গতকাল বিকেলের আগে কাউন্সিল অফিসের দিকে যেতে পারিনি। বিকেলের দিকে যাওয়াটাও সহজ ছিল না, কিন্তু না যেতে পেরে মনটা বড় ছটফট করছিল। অগত্যা…
ভাগ্যিশ গেছিলাম! না গেলে কিছু অভিজ্ঞতা চর্মচক্ষে দেখা হতো না যে!!
২০১৮ সালে মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে আদালত স্থগিতাদেশ দেন বিস্তর গরমিলের কারণে। মুশকিল হলো, আদালত স্থগিতাদেশ দিলেও তার ফল কী দাঁড়ায়, তা খতিয়ে দেখার সুযোগ আদালতের থাকে না। অতএব গত চার বছর যাবত, দলীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ এক মেডিকেল কাউন্সিল আমরা প্রত্যক্ষ করি। এককথায়, এক ভয়ানক অব্যবস্থা। এবারে আদালতের নির্দেশেই আবার নির্বাচন হচ্ছে। মহামান্য আদালত নির্দেশ দেন, একটি অ্যাড-হক কমিটি গড়া হোক, যাঁরা নির্বাচনটির আয়োজন করবেন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অবধি কাউন্সিল পরিচালনা করবেন।
নির্বাচন আসতেই দেখা গেল, সেই অ্যাড-হক কমিটির সদস্যরা প্রায় সকলেই ভোটে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। এবং দাঁড়িয়েছেন নিজেদের ‘সরকারপন্থী’ ‘সরকার-মনোনীত’ প্রার্থী হিসেবে দাবি করে। অর্থাৎ, এতদিন ধরে মাছ পাহারা দিচ্ছিলেন স্বয়ং মার্জারকুল। স্বাভাবিকভাবেই, মহামান্য আদালত বাকি যা যা নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেমন সিসিটিভি মনিটরিং বা অবজার্ভার নিয়োগ, এসবের একটিও মানা হলো না। এ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হলে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ, সম্ভবত, নিশ্চিতই ছিল – কিন্তু আমরা ঘরপোড়া গরু, আদালতের স্থগিতাদেশের পরিণতি গত চার বছর ধরে দেখে আসছি, আমরা আদালতের দ্বারস্থ হইনি। বরং যতটুকু সম্ভব স্বচ্ছতা যাতে বজায় থাকে, তার দায়িত্ব নিজেরাই নিয়েছি। ভয় দেখিয়ে ফাঁকা ব্যালট সংগ্রহে বাধা দিয়েছি, ছাপ্পা ব্যালট জমা করার সময় রুখে দাঁড়িয়েছি, রাতের অন্ধকারের সুযোগে গোলমাল হতে পারে অনুমান করে রাত পাহারায় থেকেছি নিজেরাই। (ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমরা রুখে দাঁড়ানোর আগে অবধি মেডিকেল কাউন্সিল অফিসে, এই নির্বাচনের দিনগুলোতে, পুলিশ-প্রহরার ব্যবস্থাটুকুও ছিল না!!)
নির্বাচনে যিনি রিটার্নিং অফিসার, আপাতদৃষ্টিতে মানুষ খারাপ নন। ভদ্রলোকই বলা চলে। কিন্তু, রিটার্ন ব্যালটের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। যেহেতু এই ভোটে ব্যালট যায় চিকিৎসকদের বাড়ির ঠিকানায়, তালিকাভুক্ত অনেক চিকিৎসক ইতোমধ্যে মৃত, অনেকের ঠিকানা বদলে গিয়েছে, অনেকে পিয়ন আসার সময়টায় বাড়িতে অনুপস্থিত (এবার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বাদে আর কারও হাতে ব্যালট দেওয়ার ব্যাপারে খানিকটা কড়াকড়ি করা হয়েছে) – সেহেতু প্রতিদিনই অজস্র ব্যালট কাউন্সিল অফিসে ফেরত আসছে, ‘আনডেলিভার্ড’ হয়ে। কিন্তু রোজ ঠিক ক’খানা ব্যালট ফেরত আসছে, তার হিসেব কেউ আমাদের দিতে চাইছেন না। অতএব, দিনের শেষে এই ‘রিটার্ন ব্যালট’-এর একাংশ যে শাসকগোষ্ঠীর হাতে পৌঁছে গিয়ে ছাপ্পাভোট হিসেবে জমা পড়বে না, তেমন নিশ্চয়তাও নেই। তদুপরি, রিটার্ন ব্যালট বোঝাই ট্রাঙ্কগুলি প্রার্থীদের উপস্থিতিতে ‘সিল’ করার ব্যাপারেও রিটার্নিং অফিসারের প্রবল অনীহা।
রোজকার মতো গতকালও, বিকেলের দিকে, আমরা হাজির ছিলাম কাউন্সিল অফিসের সামনে। আমরা, এবং ওরা-ও। সেখানে জনৈক ‘সরকারপন্থী’ প্রার্থী – যিনি আবার সেই অ্যাড-হক কমিটির সদস্য ও কিছু-একটা পদাধিকারীও বটেন – তিনি হাজির হতেই রিটার্নিং অফিসার প্রায় আঁকুপাঁকু করে ছুটে এলেন। কী কথা হলো, আন্দাজ করা মুশকিল – সম্ভবত, এমন করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধে হচ্ছে কিনা ইত্যাকার কুশল-বিনিময়ের কারণেই ‘অফিসার’-এর এমন উৎকণ্ঠা। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের এই এক সমস্যা – ‘গুডবুক’-এ না থাকলে ভাতা-ইত্যাদি নিয়মিত পেয়ে চলা মুশকিল, অগত্যা…
আরও একটি আশ্চর্য নির্দেশিকা গতকাল সন্ধের পর জানা গেল। আমাদের পক্ষের সাতজন প্রার্থী, ভোটগণনার সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন প্রার্থীপিছু একজন করে কাউন্টিং এজেন্ট। অর্থাৎ আমাদের সাতজন এজেন্ট। কিন্তু গতকাল জানা গেল, কাউন্টিং টেবিল হবে পনেরখানা। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি টেবিলে আমাদের কোনও কাউন্টিং এজেন্ট থাকতে পারবেন না। বাকিটা সহজেই অনুমেয়…
কানাঘুষোয় আরেকটা কথা কানে এলো। পনেরটা টেবিলে ভোটগণনার কাজ চালানোর মতো কর্মীসংখ্যা মেডিকেল কাউন্সিলে নেই, তাই অন্য জায়গা থেকে (যেমন – স্বাস্থ্যভবন) কর্মী নিয়ে আসতেই হবে। স্বাস্থ্যভবনে নাকি তৃণমূল-পন্থী কর্মী সংগঠনের তরফে ‘সিলেকশন প্রসেস’ শুরু হয়েছে, যাতে ‘বিশেষভাবে দক্ষ’ কর্মীদেরই পাঠানো যায়। অবশ্যই এই কথার সত্যিমিথ্যে যাচাই করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সুসংবাদ প্রায়শই গুজব হলেও দুঃসংবাদ প্রায় কখনোই তেমন নয় এবং আগেই বলেছি, আমরা ঘরপোড়া গরু…
তো, মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনেও ‘খেলা হবে’ কোনও ফিউচারিস্টিক স্লোগান নয়, খেলা রীতিমতো চলছে। বিভিন্ন লেভেলে, বিভিন্ন কৌশলে। আমরা আছি, লড়ছি, যথাসাধ্য প্রতিরোধও করছি, কিন্তু…
তারপরও বলি, এতদিন ধরে এই লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তাররা যেভাবে আমাদের সঙ্গে লড়লেন – চিকিৎসক বাদে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন যেভাবে এই নির্বাচনের খোঁজখবর রাখলেন, আমাদের নিঃস্বার্থ সমর্থন জোগালেন – তাতে আমি অভিভূত। এই লড়াই বিফলে যাবে না। হাতের উপর জমা হলো যে ভালোবাসার হাত, তা কি অত সহজে ছাড়া হয়!
কাউন্সিল সত্যিসত্যিই পাল্টাচ্ছে কিনা, তা আগামী দুদিনে জানা যাবে – কিন্তু চিকিৎসকদের একজোট হওয়ার এই ছবি পাল্টাবে না, এটুকু নিশ্চিত।
পুনঃ- আরেকটি অনুল্লেখযোগ্য ঘটনা। মানে, এমনটা তো প্রত্যাশিতই। গতকাল কাউন্সিল অফিসে বন্ধের পরেও আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যেমন থাকি রোজই। জনৈক পুলিশ দেখলাম আমাদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছেন। কথাবার্তা শুনছেন, সম্ভবত। আমাদের অবশ্য গোপন-করা-উচিত এমন কোনও ক্রিয়াকলাপ ছিল না, কাজেই আমরা ভাবিত হইনি। খানিক বাদে তাঁর কুশলাদি জানতে চাইলে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানান, আমাদের এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিয়মবিরুদ্ধ কাজ হয়ে যাচ্ছে। জানতে চাইলাম, তাহলে কোথায় দাঁড়াব? তিনি বলেন, নিয়মানুসারে দুশো মিটারের মধ্যে অনেকে মিলে দাঁড়ানোটা অনুচিত, কিন্তু অতটা না হলেও আমাদের অন্তত খানিকটা সরে দাঁড়ানো উচিত।
আজ সকালে জানলাম, ঠিক ওই জায়গাতেই, ‘তৃণমূলপন্থী’ চিকিৎসকদের জন্য রীতিমতো বাঁশটাঁশ দিয়ে ছাউনি খাটিয়ে শিবির তৈরি হয়ে গিয়েছে। রাতারাতি।
দাঁড়িয়ে পুলিশ লাঠি বাগিয়ে।
তাঁদেরও মাসে বকেয়া ডিএ।।
তবে সে কথা কি সবসময় সবার মাথায় থাকে!!!