ভেবেছিলাম এই পুজোটা ব্যক্তিগত শোকের পর্দার আড়ালেই কাটিয়ে দেব।
কিছুটা কাজ। বাকিটা মাতৃস্মৃতিযাপন।
হলো না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ইতিউতি।
কত লেখা। কত মানুষের কত আবেগ, ক্রোধ, ক্ষোভ, ঔদাসীন্য, আনন্দ!
আজব ক্যালিডোস্কোপিক দুনিয়ায় কেটে যাচ্ছিল মায়াবী সময়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারা গেল না।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি চিকিৎসা এবং চিকিৎসা শিক্ষার আমূল সংস্কার চেয়ে মহামান্য সরকারের কাছে যে দশ দফা দাবি পেশ করেছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত।
কিন্তু তা আদায় করার জন্য আমরণ অনশনের এই পন্থা আমি সমর্থন করি না।
অবশ্যই আমার সমর্থন/অসমর্থনে কারোর কিছুই এসে যায় না। যদিও, গত পরশু, ৮ই অক্টোবর মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত অবস্থায় ১২ ঘন্টা প্রতীকী অনশন করেছি নিজেও — নিঃশব্দেই। তবু, এই পন্থাকে আমি আন্দোলনের শক্ত হাতিয়ার বলে মনে করি না।
আমি কেউ নই, ক্ষয়া নখের, লোল চামড়ার একজন প্রৌঢ়া, পিছনের সারির সাধারণ জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার — আমার তিন ছটাক কাজ দিয়ে একটি বিশাল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কাঠবিড়ালির সেতুবন্ধনের কাজটুকুও হয় না। তবু, কণ্ঠ ছেড়ে বলি — অনশন মঞ্চ ত্যাগ করে এসো ছেলেমেয়েরা, এই লড়াইটা বোধহয় ওভাবে লড়া যাবে না।
সিনিয়র শিক্ষক চিকিৎসকরা আমার প্রণম্য, তবু এই ‘প্রতীকী গণ ইস্তফা’ও আমি সমর্থন করি না।
সাধারণ মানুষ গোল গোল কথা বোঝেন না। ‘প্রতীকী’, একটি কাগজে অজস্র স্বাক্ষর সম্বলিত গণইস্তফা আর নিয়ম মেনে, নোটিস দিয়ে, প্রপার চ্যানেলে, ব্যক্তিগত ইস্তফাপত্রের আইনি খুঁটিনাটি পার্থক্য বুঝতে তাঁদের সময় লাগে।
সেই ফাঁকে, ‘দেখেছ, প্রাইভেটে চেম্বার করবে আর এখানে কাজ করবে না’ বা ‘কাজ যেখানে করছে না, সেখানে মাইনে নিচ্ছে কোন মুখে’ জাতীয় বাইনারি ঠুসে দেওয়া হয় তাঁদের মগজে।
ভারতীয় রাজনীতির একটা সুবিধে হচ্ছে, জনগণকে চারটে গরম কথায় চট করে ভোলানো যায়, বিশদে বোঝানোর দায়/সদিচ্ছা কোনো রাজনৈতিক দলেরই রয়েছে বলে সবিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই এখানে ‘লোক ক্ষ্যাপানো’ সোজা।
আমি সরকারি চাকরি করি। পাবলিক সার্ভিস। চাকরিটা কোনো বিশেষ দল আমাকে দেয়নি। তাই কাজের ক্ষেত্রে আমি এক এবং একমাত্র জনতার প্রতি দায়বদ্ধ।
তবে শুকনো দায়বদ্ধতা দিয়ে সুচিকিৎসা করা যায় না। তার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষিত লোকবল লাগে, লাগে সরঞ্জাম, সঠিক মানের পর্যাপ্ত ওষুধপত্র, নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন, চাপমুক্ত কাজের পরিবেশ। দলাদলি সব ক্ষেত্রেই থাকে, তবে মানুষের জীবনমরণের ক্ষেত্রগুলি অস্বচ্ছতা এবং স্বজনপোষণ মুক্ত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। চিকিৎসকদের কাজটা প্রধানত মস্তিষ্কের, তাদের সমালোচনা বা নিন্দা করার সময় এই কথাটা অগ্রাহ্য করলে তো সকলেরই মুশকিল।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো সেই জন্যই লড়ছে। প্রথিতযশা, বিজ্ঞ, শিক্ষক চিকিৎসকেরা এইজন্যই রাজ্যের কর্ণধারকে প্রশাসনিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার জন্য মরীয়া পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
এই পন্থাগুলি ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন না করলেও, আমি জানি না, অন্য কি পন্থা কার্যকর হতো।
যে জনতার জন্য সিনিয়র-জুনিয়র সকল ডাক্তাররা এই রকম দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া লড়াই লড়ছেন, সেই জনতার দরবারেই প্রশ্ন রাখছি — আপনারা উপায় বলে দিন কিছু, পরামর্শ দিন। সমালোচনা সব্বাই করতে পারে — কালীপ্রসন্ন সিংহেরও আগের আমল থেকে ট্রোল কালচার চলে আসছে এ শহরে, সেটা নতুন নয়। গণপরিসরে, সত্যিকারের মুক্তচিন্তার পরামর্শ চাইছি। দিন। উপকৃত হবো।
ঠিক যে মুহূর্তে, অন্ধকার ঘরে বসে এই লেখাটা লিখছি আমার মুঠোফোনে, আমার পাড়ার পুজোমণ্ডপে তারস্বরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। কবিতাপাঠ, গান, নৃত্যনাট্য, কুইজ, কিছুই বাদ নেই — অন্যান্যবারের তুলনায় বরং কিছুটা বেশি সোচ্চার, বেশি উজ্জ্বল উল্লাস লক্ষ্য করছি।
নিন্দা করব? কেন? কোন অধিকারে?
আমার চিকিৎসকজীবনের প্রথম দিকে পরপর তিনটি শিশুসন্তানকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে হারিয়ে তাদের দুর্ভাগা মায়ের উন্মাদ হয়ে যাওয়ার সাক্ষী থেকেছিলাম।
আবার তারই বছর কয়েকের মধ্যে দুর্ঘটনায় নিজের আঠারো বছরের পুত্রকে হারিয়ে আমার বাবার এক সহকর্মীর স্ত্রীকে বছর ঘোরবার আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যেতে দেখেছিলাম — গর্ভস্থ শিশুটি যেন পুত্র হয়, সেই কামনায় যজ্ঞ করেছিলেন তাঁরা, আমন্ত্রিত ছিলাম আমরাও।
সকল মানুষের সংবেদ সমান হয় না। সমমর্মিতা চিরতার জল নয়, যে উপকারী বলে জোর করে কাউকে গিলিয়ে দিলেই ফল পাওয়া যাবে।
কোনো আন্দোলনে/বিপ্লবে/বিদ্রোহে সমাজের একশো শতাংশ মানুষ অংশগ্রহণ করে না, ইতিহাস তাই বলে।
ভারতকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে জেনে এসেছি আজন্ম। এখানে নিজের বক্তব্যটুকু স্পষ্টভাবে প্রশাসকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তাঁদের সঙ্গে সুষ্ঠু আলোচনার পরিসর তৈরি হওয়া কি খুব কঠিন হয়ে গিয়েছে আজকাল?
মানুষের জন্য প্রোটোকল, না প্রোটোকলের জন্য মানুষ — প্রশাসকেরা বিবেচনা করুন দয়া করে। বিবেচনাশক্তি আছে বলেই তাঁরা ঐ পদ অবধি উঠে আসতে পেরেছেন। পুরো সিস্টেমটা পচে গিয়েছে, আগাপাশতলা দুর্নীতি আর স্বজনপোষণে ভরে গিয়েছে, ব্যক্তি মাত্রই পক্ষ, জনগণ মানেই সুবিধাবাদী — এইসব সরলীকরণ তো অনেক হলো। জটিল আবর্তের দিকে চলেছি আমরা। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে ভাসাতে যদি আপনি, আমি, আমরা প্রত্যেকে একটি অন্ধ গলির সামনে নিজেদের আবিষ্কার করি একদিন, এক এবং একমাত্র নিজেকে ছাড়া দোষ দেওয়ার কেউ থাকবে না। তখন আপন সন্তান/সন্তানতুল্য যদি মেরুদণ্ড নমনীয় করে সুবিধাবাদী অবস্থানে থেকে আমাকেই পরিস্থিতির অসহায় শিকার হতে দেখে প্রতিবাদ না করে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আফশোস রাখার জায়গা থাকবে না। বিশ্বাস করুন, যতটা মনের জোর আমরা প্রকাশ্যে দেখিয়ে থাকি, ততটা মনের জোর বাস্তবে আমাদের মধ্যে খুব বেশি মানুষের নেই।
কোনো সমস্যারই যে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সমাধান হয় না, সে আমি বেশ জানি।
আসন্ন প্রলয় কিভাবে রুখে দেওয়া যায়, তার জন্য কিছু পন্থার খোঁজ চাইছি আপনাদের কাছে, একান্তভাবে।
উপবাসী যারা পথে বসে রয়েছেন, তাদের অকল্যাণ কামনা তো কেউই করেন না। কিভাবে তাঁদের ফেরানো যাবে, তার একটা দিশা চাইছি।
শেকসপিয়রের মার্চেন্ট অফ ভেনিস রচনায়, প্রথম দৃশ্যের শেষদিকে একটি আপাত গুরুত্বহীন সংলাপ রয়েছে। বণিক ব্যাসানিও তার সহচর গ্রাসিয়ানো সম্বন্ধে জনসমক্ষে বলছে — Gratiano speaks an infinite deal of nothing, more than any man in all Venice. His reasons are as two grains of wheat hid in two bushels of chaff: you shall seek all day ere you find them, and when you have them, they are not worth the search.
এই অর্বাচীন কলকাত্তাইয়া গ্রাসিয়ানোকে ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন দয়া করে।