অভয়ার হত্যা: প্রশাসনিক মদতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক খুন
৯ই আগস্ট ২০২৪- তারিখটা শুরু হয়েছিল একটা হাড়-হিম করা খবর দিয়ে- আরজিকর হাসপাতালে একজন কর্মরতা পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন!! আজ প্রায় আশি দিন কেটে যাওয়ার পর অবশ্য আমরা সেই ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছি। চায়ের কাপে একটা করে বর্ধমান, জয়নগর, বেহালা, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি গিলতে গিলতে ভাবতে শিখেছি, ‘এসব রেপ-টেপে’র মতো ‘স্ট্রে ইনসিডেন্ট’ হয়ে থাকে। দু-একটা ‘ছোট ঘটনা’ নিয়ে ‘রাজনীতি করতে’ নেই। তাই আবার আমরা যে যার কাজে ফিরে গেছি- আরো কোনো বৃহত্তর আন্দোলনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে, দিন-বদলের ইউটপিয়ায় গা ভাসিয়ে, আইন-প্রশাসন ইত্যাদির উপর আস্থা রেখে। তবে এর মাঝে আমরা রাস্তায় হেঁটেছি, প্রচুর হেঁটেছি, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি, ডাক্তারদের অনশন করতে দেখেছি ১৭দিন ধরে- দিনের শেষে হাতে পেয়েছি এক সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে।
আমরা জানিনা অভয়ার খুন-ধর্ষণের কতটা খুন আর কতটা ধর্ষণ! কেন খুন, কেনই বা ধর্ষণ! তবে আমরা জানি, সঞ্জয় রায় অশ্লীল ভিডিও দেখে, যৌনপল্লীতে যায়, মদ খায়। কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এভাবে চরিত্রায়ণ না করা হলে আমরা বিশ্বাস করবো কেন যে ঘটনাটি সেই ঘটিয়েছে! আচ্ছা যদি বলি কোনো ডাক্তার খুন-ধর্ষণ করেছে বা করিয়েছে, শুনতে ভালো লাগবে কি! তার চেয়ে বরং এটা অনেক বেশি শ্রুতিমধুর- সঞ্জয় রায় মদ্যপ অবস্থায় একজন প্রমাণ সাইজের মেয়েকে ধর্ষণ করে শেষ করে ফেললো কুড়ি মিনিটের মধ্যে, প্রমাণস্বরূপ রেখে গেল তার ট্রেডমার্ক ব্লুটুথ ইয়ারফোন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সমকক্ষ পুলিশও ততোধিক ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তাকে ধরে ফেললো। কিন্তু তাও কেন জানিনা তাদের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত ও সৎকারে ভীষণ তাড়া, সংলগ্ন ঘরের দেওয়াল ভাঙার তাড়া! কেন জানিনা রাত দখলের রাতে উন্মত্ত দুষ্কৃতীর দল সেমিনার রুমের বাকিটুকু ভাঙতে চলে আসে- সঞ্জয়ও কি জানে শুধুমাত্র তাকে বাঁচাতে প্রশাসন এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে? একজন সামান্য সিভিককে বাঁচাতে এত আয়োজন, সেও কি ভেবেছিল!!
কিছু দুষ্টু লোকেরা অবশ্য এসব কথা তুলে অনেক প্রতিবাদ-মিটিং-মিছিল করেছে- তাই বাধ্য হয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও সিবিআই নামক দু’জন শান্তিপ্রিয় মানুষকে ব্যস্তসমস্ত হয়ে এগিয়ে আসতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারি মদতে কীভাবে সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে তার কিয়দংশ জানাজানি হওয়ায়, জনরোষ কমাতে সন্দীপ ঘোষ, আশীষ পাণ্ডের মত কিছু মহৎ লোকেদের গ্রেপ্তারও হতে হয়েছে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের ‘শুয়োমোটো’ কেসের ‘শুয়োপোকা’র মতো অগ্রগতি ও সিবিআইয়ের অসাধারণ চার্জশিটের দৌলতে তাঁদের হাজতবাসের দিনও শেষ হয়ে এলো প্রায়! ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের চেয়ারটা সন্দীপ ঘোষের পথ চেয়ে কুঞ্জ সাজাচ্ছে ইতিমধ্যে।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা নিজের ঘাড়ে নিয়েছেন। প্রথম দিন সব কার্যকলাপ শুনে মাননীয় বিচারপতি পারদিয়ালা স্বগতোক্তির মতো বলেও ফেলেছেন, পুলিশের এমন ভূমিকা ত্রিশ বছরের কেরিয়ারে কোনোদিন দেখেননি। কিন্তু তারপর অভয়ার বিচার নিয়ে কম, ডাক্তারদের কর্মবিরতি নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে সেখানে। ক্রমবর্ধমান শুনানির তারিখ, আর ক্রমহ্রাসমান শুনানির সময়কালের আবহে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে অশ্রুবিসর্জন করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার তথ্য লোপাটের তদন্ত হয়েছে, কিন্তু এখন অব্দি কুলকিনারা কিছু মেলেনি, ভবিষ্যতে মিলবে এরকম আশ্বাসও বিশেষ নেই।
জুনিয়র ডাক্তারেরা যদিও লড়াই করেছে অনেক- কখনো লালবাজারে, কখনো স্বাস্থ্য ভবনে, কখনো ধর্মতলায়- রাস্তায় পড়ে থেকে আন্দোলন হয়েছে। সিনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশ তাদের সাথে পা মিলিয়েছেন। আর তাদের কেন্দ্র করে জেগে উঠেছে বাংলার সামগ্রিক মানবিকতা। ডাক্তারদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা রাস্তায় পড়ে থেকেছে, বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছু মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে ধর্ণামঞ্চে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন- শুধু সুবিচারের দাবিতে। স্বাধীন ভারতের সর্ববৃহৎ গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী থেকেছি আমরা। শাসকের চোখ রাঙানি তুচ্ছ করে, চোখে চোখ রেখে লড়াই করে গেছে তারা। কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ নামক প্রহসনের ফাঁকে সেই আন্দোলনও তলিয়ে গেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্ল্যাক হোলে। আমরা পুলিশ কমিশনারের অপসারণ পেয়েছি, স্বাস্থ্য অধিকর্তা, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা-র অপসারণ পেয়েছি, স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণের দাবিতে অনশন অব্দি করেছি।
কিন্তু যে অমানবিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে এই খুন-ধর্ষণের সমস্ত তথ্যপ্রমাণ লোপাট হলো, শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথেই বৈঠকে বসতে হলো- তাঁর অপসারণ চাওয়া আর হলো না। এটাই সবচেয়ে বড় প্রহসন গণতন্ত্রের। অহিংস পথে ন্যায্য দাবি আদায় করা গেলে স্বাধীনতা সংগ্রামে এত রক্তক্ষয় হতো না, ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং বা সুভাষচন্দ্রের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু আমরা তথাকথিত সুশীল সমাজ এই ‘আপাত’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অরাজকতার পথে হাঁটার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। তাই শাসকও জানে আমাদের সীমাবদ্ধতা… আইন-প্রশাসন-তদন্ত ইত্যাদি শব্দবন্ধের মোড়কে তার অনিবার্য নিষ্কৃতিলাভ যে শুধুমাত্র সময় ও ধৈর্যের একটি সরল সমীকরণ মাত্র, সেটা তারা ভালোই জানে।
আর সেই পথ ধরেই কলেজে কলেজে হুমকি সংস্কৃতির ধারক-বাহকেরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আজ, নতুন দল গঠন করে- ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন। ভবিষ্যতে এরা প্রশাসনিক সাহায্যে আরো হিংস্রভাবে ফিরে আসতে চলেছে, সেটা বলাই বাহুল্য। যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে এত আন্দোলন, আগামী দিনে এই লুম্পেনরা পুনরায় নির্বাচনী প্রহসন করে সেই পরিবেশের কণ্ঠরোধ করবে, আবার সেই গণতন্ত্রের মোড়কেই- ঠিক যেভাবে মেডিক্যাল কাউন্সিলের নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতা দখল করে আছে এই তৃণভোজী লুম্পেনরা। তাই আগামীর লড়াই আরো কঠিনতর হতে চলেছে তা বলাই বাহুল্য।
তবে আন্দোলনের একটাই পাওনা- গণজাগরণ। বঙ্গদেশের কোনো রাজপথ নেই, যেখানে অভয়ার বিচারের দাবিতে কেউ হাঁটেনি। শুধু বঙ্গদেশ কেন, সমগ্র ভারতবর্ষে, এমনকি তার সীমানার বাইরেও আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। কখনো মেয়েরা রাত দখল করেছে, কখনো ইস্ট-মোহন সমর্থকেরা প্রতিবাদ জানিয়েছে, কখনো হয়েছে নবান্ন অভিযান, মিছিল আর সমাবেশের হিসেব তো ছেড়েই দিলাম। সরকারি প্রতিঘাত নেমেছে, কখনো পুলিশের বেশে, কখনো নেতা-মস্তানদের হাত ধরে। আইনি হেনস্তা, শারীরিক হেনস্তা, অকারণে গ্রেপ্তারি, বুকে ‘প্রতীকী অনশনকারী’ লেখার জন্য অন-ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারকে আটক করা- প্রশাসনিক পেশির আস্ফালন কম কিছু হয়নি। মানুষ তবু দমেনি, মানুষ তবু রাজপথে থেকেছে, মানুষ তবু আপোষহীন সংগ্রামের পথে হেঁটেছে।
আমরা সবাই জানি, অভয়ার প্রকৃত বিচার হয়তো অধরাই থেকে যাবে। ৯ই আগস্ট সকালে সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে সরকারের বাঘা বাঘা মাথারা প্রমাণ লোপাটে নেমেছে, সেই দলে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন। ময়নাতদন্ত করেছে দলের লোকেরা, দেহ দাহও হয়ে গেছে ততোধিক দ্রুততায়। চারপাশের যা ঘর ছিল, কলকাতা পুলিশ সেগুলোও দায়িত্ব নিয়ে ভেঙে সিবিআইকে দিয়েছে। সুতরাং ভয়ংকর কিছু মিরাকল না হলে সিবিআই চাইলেও, দোষী কারা হয়তো প্রমাণ করতে পারবেনা। অভয়ার মা-বাবা সেই অন্ধকারকে আঁকড়েই বাঁচবেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ‘দোষীদের সাজা হবে’ বলে দায় সারবেন।আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট নিজের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বিধান দেবেন, ন্যায় ও চিকিৎসায় ধর্মঘট হয়না- কিন্তু আমাদের বিচারব্যবস্থা বিচারের নামে সেই ‘তারিখ পে তারিখ’-র প্রহসন করবে। আর রোজ একটা করে অভয়া, নির্ভয়া ইত্যাদি প্রভৃতি- একদিন নামও বুঝি ফুরিয়ে যাবে…
থেকে যাবে শুধু এই গণ-জাগরণ। একদিন সমাজের সব স্তরের মানুষ রেগে গিয়ে, রাস্তায় নেমে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন করেছিল, তাতে নবান্নের চোদ্দ তোলা অব্দি কেঁপে উঠেছিল। এটুকুই তোলা থাক পাওয়ার খাতায়- বাকিটা থাক ভবিষ্যতের গর্ভে। আন্দোলনের শেষ হয়, প্রতিবাদের শেষ হয়না, প্রতিরোধের শেষ হয়না। তাই আন্দোলন থেমে গেলেও আমাদের প্রতিবাদ করার শিরদাঁড়াটা যেন ঋজু থাকে সর্বদা- অভয়ার জন্য এটুকু তো করাই যায়!!
অসামান্য সিরিজের ততোধিক অসামান্য উপসংহার।