কথারম্ভ
আমরা এখন একটা সারা পৃথিবীব্যাপী মহামারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। মহামারির কারণ একটি ভাইরাস। রোগটার নাম কোভিড-১৯, আর ভাইরাসটির নাম নভেল করোনা ভাইরাস, বা সার্স-কভ-২। এই ভাইরাসের উপযুক্ত ওষুধ নেই, টিকা নেই, তাই আমাদের আতঙ্কের সীমাও নেই। এতদিনে আমরা জেনে গেছি অতীতে এরকম মহামারি হয়েছিল। একশ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বে ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি মানুষ মারা গেছিল, তার কোনো ওষুধ বা টিকা ছিল না। ছ’শ বছরের বেশি আগে ইউরোপের অর্ধেকের বেশি মানুষ প্লেগে মারা গেছিল, আর দেড়’শ বছর আগে ভারতে প্লেগে মরেছিল এক কোটি মানুষ—এরও কোনো টিকা বা ওষুধ তখন ছিল না। তবে ১৯৭০-এর আগে পর্যন্ত এতাবৎ ইতিহাসে সব থেকে বেশি মানুষ মেরেছে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স।*বিংশ শতকে গুটিবসন্ত মেরেছে ত্রিশ কোটি মানুষ, তার আগে যে কত মরেছে এরোগে তার লেখাজোকা নেই। অথচ এখন গুটিবসন্ত অতীতের ধূসর স্মৃতিমাত্র। কী করে এমন হল? মনে রাখবেন, গুটিবসন্তের মতো কোভিড-১৯ হল একটি ভাইরাসঘটিত অসুখ যা শ্বাসের মধ্যে দিয়ে ছড়ায়।
আজ থেকে মাত্র ২২০ বছর আগে গুটিবসন্তের কোনো ওষুধ ছিল না (এখনও তেমন নেই), কোনো ‘টিকা’ ছিল না। মৃত্যুহার ছিল মোটামুটি ২৫% থেকে ৩০%। খেয়াল রাখবেন কোভিড-১৯ এর মৃত্যুহার সর্বত্রই ১০% এর নীচে। (অবশ্য গুটিবসন্তের দুটি ধরণ ছিল, তার মৃদু ধরণটিতে মৃত্যুহার কম ছিল, সেটা কম হতো, তাই তাকে হিসেব থেকে বাদ দিচ্ছি।**) বাচ্চাদের গুটিবসন্তে মৃত্যুহার ছিল ২৫%, এমনকি অনেক সময় ৫০% -এরও বেশি। আজ থেকে একশ বছর আগেও এদেশে পাঁচ-সাত বছর অন্তর গুটিবসন্তের তীব্র মহামারি হত। প্রবাদ ছিল, ‘শীতলাদেবী’-র একবার আগমন দেখেনি যে বাচ্চা, তাকে পরিবারের পুরো সদস্য হিসেবে ধরবে না, একটা বসন্ত মহামারি কাটালে তারপর শিশুর ভবিষ্যৎ ভাবা যেতে পারে। রোগী বেঁচে গেলেও মুখে কুৎসিত দাগ হয়ে যেত আর অন্ধ হত অনেকেই—পঞ্চাশ বছর আগেও এদেশে অন্ধত্বের এক নম্বর কারণ ছিল গুটিবসন্ত। আর এখন আমরা করোনা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছি বটে, কিন্তু সেদিন সত্যিই মারী নিয়ে ঘর করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না, আর সেভাবেই মানুষের সভ্যতা এগিয়েছে।
এখন গুটিবসন্ত বিদায় নিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত একটিমাত্র অসুখকে আমরা চিরদিনের মত পৃথিবী থেকে বিদায় করতে পেরেছি। কোভিড-১৯ এর মতো গুটিবসন্ত ছিল একটি ভাইরাসঘটিত অসুখ। আরেকটি রোগকেও আমরা পৃথিবী থেকে প্রায় দূর করে দিয়েছি, পোলিও। সেটাও ভাইরাসজনিত। পোলিও বা গুটিবসন্তর ভাইরাস মারার মতো কোনো কার্যকর ওষুধ নেই, কিন্তু এদের দূর করা গেছে। ***
কীভাবে গুটিবসন্ত দূর করা গেল? তা থেকে আজকে করোনা ভাইরাস দূর করার ব্যাপারে কোনো শিক্ষা নেওয়া যায় কি? কোয়ারান্টিন, লকডাউন আর আজ ক্লোরোকুইন, কাল এজিথ্রোমাইসিন, পরশু ফ্যামোটিডিন, তারপরের দিন হোমিওপ্যাথি বটিকা—এরকমভাবে গুজব ছাড়িয়ে কি কোনো মহৌষধ আবিষ্কার রোগ নির্মূল কোথাও কোনোদিন হয়েছে? বিজ্ঞান এগোনোর সাথে সাথে ওষুধ ও টিকা আগের চাইতে ঢের তাড়াতাড়ি আবিষ্কার করা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার সীমা কোথায়? আর পরাধীন দেশে সাহেবদের হাতের চিকিৎসা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা—এর বাইরে দেশীয় কোনো উদ্যোগ কাজে লেগেছিল কি?
গুটিবসন্ত নির্মূল করার ইতিহাস দেখি। হয়তো ইতিহাসের কিছু শিক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তবে কিনা, ইতিহাসের প্রথম শিক্ষা হল, অতীতের ঘটনা হুবহু একভাবে আরেকবার ঘটে না।
পর্ব ১
ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, ১৭৫৭ সালে এডোয়ার্ড জেনার নামে এক বালককে গুটিবসন্তের ‘টিকা’ দেওয়া হল।****
সেকি কথা? এডোয়ার্ড জেনার নিজেই তো গুটিবসন্তের টিকার আবিষ্কর্তা! আর ১৭৫৭ সাল মানে পলাশির যুদ্ধের বছর, তখন জেনার নেহাত শিশু, টিকা আবিষ্কার হবে এর চল্লিশ বছর পরে। তাহলে? তাহলে কি জেনার জন্মানোর আগেই গুটিবসন্তের টিকা চালু ছিল? কিন্তু তা কী করে হয়? জেনারের টিকা থেকেই তো টিকাকরণের প্রথম শুরু। শুধু গুটিবসন্ত কেন, কোনো টিকাই ছিল না জেনারের টিকা আবিষ্কারের আগে। টিকার ধারণাই ছিল না, এমনই লেখে আমাদের ইতিহাস বইতে, ডাক্তারি বইতেও। জেনার হলেন টিকাকরণের জনক, Father of vaccinology।
তাহলে কী, সেটা পরে বুঝব। আপাতত আমরা চলি জেনারের সঙ্গে, জেনারের সময়ে। তখন ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা সর্বত্র গুটিবসন্ত এক ভয়াবহ রোগ, আর কলম্বাসের পর স্প্যানিশ লুটেরাদের কল্যাণে আদি আমেরিকানরা দলে দলে মারা পড়ছে এই রোগে। তবে তার দু’হাজার বছর আগেও মানুষ জানত যে এই রোগটা একবার হলে পুনরায় হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তাই মহামারির সময় আগে রোগ হয়েছে এমন কাউকেই রোগীর যত্নের জন্য ডাকা হত। এ থেকে ধারণা হল, আচ্ছা, কৃত্রিম উপায়ে কোনোভাবে রোগ ঘটিয়ে দিলে কেমন হয়? কৃত্রিম রোগ কি স্বাভাবিক রোগের মতই ভয়ানক হবে? আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে ভারত, চিন বা মধ্যপ্রাচ্যে চিকিৎসকেরা নিশ্চয় এটা নিয়ে ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁরা ঠিক কী ভেবেছিলেন তা জানার কোনো উপায় আজ নেই। তবে নীরোগ মানুষের দেহে গুটিবসন্তের ‘রস’ প্রবেশ করিয়ে কম ভয়াবহ রোগ ঘটানো ও সেভাবে ভয়াবহ রোগের হাত থেকে বাঁচার পদ্ধতি চীন ও ভারতে অন্তত কয়েক শতাব্দী ধরে চালু ছিল।
প্রাচীন এশিয় পদ্ধতির গুটিবসন্ত টিকা ইউরোপ-আমেরিকায় পৌঁছেছিল, আর বালক জেনার-এর নিজের হাতে যে টিকা দেওয়া হয়েছিল, সেটা এই টিকা-ই। তবে পরে আর টিকার পাশ্চাত্য ইতিহাসে এই প্রাচীন টিকা-র কপালে ‘স্বীকৃতির টিকা’ জোটেনি। ইউরোপ-আমেরিকায় এই পদ্ধতি পৌঁছনোর ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু চীন বা ভারতে এই টিকার ইতিহাস অনেকটাই লোককথা থেকে জানা গেছে, আর জানা গেছে ইউরোপীয়দের লেখা থেকে।
আমরা এখানে একে টিকাকরণ বলছি বটে, কিন্তু টিকার ইংরেজি হল ভ্যাক্সিন। ল্যাটিন ভাষায় vacca মানে গরু, গরুর দেহ থেকে প্রথম গুটিবসন্তের টিকা তৈরি হয়েছিল বলেই সেটার নাম vaccine। প্রথমে ভ্যাক্সিন মানে কেবল গুটিবসন্তের টিকা ছিল। পরে যখন ঐ একই নীতিতে কাজ করা অন্য রোগের টিকাগুলোকে একই নামে, অর্থাৎ ভ্যাক্সিন বলে ডাকা হতে লাগল—যেমন পোলিও ভ্যাক্সিন—যদিও সেগুলো তৈরিতে গরুর কোনো ভূমিকা ছিল না। ভারতীয় ‘টিকা’ কথাটার আদি অর্থ বিশেষভাবে দাগ দেওয়া, যেমন রাজার কপালে রাজটিকা।
সে কথায় আসব পরের পর্বে।
সূত্রঃ
* Smallpox: Eradicating the Scourge, Colette Flight https://www.bbc.co.uk/history/british/empire_seapower/smallpox_01.shtml দেখুন। এখন অবশ্য গুটিবসন্ত নির্মূল, বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম ঘাতক রোগ টিবি বা যক্ষ্ণা।
**বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার ওয়েবসাইট দ্রষ্টব্য https://www.who.int/biologicals/vaccines/smallpox/en/
*** কুষ্ঠরোগও প্রায় নির্মূলের পথে। এটা ব্যাক্টেরিয়াঘটিত, কোনো কার্যকর টিকা নেই। সমস্ত রোগীকে দ্রুত সনাক্ত করে ওষুধ খাইয়ে এই অসাধ্যসাধন হচ্ছে।
**** Edward Jenner and the history of smallpox and vaccination, Stefan Riedel, https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1200696/
চিত্র পরিচিতি (কেবলমাত্র অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য)
লেখার মধ্যে– গুটিবসন্তের রোগী
ফিচারড ইমেজ– এডোয়ার্ড জেনার
যে বালকটিকে জেনার প্রথম জলাতঙ্কের টিকা দিয়েছিলেন, তার নাম যোসেফ। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। পথে পাগলা কুকুর তাকে কামড়ায়।
Louis pasteur, na Jenner?
কমেন্ট – যে বালকটিকে জেনার প্রথম জলাতঙ্কের টিকা দিয়েছিলেন, তার নাম যোসেফ। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। পথে পাগলা কুকুর তাকে কামড়ায়।
উত্তর – জেনার গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। কুকুর কামড়ালে রেবিজ হয়, সেটার টিকা আবিষ্কার করেন লুই পাস্তুর। জেনার নিয়ে এখানে যা লেখা আছে, জেমস ফিপস-কে এডোয়ার্ড জেনার-এর প্রথম গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে কাউপক্স গুটির রস (জীবিত ভাইরাস) দিয়ে টিকাদান, সেটা ঠিকই আছে।
প্রশ্ন, Louis pasteur, na Jenner?
উত্তর- আশা করি সেটা আগের উত্তর থেকেই পরিষ্কার।
(তবে নানা কারণে টিকার ব্যাপারে পাস্তুরের কথা খুব সহজেই মনে পড়ার কথা। যেমন পাস্তুরের জার্ম থিয়োরি ছাড়া টিকার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। আর পাস্তুর Father of immunology এমন বলাই যায়।)