১২.১০.২০২৪
অভয়াকাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা- ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১২৭. অভয়ার খুনের তদন্তে কলকাতা পুলিশের ভূমিকা একটা বাক্যে বিচারপতি পারদিয়ালা সাহেব বলে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টে, এমন ধারা গত ত্রিশ বছরের কেরিয়ারে কোনোদিন দেখি নাই। খুনের কথা জানাজানি হওয়ার আগে কলকাতা পুলিশের কীর্তিকলাপ এখনো বিচার্য, তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু জানাজানি হওয়ার পরে যা যা দেখা গেছে, তা চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ!
৯ই আগস্ট সকালে চেস্ট সেমিনার রুম লোকে লোকারণ্য- শাসক দলের ঘনিষ্ঠ লোকেরা যথেচ্ছ ঘুরে বেরিয়েছে সেখানে। পুলিশ শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছে। শুধু দেখেইনি, তাদের ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা মুখার্জি প্রত্যেক দিন মিডিয়ার সামনে মিথ্যা বয়ান দিয়ে গেছেন ক্রাইম সীন নিরাপদ রাখার ব্যাপারে। পুলিশ যে অন ক্যামেরা এত আত্মবিশ্বাসের সাথে মিথ্যা বলতে পারে, ১১ফুট/৪০ ফুটের রূপকথার গল্প বলতে পারে- একথা এই প্রজন্মের লোকেরা যখন পরে বলবে, কেউ বিশ্বাসই করবে না। এখন অব্দি দেশের আইন এই পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে একটাও পদক্ষেপ নেয়নি, মিথ্যাবাদী ইন্দিরা দেবী এখনো তাঁর পদমর্যাদায় বহাল। যাওয়ার মধ্যে গেছে টালা থানার ওসি- গেছে একদম শ্রীঘরে, যদিও কতদিন তাকে আটক রাখা যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর পাওনা বলতে কলকাতা পুলিশের সিপি ও ডিসি নর্থের ট্রান্সফার- তাও জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান বিক্ষোভের অনিবার্য ফলে, স্বতঃপ্রণোদিত নয়।
১২৮. শুধু ৯ই আগস্ট পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা শেষ হয়নি। এরপর পুলিশের চোখের সামনে সন্দীপ ঘোষ সেমিনার রুমের বিপরীতের ঘরদোর ভেঙেছে, ক্রাইমের মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে। পুলিশ নাকি জানতেই পারেনি- খবরটা সামনে এনেছে পিজি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারেরা। পুলিশ ওখানে বসে বসে চটি-বন্দনা করছিল, তাই খবর পায়নি হয়তো। তারপর এলো ১৪ই আগস্টের রাত। তৃণমূলী গুণ্ডারা ব্যাপক ভাঙচুর চালালো আরজিকরে, শুধুমাত্র নিজেদের স্বভাবজনিত তৃণমূলীয় অজ্ঞতার কারণে সেমিনার রুম চিনতে না পেরে ইএনটি বিভাগ ভেঙে চলে যায় তারা। পুলিশ গিয়ে লোকায় শৌচাগারে, সিস্টারদের কাছে শেল্টার চায়!!
এই হচ্ছে আমাদের বীরপুরুষ কলকাতা পুলিশ। এমন নয় এদের ক্ষমতা ছিল না বা খবর ছিল না এই নাশকতার। ইচ্ছাকৃতভাবে তারা নিজেদের সরিয়ে রেখেছে, কারণ তদন্তভার তখন সিবিআই নিয়ে ফেলেছে- তথ্যপ্রমাণ লোপাট তখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
নাগরিক সমাজের নিরাপত্তার শপথ নিয়ে চোর-জোচ্চর নেতামন্ত্রীদের হাতের পুতুল হয়ে যাওয়া পুলিশ শুধু সমাজের লজ্জাই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনকও।
১২৯. এই গেল পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার আখ্যানমঞ্জরী- পুলিশের সক্রিয়তার গল্প এখনো শুরুই হয়নি। আরজিকরের সন্দীপ ঘোষ সিন্ডিকেট আশীষ পাণ্ডের সুযোগ্য নেতৃত্বে অন্য কলেজের ডাক্তারদের যখন ঢুকতে বাধা দেয়, তার সেনাপতিত্বে দেখা যায় কলকাতা পুলিশকে। ঘটনা ধামাচাপা দিতে, আত্মহত্যা বলে চালাতে বদ্ধপরিকর আরজিকর সিন্ডিকেট অন্য কলেজের ডাক্তারদের বহিরাগত দাগিয়ে দেয়- তাদের ঠেলে বের করে কলকাতা পুলিশ। এসএসকেএমের সার্জারি পিজিটি ডাঃ সৃঞ্জয়কে অমানবিক ভাবে মারা হয়, জামা ছিঁড়ে দেওয়া হয়- ডাক্তার পরিচয় দিলে হার্মাদগুলো বলে, ‘ডাক্তার তো কী হয়েছে!!’
বিচারকামী মানুষদের একদিকে যেমন তারা লাঠি মেরেছে, অন্যদিকে অভয়ার মা-বাবাকে ক্রমাগত ভুল বুঝিয়েছে, চাপ সৃষ্টি করেছে, জোর করে সই করিয়েছে, আবার বন্ধ ঘরে টাকাও অফার করেছে। নমো নমো করে সন্ধ্যার পরে ময়নাতদন্ত করিয়ে, তড়িঘড়ি সৎকার করে পালিয়েছে। অভয়ার পরিজনদের গাড়ি থেকে ঠেলে নামিয়ে দিয়েছে- এতটা নির্লজ্জ ও অমানবিক এরা!!
১৩০. পুলিশের আরো রূপ দেখা বাকি ছিল, সেই রূপ বেরিয়ে এলো নবান্ন অভিযানের দিন। যে পুলিশ নিজের নাগরিকের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনা, বরং ধর্ষকদের আড়াল করতে জীবন বাজি রেখে দেয়- তারাই তাদের হীরক-রানীর জন্য গড়ে তুললো লৌহপ্রাচীর। রাতারাতি মিছিলের আহ্বায়কদের নাশকতার চক্রান্তের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করলো। সাধারণ মানুষের উপর চললো কাঁদানে গ্যাস, জল কামান, রবার বুলেট ও এলোপাথাড়ি লাঠি। ঠিক একইভাবে আক্রমণ নেমে এসেছিল যুবভারতিতে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহমেডান সমর্থকদের উপর। আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই পুলিশি আগ্রাসনের নৃশংস রূপ দেখতে পেল যে কোনো প্রতিবাদসভায়। বারাসাত, মাথাভাঙ্গা, বেহালা- যেখানেই অভয়ার বিচারের দাবিতে মানুষ পথে নেমেছে, হয় পুলিশ নয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী অত্যাচার চালিয়েছে। যাকে খুশি তুলে নিয়ে লক আপে ভরে দিয়েছে, মনমর্জিমতো কেস ধরিয়ে দিয়েছে। অনিবার্য কারণবশত পুলিশের উপরও বিক্ষোভ আছড়ে পড়েছে- ডিউটিরত পুলিশের উপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। কোন অরাজকতার মধ্যে আমরা তলিয়ে গেছি ভাবলে অবাক হতে হয়!!
১৩১. শুধু গায়ের জোরেই পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি, আইনি মারপ্যাঁচও খেলে গেছে ক্রমাগত। বিভিন্ন জায়গায় মিছিল বা প্রতিবাদসভায় অনুমতি আটকানো, প্রচ্ছন্ন হুমকি, অকারণে হেনস্তা- এসব চলছিলই। এমনকি আরজিকরে শীর্ষ আদালতের নির্দেশে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনীও পুলিশের অসহযোগিতার শিকার হয়েছে। কিন্তু এদেরই বা দোষ কী! যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অন ক্যামেরা ‘ফোঁস করার’ নিদান দেন, সে রাজ্যে একটু আধটু এরকম হয়েই থাকে।
এরাজ্যে জনপ্রতিনিধি হুমায়ুন কবির ক্যামেরার সামনে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মানুষকে উস্কে দেন, সারদার টাকা মারা প্রফেসর (!!) এমপি সৌগত রায় বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেন- পুলিশ তখন আবার চটিবন্দনায় মেতে ওঠে, সেসব কথা ওদের কানে যায়না। ঠিক যেমন এই ঘটনার পরেও বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দশেরও বেশি চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটে গেছে, পুলিশ তখন সিভিক পুলিশের ঘাড়ে দায়িত্ব রেখে চটিপুজোয় ব্যস্ত ছিল।
১৩২. পুলিশের জঘন্যতম রূপ বেরিয়ে এসেছে অনশন সভায়। প্রথম দিনেই ডাঃ আপন হয়েছেন পুলিশি নির্যাতনের শিকার। এরপর বিভিন্ন ভাবে মঞ্চ তুলে দেওয়ার চেষ্টা, বায়োটয়লেট, চৌকি, বাঁশ- সব কিছু আনাতেই বাধা। যেসব ডেকোরেটার্স এখানে জিনিসপত্র সরবরাহ করেছে, তাদের থ্রেট দেওয়া- পুলিশি আগ্রাসন থেকে রেয়াত পায়নি সামান্য ঠেলাওয়ালা!!! রাস্তার মাঝে অকারণ যানজট তৈরি করে লোক খ্যাপানোর চেষ্টা করেও দেখেছে মমতার পুতুলগুলো- কিন্তু জনসমর্থনের জোয়ারে ভেসে গেছে সেসব প্রচেষ্টা।
এরপর থ্রেট গেছে বাড়ি বাড়ি, অনশনকারী স্নিগ্ধার বাড়িতে পুলিশ গেছে ওর মা-বাবাকে বোঝাতে(!) ঠিক রাত দেড়টার সময়! নর্থ বেঙ্গলে অনশনকারীদের বাড়িতেও গেছে থ্রেট কল। অনশনকারী বুয়া অর্থাৎ অর্ণবের বিরুদ্ধে টপাটপ এফআইআর দায়ের হয়ে গেছে অকারণে।
অথচ জয়নগরে নাবালিকার খুন-ধর্ষণের পর তার বাপ-মা থানায় থানায় পাগলের মতো ঘুরেও একটা এফআইআর করতে পারেনা। হীরকরাজ্যে এখন অবশ্য ‘উৎশব’ চলছে- ধর্ষণের উৎসব, খুনের উৎসব- উৎসবে এফআইআর কেন!!
১৩৩. অনশন সভার পাশাপাশি কর্মসূচি ছিল অভয়া-পরিক্রমা। বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে গিয়ে মানুষকে অভয়ার বিচারের দাবিতে একাত্ম করে তোলার জন্য। পুলিশ প্রথমে ম্যাটাডোর আটকায়, তারপর লোকজন পায়ে হেঁটে রাস্তায় নামলে রাস্তা আটকায় ব্যারিকেড। সিংহী পার্কে পাড়ার মস্তানরা সামান্য ফুচকাওয়ালার উপর অত্যাচার করলে যে পুলিশ নিশ্চুপ থাকে, সেই পুলিশই ত্রিধারায় বিচারের দাবিতে স্লোগান তোলা কয়েকজন যুবককে তুলে নিয়ে চলে যায়। পুরুষ পুলিশকর্মীরাও নির্দ্বিধায় মেয়েদের গায়ে হাত তোলে- আমরা তাকিয়ে দেখি বিস্ময়ে!!
এখানেই শেষ নয়, এই ২০-২৫ বছরের ৯জন যুবকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী কার্যকলাপ, পুলিশের উপর আক্রমণ, এমনকি অস্ত্র রাখার মতো হাস্যকর কিছু ধারা লাগিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। আলিপুর কোর্টের কোনো এক স্বনামধন্য বিচারপতি হয় গঞ্জিকার নয় চটির বশবর্তী হয়ে গ্রেপ্তারি বজায়ও রেখে দেন। অবশেষে গতকাল মহামান্য উচ্চ আদালত রাজ্য সরকারের গণ্ডদেশে পুনরায় চট্টপ্রহার করে বলেছেন, “রাজ্য যথেচ্ছভাবে তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে না, ক্ষমতা আছে বলেই যাকে ইচ্ছে গ্রেপ্তার করা যায়না। ধৃতদের বিরুদ্ধে যে ধারা দেওয়া হয়েছে, তার সপক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই”। যেসব ন্যাকা পুলিশেরা তাদের উপর আক্রমণের অভিযোগ এনেছিল, তা নিয়েও কোর্টের পর্যবেক্ষণ, “পুলিশকর্মীদের শরীরের বাইরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই”।
১৩৪. হে সুধী নাগরিকবৃন্দ, একবার ভাবুন কোন পুলিশ প্রশাসনের অভিভাবকত্বে আমরা বাস করছি! এরা নিরাপত্তা দিতে অপারগ ও অপদার্থ হলেও না হয় মেনে নেওয়া যেত। এরা তার সাথে খুনী-ধর্ষকদের পরিত্রাতাও, শুধু তাই নয়, এরা মিথ্যাবাদী- চরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিথ্যা বলতে পারে এরা!! ইউনিফর্মের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মিথ্যা সমাজের সভ্য নাগরিকবৃন্দের কাছে কতটা বিপজ্জনক সেটা যাঁরা অকারণে জেল খাটলেন, তাঁরা বেশ বুঝেছেন!
পরিশেষে বলি, পুলিশকর্মী মাত্রেই দুর্নীতিপরায়ণ নন- রাস্তায় কর্তব্যরত পুলিশদের উপর হামলা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এনারাও বিরক্ত, এনারাও ভিতর ভিতর প্রতিবাদ করতে চাইছেন। কিন্তু এদের মাথায় বসে থাকা পুলিশমন্ত্রী ও দুর্নীতিগ্রস্ত আইপিএস অফিসারেরা সমাজের জঞ্জাল- এদের শীঘ্র যথাস্থানে না পাঠালে ঘরে দুর্গন্ধ ছড়াবেই…