ডা তন্ময় রায়ের লেখা
প্রায় বছর চারেক আগের কথা। মেডিক্যাল কলেজে আমরা তখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। মেডিক্যাল কলেজে একটা নতুন বয়েজ হোস্টেল বানানো হয়। এই বিষয়ে একটা জিনিস জানিয়ে রাখা ভালো যে অন্যান্য সমস্ত কলেজে যেমন প্রত্যেকটা বর্ষের জন্য আলাদা আলাদা হোস্টেল বা ফ্লোর ভাগ করা থাকে, মেডিক্যাল কলেজে এরকম কখনোই নয়, হোস্টেলের রুমে প্রত্যেকটা বর্ষের ছাত্ররা একই সাথে থাকতো। সেই কারণে সিনিয়র এবং জুনিয়রদের যে বন্ধুত্ব আপনি মেডিক্যাল কলেজে দেখবেন সেটা আর কোথাও পাবেন না। যাই হোক সেই নতুন হোস্টেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিক করে যে শুধুমাত্র নতুন ছাত্রদের রাখা হবে। কিন্তু এর আগে কিছু বছর হোস্টেল কাউন্সিলিং না করায় যে আগের বছরের যারা হোস্টেল পায়নি তাদের কথা কলেজ কর্তৃপক্ষ বেমালুম ভুলে যায়। তো এই নিয়ে প্রিন্সিপালকে বার বার জানিয়েও কোনো লাভ না হওয়ায়, শেষমেশ ছাত্ররা বাধ্য হয় প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করতে এবং সেই রাতে গুন্ডা এবং কলকাতা পুলিশ দিয়ে কিভাবে অবস্থানরত ছাত্রদের মারধর করে বের করে দিয়ে প্রিন্সিপালকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়, তার সেই ভিডিও হয়তো অনেকেই দেখেছিলেন।
যাই হোক মেডিক্যাল কলেজ তো হারতে শেখায় না, তাই সেদিন আমরাও হারিনি, আমরণ অনশন শুরু হয়েছিল পরদিন থেকে। প্রায় ১৩-১৪ দিন টানা অনশনের পর যখন একের পর এক ছাত্ররা অসুস্থ হতে শুরু করে তখন টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। শেষমেশ কলেজের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের সাথে চোখে চোখে দেখে লড়াই করে জয় ছিনিয়ে আনে দামাল কিছু ছেলে, তাদের দাবী মানতে বাধ্য হয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর, কিন্তু আজও কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ বদলায়নি, আজ হয়তো আমরা কলেজে নেই, কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই একই লড়াইয়ের আগুন নিয়ে আবার লড়াই করে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মেডিক্যাল কলেজে আবার একটি অনশন আন্দোলন চলছে। মেডিক্যাল কলেজে শেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৬ সালে, তারপর থেকে রাজ্যের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত আমাদের কলেজেও আর কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে প্রায় ৫-৬ বছর ধরে কলেজে কোনো ইউনিয়ন নেই। একটা মেডিক্যাল কলেজে ইউনিয়নের গুরুত্ব যে কতখানি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তো এই বন্ধ হয় যাওয়া নির্বাচন করার জন্যই শেষ কয়েক মাস ধরে কলজের ছাত্র ছাত্রীরা কলেজ কাউন্সিলের কাছে আবেদন করে, আন্দোলন করে। এর ফলে কলেজ কাউন্সিলের বৈঠকে ঠিক হয় ২২শে ডিসেম্বর হবে নির্বাচন। কিন্তু যতই সময় যায় এটা পরিষ্কার হয় যায় যে কলেজ কাউন্সিলের ওই নোটিস আসলে একটা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।
ছাত্রছাত্রীরা এরপর আবার আন্দোলনে নামে, আবার ঘেরাও করা হয় প্রিন্সিপাল সহ কাউন্সিলের ২৭ জন সদস্যকে। কিন্তু সেই আন্দোলনকে বানচাল করতে, যে undergraduate এর ছাত্রছাত্রীদের হাসপাতালের রোগী পরিষেবায় কোনো ভূমিকা নেই, বলা হয় তাদের জন্য নাকি রোগী পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে, কোনো এক অজানা কারণে কলেজের সেন্ট্রাল ল্যাব বন্ধ করে দিয়ে রোগীর আত্মীয়দের সমস্যায় ফেলে পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। তাতেও ছাত্র ছাত্রীরা পিছুপা না হলে গুন্ডা দিয়ে ভয় দেখানো হয়। শেষমেশ যখন এটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে রাজনৈতিক প্যাঁচে ফেলে তাদের দাবীগুলোকে বানচাল করার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন ছেলেগুলো আবার আমরণ অনশনের ডাক দেয়।
আজ অনশনের ৭ দিন পর হয়ে ৮ দিনে পা দেবে। আস্তে আস্তে অনশনকারীরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দুদিন আগে একটি ছেলে অসুস্থ হয় পড়ে, সুগার এতটাই কমে যায় যে তাকে CCU তে ভর্তি করতে হয়, তবুও সে কিন্তু হার মানেনি, ভর্তি হয়েও কিছু খেতে অস্বীকার করে সে। আজ আরেকজন অসুস্থ হল। ছবিতে যাকে দেখছেন সে হল কৌশিক, কৌশিক বড়ুয়া। আজ ৭ দিন অনশনের পর ও গুরুতর অসুস্থ হয় পড়ে, দ্রুত ভর্তি করতে হয় ওকে। ছেলেটিকে সেই প্রথম বর্ষ থেকে চিনি, মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে জানতে ফোন ম্যাসেজ করতো। আন্দোলনের শুরু থেকেই মূলত ওর থেকেই বিভিন্ন সময়ে আপডেট গুলো পেতাম। দুদিন আগেও কথা হল কেমন আছে সেই ব্যাপারে। কিন্তু আজ সে অসুস্থ হয়ে গেল। এরপরও কর্তৃপক্ষ চুপ! আর কতজন অসুস্থ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?
মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ যদি ভেবে থাকেন যে এই ছেলেগুলো এভাবে লড়তে লড়তে হেরে যাবে, তাহলে ভুল ভাবছেন। মেডিক্যাল কলেজ চোখে চোখ রেখে লড়তে শেখায়। এই ছেলেগুলো লড়ছে, কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ আপনারা আগের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন, এই ছেলেগুলো কিন্ত লড়ে যাবে, নিজেদের সবটুকু দিয়েই লড়বে। কারণ মেডিক্যাল লড়ে এসছে, লড়ছে, আর ভবিষ্যতেও লড়বে।
Long Live Medical College