপ মুখে আনতেও সঙ্কোচ হচ্চে হুজুর। দারুণ অশ্লীল ভাবে ওরা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে বলছিল, উই ওয়ান্ট জাস্টিস! এই যে মি লর্ড, পেজ নাম্বার থিরিতে লিখিচি।
মবিজহুঃ- (কাগজটা এক চোখ দেখে) এ কী হে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে এট্টু বরফ চাইছিল বলে কেস দিয়ে দিলে?
পাসকৌঁঃ- (একটু অপ্রস্তুত হয়ে কাগজ ফেরত নিয়ে) কই দেখি দেখি!(কাগজ দেখে নিয়ে) এঃ হে হে। বড়ই ভুল টাইপ করেছে টাইপের ছোঁড়াটা। ওর দোষ নেই হুজুর। এই এদেশের শিক্ষার হাল তো এমনই। নইলে WE WANT JUSTICE কে JUST ICE কেউ লেখে? উই ওয়ান্ট জাস্ট আইস, হ্যাঃ।
মবিজহুঃ- তা ভাবলে কিন্তু মন্দ লেখেনি। এই যে আমি দিন কতক হেফাজত দোবো, তা তো বিচার না দিয়ে জাস্ট আইসই দিলাম, না কি? তা হ্যাঁ হে, ও পক্ষের সাক্ষী আছে নাকি কেউ।
বিপক্ষের উকিল- আছে স্যার। এই যে ইনি।
নিপাট ভদ্রলোক গোছের ভীতু এক সাক্ষী কাঠগড়ায় উঠল।
মবিজহুঃ- আপনি কী জানেন বলুন তো। বেয়াদব আসামিরা এত চেঁচাচ্ছিল কেন?
ভীতু সাক্ষীঃ- আজ্ঞে হুজুর বলি। আমি স্যার একটা সদ্য উঠে যাওয়া বাংলা ইশকুলের সংস্কৃত মাস্টার।
পাসকৌঁঃ- আঃ, ভ্যানতারা না করে যা বলার আছে বলে ফেলুন।
ভীতু সাক্ষীঃ- (কিঞ্চিৎ থতোমতো খেয়ে এক নিঃশ্বাসে হড়বড় করে বলতে লাগল)
পুজোর তিথিতে ওরা কজন মিলে হুজুর দুগ্গাকে ডাকার মন্ত্র বলছিল আজ্ঞে। মন্তরটা বলি?
মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃবরদে নমঃ।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
মহিষাসুর-নির্ণাশি বিধাত্রি বরদে নমঃ।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
ধূম্রনেত্রবধে দেবী ধর্ম্মকামার্থ-দায়িনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
রক্তবীজবধে দেবি চণ্ড-মুণ্ড-বিনাশিনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
নিশুম্ভশুম্ভনির্ণাশি ত্রৈলোক্যশুভদে নমঃ।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
বন্দিতাঙ্ঘ্রিযুগে দেবী সর্ব্বসৌভাগ্যদায়িনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
অচিন্ত্যরূপচরিতে সর্ব্বশত্র“বিনাশিনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
নতেভ্যঃ সর্ব্বদা ভক্ত্যা চাপর্ণে দুরিতাপহে।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
স্তুবদ্ভ্যো ভক্তিপূর্ব্বং ত্বাং চণ্ডিকে ব্যাধিনাশিনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
চণ্ডিকে সততং* যুদ্ধে জয়ন্তি পাপনাশিনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবী পরং সুখং।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
বিধেহি দেবী কল্যাণং বিধেহি বিপুলাং শ্রিয়ম্।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
বিধেহি দ্বিষতাং নাশং বিধেহি বলমুচ্চকৈঃ।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
বিদ্যাবন্তং যশস্বন্তং লক্ষ্মীবন্তঞ্চ মাং কুরু।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
দেবী প্রচণ্ডদোর্দ্দণ্ড-দৈত্যদর্পনিসূদিনি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
চতুর্ভুজে চতুর্ব্বক্ত্র-সংস্তুতে পরমেশ্বরি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
কৃষ্ণেন সংস্তুতে দেবী শশ্বদ্ভক্ত্যা সদাম্বিকে।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। ২১
হিমাচলসুতানাথ-সংস্তুতে পরমেশ্বরি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। ২২
ইন্দ্রাণীপতিসদ্ভাব-পূজিতে পরমেশ্বরি।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। ২৩
দেবী ভক্তজনোদ্দাম-দত্তানন্দো-দয়েহম্বিকে।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। ২৪
ভার্য্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।। ২৫
তারিণি দুর্গসংসার-সাগরস্যাচলোদ্ভবে।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
মবিজহুঃ- (মহা বিরক্ত হয়ে, অভিযুক্তদের উকিলের দিকে তাকিয়ে)- অ্যাই, কী বলছে হে এই উজবুকটা অং বং করে।
আসামি পক্ষের উকিলঃ- মি লর্ড, আসলে গ্রামদেশের সাক্ষী তো। ঘাবড়ে গেছে। হুজুর, আসলে ও বলতে চাইছে, মন্তরেও ওই উই ওয়ান্ট জাস্টিসই বলা আছে। ওই যে বলেছে না জয়ং দেহি, ওইটের মধ্যে।
পাসকৌঁঃ- (মুখ ভেংচে বাধা দিয়ে) অ্যাঃ, বললেই হল সমোস্কিত মন্তরের ভেতরে ইঞ্জিরি ভেজাল! বললেই মানতে হবে নাকি হে? হুজুর সব মিথ্যে কথা।
ভীতু সাক্ষীঃ- আজ্ঞে হুজুর ব্যাপার কিন্তু তাইই। গীতা না সুপ্রিম কীসে যেন বলা আছে যথা ধর্ম তথা জয়। তা ওই জয়ং দেহি মানে জয় চাইতে গেলে পেত্থমে ধর্ম মানে ন্যায় বিচার তো চাইতেই হবে। তাই ওরা বিচার চাইছিল হুজুর। আসলে মা দুগ্গার কাছে জয় চাইছিল।
মবিজহুঃ- (পরম বিরক্তিভরে) হ্যাঁ, ওই নিয়েই থাকো আর কী। মিছে কথা বলার জায়গা পাওনি। দুর্গার কাছে চাইছিল? শোনো বাপু। আইবির গোপন রিপোর্টে, এবার একটা প্যাণ্ডেলেও ওই দুর্গা আসে নি। দুর্গাকে মেরে ফেলার পর আসবে কী করে? কোত্থাও আসেনি। সেই না-আসা দুর্গার কাছে জয়ং দেহি বলো আর জাস্টিস চাই বলো, চাইলেই কী আর না চাইলেই বা কী?
ওরে কে আছিস, এই মিথ্যেবাদী আসামিগুলোকে হেপাজতে পুরে দে। বিসজ্জনের ডেট অবদি। তখন তো থিওয়োরেটিক্যালি দুগ্গা বলে আর কিছু নেই। থাকতেই পারে না। তখন নিশ্চিন্তি। ওরা আর কিছু চাইতে টাইতেও পারবে না।
মাইকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে আইনি স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল!