গত মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে শাসক দলের বিরোধী প্যানেলে আমরা যারা প্রার্থী ছিলাম, তাদের অনেককেই বদলি করা হয়েছে। বিশেষত যারা কলকাতার কোনও না কোনও মেডিকেল কলেজে পোস্টেড ছিলাম, তাদের। যেমন আমি, ডা মানস গুমটা, ডা পরাগ বরণ পাল। প্রার্থী সরকারি চাকরি করেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী করেন – তেমন ক্ষেত্রে স্ত্রীকে বদলি করে গায়ের ঝাল মেটানোর চেষ্টা হয়েছে। এমনকি যাঁরা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন বা আমাদের পোলিং/কাউন্টিং এজেন্ট ছিলেন, কোপ পড়েছে তাঁদের উপরেও।
কিন্তু আমার পোস্ট সেই ‘অন্যায়’ ‘অবিচার’ ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে নয়।
শাসক দলের বিরোধী হয়ে থাকব, কিন্তু গায়ে আঁচটুকু লাগবে না বা শাসক জামাই-আদর করবে, এতখানি আশা করি না। বা এও বলা যায়, যে শাসক সত্যিসত্যি বিরোধিতাকে সম্মান করেন, সেই শাসক যথার্থ গণতান্ত্রিক – সেক্ষেত্রে তেমন শাসকের তীব্র বিরোধী হয়ে ওঠার কারণ কমই।
অগণতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধতা করতে হলে কিছু-না-কিছু সমস্যায় পড়তে হবে – শাসক তার হাতের ক্ষমতার অনেকখানিই আপনার ক্ষতি, বা নিদেনপক্ষে অসুবিধে, করতে ব্যবহার করবে – এটুকু মেনে নিয়েই এগোতে হয়।
‘পরিবর্তন’-পূর্ব বাংলায় যখন নাকি ব্রাত্যবাবু কৌশিকবাবুরা হল বুকিং পাচ্ছিলেন না এবং সে নিয়ে অভিযোগের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিলেন, তখন এক জনপ্রিয় সংবাদপত্রের উত্তর-সম্পাদকীয়-তে খুব চমৎকার একটা কথা বলা হয়েছিল। কে লিখেছিলেন, ভুলে গিয়েছি – কিন্তু কথাটা মনে রয়ে গিয়েছে। শাসকপক্ষের অগণতান্ত্রিক মানসিকতার নিন্দে করার পরে লেখক বলেছিলেন, শাসকপক্ষের বিরোধিতা করতে গেলে কিছু না কিছু সমস্যায় পড়তে হবে, এটুকু মেনে নিতে পারাটা জরুরি। বিরোধিতা করার জন্য সরকারি হলের বুকিং কেন পাওয়া গেল না, সে নিয়ে অভিযোগ অবান্তর। উৎপল দত্ত যখন কংগ্রেস-বিরোধী বা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে নাটক করছেন, তিনি আশা করেননি যে সরকারি অডিটোরিয়ামে সে নাটক দেখানোর বন্দোবস্ত হবে।
তো শাসক-পক্ষের চিকিৎসক-কুল যেমনভাবে থাকবেন, অনুরূপ পোস্টিং পাব আমরাও – এতখানি ‘সহিষ্ণুতার’ আশা একটু বাড়াবাড়ি। আবার সরকারি চাকরি করব, কিন্তু বদলির ভয় পাব – এমন মানসিকতাও ঘোর অনুচিত। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সঠিক সময়ে পদোন্নতি হবে এই আশা এবং কারণে-অকারণে বদলির ভয়, মাত্র এই দু’খানি ‘রিপু’ জয় করতে পারলেই চিকিৎসক হিসেবে যে গুটিকয়েক চাকরি কোনও রকম আপস ছাড়াই করা যায়, রাজ্য সরকারি চাকরি সে তালিকায় একেবারে উপরদিকেই থাকবে। (বেতন-ডিএ ইত্যাদি প্রশ্ন এখানে তুলছি না।)
সেক্ষেত্রে, মাসকয়েক আগে যখন পদোন্নতির ইন্টারভিউয়ে আমাকে বসতে দেওয়া হয়নি – ঘোষিতভাবেই আমাকে ‘অযোগ্য’ হিসেবে জানিয়ে – তখনও বিচলিত হইনি। এই বদলির নির্দেশিকাতেও না।
কিন্তু আমার একটাই অনুযোগ। বদলি ব্যাপারটাকে ‘শাস্তি’ হিসেবে দেখার – বা শাসকের তরফে ব্যাপারটাকে শাস্তি হিসেবে দেখাতে চাওয়ার – ভাবনা/চেষ্টাটা, নীতিগতভাবেই অনুচিত।
কিছুদিন আগেই এক শাসক-ঘনিষ্ঠ বিভাগীয় প্রধান ক্ষমতা ও পদ ব্যবহার করে ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। স্বাস্থ্যভবন কর্তৃপক্ষ সেই অভিযোগের শাস্তি হিসেবে বদলি-ই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করেছিলেন। মিডিয়াতে তেমনটাই জানিয়েছিলেন। (শাসক-ঘনিষ্ঠ যেহেতু, কলকাতার এক কলেজ থেকে কলকাতারই আরেকটি কলেজে বদলি।) অতএব, বদলি ব্যাপারটা যে শাস্তি-ই, সে বিষয়ে বর্তমান সরকারবাহাদুর বিশেষ ধোঁয়াশা রাখেননি।
মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচন, বিশেষত ভোটগণনা, চলাকালীন শাসকপক্ষের শিবির থেকে বারবারই শুনেছি – ভোট মিটলেই ‘মালগুলো’-কে ট্রান্সফার করতে হবে। অতএব, ধোঁয়াশার জায়গা আমাদের মনেও ছিল না।
কিন্তু, আবারও বলি, আমার প্রশ্নটা ব্যক্তিগতর চাইতেও নীতিগত।
বদলি ব্যাপারটা যদি শাস্তি-ই হয়, তাহলে শাস্তিপ্রাপ্তর কাছ থেকে কর্মক্ষেত্রে কতখানি/কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ প্রত্যাশিত? মানে, জেলখানায় দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তরা কাজকর্ম ইত্যাদি সবই করে – করতে বাধ্য হয় – কিন্তু তাতে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে কি?
আর বদলি ব্যাপারটাকে যদি ‘শাস্তি’-র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয় – যেটা হচ্ছে – তাহলে এমনকি রুটিন বা অনিবার্য বদলির পরেও তো সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নিজেকে ‘শাস্তিপ্রাপ্ত’-র বেশি কিছু ভাবতে পারবেন না? (আমাদের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন সংশয়ের সুযোগ নেই, কেননা নির্বাচন চলাকালীন ‘হুমকি’ পেয়েছিলাম এবং ট্রান্সফার অর্ডারে প্রায় লাইন দিয়ে প্রার্থীদের নাম রয়েছে।)
সেক্ষেত্রে – বদলি মানেই শাস্তিপ্রাপ্ত – এমন অনুভূতি কি প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোস্টেড ডাক্তারবাবুদের মনে একধরনের বিরক্তি হতাশা বা ডিমোটিভেটেড ডিমরালাইজড মানসিকতার জন্ম দেবে না? আর তা-ই যদি হয়, আখেরে ক্ষতিটা কি প্রত্যন্ত এলাকার মানুষেরই হবে না??
হ্যাঁ, সরকার অবশ্যই সরকারি ডাক্তারবাবুদের ফাঁকিবাজ হিসেবে দাগিয়ে বন্দুকটা আরামদায়ক নিশানায় ঘুরিয়ে দিতে পারবেন – পেরেছেন এবং পারছেনও – কিন্তু দিনের শেষে যাঁদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, তাঁরা কোথায় যাবেন!!