৪
ফেরার পথে এবং বাড়ি ফিরেও শ্রীপর্ণ এতটাই গম্ভীর, যে মিঞ্জিরিও কথা বলেনি। তবে সারা সন্ধে উসখুস করে শেষে রাতে শুতে গিয়ে আর ধৈর্য রাখতে পারল না। বলল, “তোমাদের ব্যাপারটা কী আমাকে বলবে?”
প্রায় চমকে উঠে শ্রীপর্ণ বলল, “কী ব্যাপার আবার?”
মিঞ্জিরি বলল, “তোমরা দুজন একেবারেই সমবয়সী, একসঙ্গে বড়ো হয়েছ, একসঙ্গে স্কুলে যেতে আসতে, এক সময় নাকি বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলে — তুমি মানতে চাও কি না চাও, ভালোবাসাও ছিল হয়ত। আরও কিছু ছিল কি? নইলে এত অদ্ভুত আচরণ কেন করলে দুজনে?”
অবাক শ্রীপর্ণ বলল, “আমার আচরণে কী অদ্ভুত দেখলে তুমি?”
“উনি তোমাকে চিনতে পারলেন না, আর তুমিও এক কথায় মেনে নিলে যে অনেক দিন বাইরে থাকার ফলে উনি সব্বাইকে ভুলে গেছেন? এতক্ষণ রইলে, পুরোনো দিনের কোনও গল্পই করলে না?”
শ্রীপর্ণ একটু বিরক্ত মুখে বলল, “কী গল্প করব? পুরোটা সময় যে আমাকে আপনি আপনি করল, তার সঙ্গে পুরোনো দিনের গল্প করা যায়?”
মিঞ্জিরি বলল, “সেই তো বলছি। আমাকে পর্যন্ত বেরোবার সময় তুমি বললেন, তোমাকে আপনি। ব্যাপারটা কী?”
শ্রীপর্ণ বলল, “এমন অনেকেরই হয় বলে শুনেছি। তুমিও জানো। এই তো সেদিন অমিত এসে বলল — অতি কষ্টে দেবাশিসের নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছিল, দেবাশিস প্রথমে আপনি আপনি করে কথা বলেছে, আর তারপরে, যখন অমিত শালা-হারামজাদা বলে গালাগাল করেছে, তখন তুমিতে নেমেছে। তুই বলেনি।”
মিঞ্জিরি বলল, “কিন্তু তুমি তো সে চেষ্টাটাও করলে না। এক কথায় মেনে নিলে।”
শ্রীপর্ণ কেন সে-চেষ্টা করেনি সেটা মিঞ্জিরিকে বলার দরকার মনে করল না। একবার ভাবল বলে, “শানু আমাকে ভুলে গেছে, সেটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।” কিন্তু তাহলে আবার সেটা এক্সপ্লেন করতে হবে। তাই বলল, “ওর হাজবেন্ড ওখানে বসে আছেন, সেখানে ও আমাকে চিনতে পারেনি… এ সব নিয়ে বেশি আলোচনা ঠিক হত?” মিঞ্জিরি শাড়িটা খুলে ভাঁজ করতে করতে বলল, “সেটাও… সোমেশ্বরবাবুও কী রকম একটা দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তখন। আমার দেখেই অস্বস্তি লাগছিল। তাই বলছি…”
“কী বলছ?”
“তোমাদের মধ্যে কি এমন কিছু ছিল, যেটা এখন ওদের বিবাহিত জীবনে কোনও অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে? এমন কিছু — যা আমি জানি না?”
এমন কিছু? যা ছিল সেটা এত বছর পরে বিঘ্ন-সৃষ্টি করতে পারে? দীর্ঘ ইউরোপ-বাসের পরে দু’জন অ্যাডাল্ট মানুষ এমন সামান্য একটা বন্ধুত্ব নিয়ে এতটাই বিব্রত হতে পারে? তবে শ্রীপর্ণ সোমেশ্বরের অভিব্যক্তিটা দেখেনি, তাই মিঞ্জিরি কী দেখেছে বুঝতে পারল না। দুজনে কিছুক্ষণ খিটিমিটি তর্কাতর্কি করে শুতে গেল।
তারপরে প্রায় এক সপ্তাহ শ্রীপর্ণ কোনও দিকে তাকানোর সময় পেল না। পরদিন দুপুরেই সুজন মাথাইয়ের লোকজন এসে হাজির হলো, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল হই-হই করে জমি মাপা, প্ল্যান করা, ছবি আঁকা, তার ছবি তোলা, সেগুলো সব প্রথমে সুজন মাথাইকে, তারপরে জিতুদাকে পাঠানো… সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শ্রীপর্ণকে মিঞ্জিরি দেখতেই পায় না। সারা দিন বাড়ির বাইরে কাটিয়ে দুপুরে খেতে আসে কি আসে না, আর সন্ধের পরে এসেই চান করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এর মধ্যে আবার সকালে উঠে পরীক্ষার খাতা-ও দেখতে হয়।
প্রথম দিনের পরে ওদের প্রায় দু’সপ্তাহের ছুটিতে শানু আর সোমেশ্বরকে ওরা আর দেখতেই পেল না। শানু বলেছিল, পেছনের বাগানে বেড়াতে বা বসে বই পড়তে ওর ভালো লাগে, তাই মিঞ্জিরিও প্রায়ই বাড়ির পেছনের ঝোপেঝাড়ে অগোছালো জমিতে পায়চারি করত, কিন্তু দেখে মনে হত না যে বাড়িতে জনমানুষ আছে। শেষে একদিন গ্রামের পথে হাঁটতে গিয়ে দেখা হলো পিসিমাকে দেখাশোনা করা মেয়েটার সঙ্গে। জানল, শানু আর সোমেশ্বর গ্রামেই নেই। কয়েক দিন হলো কোথায় গেছে। অবাক মিঞ্জিরি কথাটা শ্রীপর্ণকে বলতে সে অবশ্য অবাক হলো না। কেউ কোথাও, কাজে, বা বেড়াতে যেতেই পারে… “এই তো, তুমি আর আমি বাড়ি বন্ধ করে এখানে পড়ে আছি, দু’সপ্তাহ প্রায় হয়ে গেল, সেরকম…”
মিঞ্জিরি কথা বাড়াল না, কিন্তু বার বার মনে হতে লাগল যে ওদের সঙ্গে যাতে দেখা না হয়, সেজন্যই গ্রামছাড়া হয়েছেন সোমেশ্বর আর শানু।
তখন কিছু না বললেও, মিঞ্জিরি বাড়ি ফিরে বেশিদিন চুপ করে থাকতে পারল না। দিন দুয়েক পরে রাতে খেতে বসে বলেই ফেলল।
শ্রীপর্ণ ভুরু কোঁচকাল। “এতটা কি করবে কেউ? মানে, আমাদের তো বাড়ি তৈরি হবে এখন। আমরা নিশ্চয়ই বার বার গ্রামে যাব? প্রতিবারই কি এভাবে পালিয়ে যাবে নাকি? দুর!”
আবার মাসখানেকের মধ্যেই ফিরে যেতে হলো ওদের। এবারে আর ব্যাপারটা আলোচনা করেনি আগে শ্রীপর্ণর সঙ্গে, কিন্তু শ্রীপর্ণ মাথাইয়ের কন্ট্র্যাকটর মানিকের সঙ্গে পঞ্চায়েত অফিসের দিকে রওয়ানা দেবার পর প্রথম দিনই মিঞ্জিরি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। আগের বারও এনেছিল ছোট্ট একটা কাটগ্লাসের প্যাঁচা, কিন্তু প্রথম-দর্শনেই দেবে না বলে সঙ্গে নিয়ে যায়নি, সেটা নিয়ে নিল হাতের ব্যাগে। আজ আর শাড়ি নয়, জিনস পরেই বেরিয়েছে। বর্ষাকাল শেষ হয়নি, রাস্তাঘাট এখনও পুরো শুকোয়নি, কিন্তু গত ক’দিন বৃষ্টি হয়নি বলে রাস্তায় কাদা কম। হাঁটতে অসুবিধে না হলেও পৌঁছতে গিয়ে একটু ঘেমেই গেল মিঞ্জিরি। আগের দিনের মতো বাইরের গেট খুলে দিল হারান, তারপরে নানা কথা বলতে বলতে মিঞ্জিরিকে নিয়ে গেল বাড়ি অবধি। ঝাড়ন দিয়ে বাইরের দরজা মুছছিল সৌদামিনী। তার হাতে মিঞ্জিরিকে সঁপে ফিরে গেল নিজের কাজে। সৌদামিনী মিঞ্জিরিকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরের দরজা খুলে বলল, “দিদি গো, ও বাড়ির বউদিদি এয়েচে।”
ঘরটা লাইব্রেরি? না হলে এত বই কেন একসঙ্গে? আগেও ছিল, না নতুন? আগেকার দিনের জমিদারবাড়িতে লাইব্রেরি থাকত? হয়ত। জলসাঘর থাকলে লাইব্রেরি থাকবে না কেন? শানু একটা ডিভান গোছের খাটে আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিল। উঠে এল বইটা বন্ধ করে পাশের টেবিলে রেখে।
“এতদিনে সময় পেলে? বাপরে, তোমাদের বাড়িতে তো বিশাল কাজ চলছে মনে হচ্ছে!” একগাল হাসি দেখে মনে হয় না, যে মিঞ্জিরি এসেছে বলে কোনও রকম অস্বস্তিতে পড়েছে শানু।
মিঞ্জিরি বলল, “কাজ তো শুরু হয়নি কিছুই। এখনও শুধু মাপজোক চলছে।”
শানু হাত তুলে নিজের বাড়িটা দেখানোর মতো করে বলল, “বাবা, এখানে যা হয়েছিল, সে আর বলার না। আর সোমু, মানে সোমেশ্বর তো নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, তাই অর্ধেকের বেশি কাজ নিজে হাতে করেছে। মাটি খোঁড়া থেকে আরম্ভ করে বাড়ি বানানো…”
মিঞ্জিরি অবাক হয়ে বলল, “তখন তুমি থাকতে কোথায়? এখানে?”
“এখানেই। ও বাড়িতে। আবার কোথায়? আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারি না বাবা।”
এদিক ওদিক তাকিয়ে মিঞ্জিরি বলল, “সোমেশ্বরবাবু এখন কোথায়?”
“বাজার গেছে। এখানে না। গাড়ি নিয়ে মাসে চার দিন যায় শহরে। ওইটুকু সময় একা থাকতে আমি পারি। তবে সত্যিই বিয়ের পর থেকে ছেড়ে থাকিনি একদিনও। খুব অসুবিধে হত যখন বাড়িটা তৈরি হচ্ছে। ও বাড়িটা তো বাসযোগ্য নেই আর। ও বলত সিটি-তে গিয়ে থাকতে… ওখানে ফ্ল্যাট আছে আমাদের — ওপিডান অ্যাপার্টমেন্টসে… আমি যাইনি। ভীষণ ভয় করে…”
মিঞ্জিরি আরও অবাক। “শহরে আবার কিসের ভয়?”
শানু বলল, “ভূতের, আবার কিসের? আমার ছোটো থেকে ভীষণ ভূতের ভয়। একা ঘরে শুতে পারি না…”
বকবক করতে করতে উঠে দরজায় গিয়ে শানু সৌদামিনীকে ডেকে চা করতে বলল, তারপরে ফিরে এসে বলল, “দিনের বেলায় ঠিক আছে। রাত্তিরেই সমস্যা…”
মিঞ্জিরি ঠিক করে গিয়েছিল আজ শানুকে দিয়ে শ্রীপর্ণর ছোটোবেলার গল্প করাবে। সরাসরি জিজ্ঞেস করা মুশকিল, তাই বলল, “আমি এইবারে গ্রামে ফিরলাম বারো বছর পরে। এতেই এত বদলে গেছে, তুমি নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি পরিবর্তন দেখছ?”
চোখ কপালে তুলে শানু বলল, “বোলো না! আমি তো কিছু চিনতেই পারছি না। তবে কী জানো, আমার তো গ্রামের সঙ্গে তেমন আত্মার সম্পর্ক কখনোই ছিল না।”
অবাক হবার ভান করে চোখ কপালে তুলে মিঞ্জিরি বলল, “ও মা! কেন? তুমি এখানে জন্মাওনি? শ্রীপর্ণ তো সারাক্ষণ ছোটোবেলার গল্প করে। এখানে ফল পাড়তে আসতাম, ওখানে খেলার মাঠ ছিল, কোথায় সাঁতার কাটা, কোথায় সরস্বতী পুজো…”
কথা কেটে শানু বলল, “আসলে কী জানো তো, আমাদের তো জমিদারের ফ্যামিলি, ফলে জমিদারী না থাকলেও আমাকে কক্ষনও গ্রামের কারওর সঙ্গে মিশতে দেওয়া হত না। স্কুলেও যে গেছি, আমি একা গেছি একা এসেছি। বিশ্বাস করবে না, বাবা বলে দিত, নিচের দিকে তাকিয়ে চলবে। মুখ তুলে কারও দিকে তাকাবে না। এমন ভয় করতাম, যে সত্যি সত্যি সেইভাবে স্কুলে গেছি এসেছি আট বছর। এই তো দেখো না, তোমার হাজবেন্ডকে আমি তো ছোটোবেলায় চিনতামই না…”
ঘণ্টাখানেক পরে মিঞ্জিরি ফিরল। মুখটা একেবারে তেতো। মনটাও। কারও ছোটোবেলার বন্ধু এ-ভাবে বন্ধুত্ব অস্বীকার করতে পারবে, স্বপ্নেও ভাবেনি। রাগে ভেতরটা ফুলছে মিঞ্জিরির। একবার ভেবেছিল তখনই উঠে চলে আসে শানুকে দু’কথা শুনিয়ে। কিন্তু দুটো কারণে করেনি। এক, ওর বাবার ছোটোবেলার শিক্ষা। বঙ্কিমচন্দ্র হাতে ধরিয়ে শিখিয়েছিল — ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ আর দ্বিতীয়, অভদ্রতা করে বেরিয়ে এলে সেটা শ্রীপর্ণর কানেও যাবে কোনওভাবে। আর শ্রীপর্ণ যদি শোনে শানু ওর সম্বন্ধে এমন একটা কথা বলেছে, তাহলে নিশ্চয়ই ওর ভালো লাগবে না।
শ্রীপর্ণও ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। ওকে দেখে বলল, “কোথায় যাওয়া হয়েছিল?”
মিঞ্জিরি জুতো খুলতে খুলতে বলল, “গিয়েছিলাম জমিদারনী সন্দর্শনে।”
শ্রীপর্ণ হেসে বলল, “সন্দর্শনে! বাপরে! কী দেখল?” তারপরে মিঞ্জিরিকে হাতব্যাগ থেকে সুদৃশ্য ভেলভেটের ব্যাগটা বের করে সুটকেসে রাখতে দেখে বলল, “ওটা কী? জমিদারনী দিলেন নাকি?”
মুখটা বেঁকিয়ে মিঞ্জিরি বলল, “ওটা আমি নিয়ে গেছিলাম জমিদারনীর জন্য। জানো না, রাজা-রানিদের দর্শনে গেলে উপঢৌকন নিয়ে যেতে হয়?”
ঘাড় নাড়ল শ্রীপর্ণ। “তা বটে। তাহলে দিলে না যে? আবার ফেরত নিয়ে এলে…”
মিঞ্জিরি প্রায় বলেই ফেলেছিল, যে তোমাকে ছোটোবেলায় চিনতই না, তাকে দিতে মন চাইল না। তারপর মনে হলো সেটা বলবে না বলেই তো ওখানে শানুকে দু’কথা শুনিয়ে আসেনি। এখনও বলা উচিত হবে না। শ্রীপর্ণ খুব কষ্ট পাবে। শানুর প্রতি ওর একটা সফট কর্নার আছে, সেটা মিঞ্জিরির কাছে পরিষ্কার। সেইজন্যই শানুকে দেখতে চেয়েছিল মিঞ্জিরি। প্রথম দিনের অদ্ভুত ব্যবহার সত্ত্বেও আজ আবার গিয়েছিল, সঙ্গে উপহার নিয়ে। কিন্তু যে ছোটোবেলার বন্ধুকে আপনি বলে, বন্ধুত্বই স্বীকার করে না, তাকে সেই বন্ধুর বউ উপহার দেবেই বা কেন? কিন্তু কিছুই বলতে হলো না, তখনই সুজন মাথাইয়ের ফোন এল, কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল শ্রীপর্ণ। ফিরল দেরি করে, সবার খাওয়াদাওয়ার পরে। কোনও রকমে খেয়ে আবার বেরিয়ে গেল। যতক্ষণে ফিরল, ততক্ষণে শ্রীপর্ণ প্যাঁচার কথাটা ভুলেই গেছে।
৫
“বাড়ি তৈরি এত ঝকমারি জানলে কে তখন ‘হ্যাঁ’ বলত?” শ্রীপর্ণর শর্টস ভাঁজ করে বাক্সে ভরতে ভরতে বলল মিঞ্জিরি। আরও মাস তিনেক কেটেছে। এই তিন মাসে শ্রীপর্ণকে দেশের বাড়ি যেতে হয়েছে আট বার। কোনও বারই বেশিদিনের জন্য নয়, বেশিরভাগই সকালে গিয়ে সন্ধেয় ফেরা, থাকতে হলেও খুব বড়োজোর দিন দুয়েক, কিন্তু ক্লান্তিকর এই বার বার যাত্রা।
“আর বলো না। বেশিরভাগ সিদ্ধান্তগুলো কিন্তু চিতু অনায়াসে নিতে পারত। কিন্তু জিতুদা ওর ওপর একেবারে ভরসা করে না, আর চিতুও সেই সুযোগে, ‘আমি জানি না, শিতুদাকে জিজ্ঞেস কর,’ বলে ঘাড় থেকে নামিয়ে দেয়।”
এখন আর গাড়ি নিয়ে নয়, ট্রেনে-বাসেই যায় শ্রীপর্ণ। সময় একটু বেশি লাগে, কিন্তু প্রত্যেকবার গাড়ি নিয়ে যাবার খরচও অনেক বেশি, ক্লান্তিকরও বটে।
মিঞ্জিরি আর যাওয়ার সুযোগ পায়নি, আজও শ্রীপর্ণ একাই যাবে। বাক্সটা গুছিয়ে দরজার কাছে নিয়ে রেখে বলল, “অত গিলে গিলে খেও না। বিষম খাবে।” শ্রীপর্ণ কিছু না বলে চোখ দিয়ে ঘড়ির দিকে দেখাল। মিঞ্জিরি বলল, “তাহলে কলেজ থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোলে কী হয়?”
কোনও রকমে মুখের গ্রাসটা গিলে শ্রীপর্ণ বলল, “কী করব? ঠিক বেরোবার আগে প্রিনসিপ্যাল ডাকলেন… এইজন্যই তো বলেছিলাম কলেজ থেকে চলে যাব…”
মিঞ্জিরি বলল, “না, বাড়ি এসে যাবে। এইটুকুই তো বলি — রাতে বাড়ি না ফিরলে বাড়ি থেকে বেরোবে। অন্য কোথাও থেকে রওয়ানা হবে না। তাও তো তোমার গার্লফ্রেন্ডের মতো না। হলে তো সঙ্গে করে আমাকেও নিয়ে যেতে হত। তখন দেখতাম…”
হাত ধুয়ে সুটকেস তুলে দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে শ্রীপর্ণ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, “কী দেখতে গার্লফ্রেন্ডের মতো হলে?”
মিঞ্জিরি বলল, “কেন, জানো না? ছোটোবেলা থেকে ভূতের ভয়ে একা রাত কাটাতে পারে না?”
সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে গেছিল শ্রীপর্ণ। থেমে বলল, “কে? শানু? কে বলল?”
দরজায় দাঁড়িয়ে মিঞ্জিরি বলল, “কেন? ও নিজে-ই বলেছিল — সেই যে বার আমি একা ওর বাড়ি গেছিলাম…”
শ্রীপর্ণ ভুরু কুঁচকে বলল, “শানু? ভূতের ভয়? ও নিজে বলেছে? কবে?”
মিঞ্জিরি বলল, “কেন? তাতে কী হয়েছে? ভূতের ভয় পায়, তাই বলেছিল…”
শ্রীপর্ণ আঙুল তুলে কী বলতে গেল, কিন্তু আবার বাধ সাধল মোবাইল ফোনের ঝঙ্কার। চট করে তাকিয়ে দেখে মিঞ্জিরির দিকে তাকিয়ে বলল, “ট্যাক্সি এসে গেছে।” বলে ফোন চালু করে বলল, “হাঁ, সুরিন্দরজী, আপ কাহাঁ হো? ঠিক হ্যায়, রুকিয়ে ম্যায় আ হি রহা হুঁ…” সিঁড়ির বাঁকে গলাটা মিলিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করল মিঞ্জিরি, তারপরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল, শ্রীপর্ণ বেরিয়ে পেছন ফিরে ওকে দেখে টা-টা বলে হাত দিয়ে একটা উড়ন্ত চুমু দিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। মিঞ্জিরি নিজের মনেই বলল, “বাড়ি তৈরি শুরু হবার পর থেকে কোনও কথাই যেন শেষ আর হচ্ছে না…”
৬
সুজনের কাজ চমৎকার, সন্দেহ নেই। কিছুদিন আগেই চিতুর অংশটা তৈরি শেষ হয়েছে, তখনও শ্রীপর্ণকেই আসতে হয়েছিল সব ঠিক আছে কি না দেখতে, তখনও মনে হয়েছিল কাজের চমৎকারিত্বের কথা, আজ আবার নিজের বাড়ির অংশটা তৈরি হতে দেখেও একই কথা মনে হলো। বাংলার পাড়াগেঁয়ে বাহ্যিকের মধ্যে ভিতরের আধুনিকতা ভালোই মিলে গেছে, কোথাও জোড়া-লাগার দাগ নেই।
এযাত্রা শ্রীপর্ণর আসার কারণ খুবই জরুরি। বাথরুম-টয়লেট সম্বন্ধে শেষ কথা বলতে হবে। ছবি দেখেছে কাগজে, কিন্তু সুজন মাথাই বলেছেন অত সহজে তিনি ক্লায়েন্টকে রেহাই দেন না। ব্লু-প্রিন্ট দেখে বোঝা একরকম, আসল বাড়িতে ঢুকে আর একরকম। কতবার তিনি শুনেছেন, “না, না… বুঝলেন, এটা না, আসলে এরকম চাইনি…” সুতরাং ঘরের ভেতরের দেওয়াল তোলার আগে আর একবার শ্রীপর্ণকে সরেজমিনে দেখে যেতে হবে।
পরদিন চিতুর বাড়িতে দুপুরের খাওয়া হতে হতে দেরি হলো, ট্রেন ধরতে গেলে এখনই বেরোনো উচিত, কিন্তু মানিক, সুজনের কন্ট্র্যাকটর ছেলেটা বলল, “আপনি রামনাথ অ্যাভিনিউয়ে থাকেন না? তাহলে ট্রেনে যাবেন কেন? ভ্যান ফিরবে তো, আমিও যাব। গ্যারেজ তো আপনার পেছনেই… আমাদের সঙ্গেই চলে আসুন।”
রাজি হয়ে গেল শ্রীপর্ণ। তবে একটাই অসুবিধে, ওরা বেরোবে সন্ধে সাতটায়। “শহরে রাত দশটার আগে ভ্যান নিয়ে ঢুকলেই বুঝলেন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশকে দিতে দিতে যেতে হয়। দশটার পরে ঢুকলে নিশ্চিন্ত।” শ্রীপর্ণ ফোন করে মিঞ্জিরিকে জানিয়ে দিল। তারপরে গেল জিতুদার ঘরে বিশ্রাম করতে।
বিকেলে একটু হাঁটতে গেল বাড়ির পেছনে। এখন এদিকটা একেবারে জংলী আর নোংরা। বাড়ির কাজ শেষ না হলে সুজন ল্যান্ডস্কেপিং-এর কাজ শুরু করতে পারছে না। তুলনায় ওদিকের বাড়িটার পেছনের লন-টা একেবারে, যাকে বলে নয়নাভিরাম। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল হলো ডানদিকের একটা ছোটো গাছের আড়ালে যেন একটা নড়াচড়া। তাকিয়ে চোখাচোখি হলো শানুর সঙ্গে।
শানু হাত নাড়ল। শ্রীপর্ণও দায়সারা হাত নেড়ে বাড়ির দিকে ফিরতে যাচ্ছিল, খেয়াল করল, শানুর হাতনাড়াটা যেন একটু অন্যরকম। ওকে ইশারায় ডাকছে।
একেবারে সরাসরি ডাকছে বলেই শ্রীপর্ণ কী করবে বুঝতে না পেরে এগিয়েই গেল। গত তিন মাসে অনেকবারই শানুকে দেখেছে এই বাগানেই, বা গ্রামের পথে। শানু আজ অবধি কখনোই চোখে চোখ না রেখে অন্য দিকে চলে গিয়েছে। প্রতিবার শ্রীপর্ণর অস্বস্তি হয়েছে। বার বার নিজেকে বলেছে, সময়ের সঙ্গে মানুষ আমূল বদলে যেতে পারে, কিন্তু কোথাও একটা খচখচ করে লেগেছে। সেটা কী, অনেকবার জানতে চেয়েছে মিঞ্জিরি, শ্রীপর্ণ কেবল এইটুকু বলতে পেরেছে — মানুষটা এতটা বদলে গেল, সেটাই বুঝতে পারি না… কোন মানুষটা চল্লিশে পৌঁছে ঠিক সেই রকম রয়েছে যেমনটা ছিল চোদ্দো বা ষোলো বছর বয়সে তা অবশ্য শ্রীপর্ণ বলতে পারে না, শুধু বলে, তবু…
তবু কী তা জানে না। এখনও শানুর ডাকটা দেখে একটা অনেক অতীতের কথা মনে পড়ে গেল, তবু সেই ডাক আর আজকের এই ডাক…
পুকুরটা পাক দিয়ে ঘুরে শ্রীপর্ণ নিজেদের অংশের আগাছার জঙ্গল পার করে শানুদের বাগানে গেল। শানুরা দুই বাগানের মাঝখানে একটা ছোটো গেট লাগিয়েছে — ইংরেজিতে বলে উইকেট গেট। গেটটা খুলে শ্রীপর্ণ ঢুকল ওদের লনে। শানু ওদিক থেকে এগিয়ে এসেছে, বলল, “আজও কি একদিনের ভিজিট?”
শ্রীপর্ণ স্বীকার করল, তা-ই বটে।
“তার মানে মিঞ্জিরি আসেনি, তাই তো?”
আবার ঘাড় নাড়ল শ্রীপর্ণ। ঠিক।
“কতদিন ধরে ভাবছি দুজনকে খাওয়াব বাড়িতে ডেকে… সে আর হয়ে উঠছে না।”
হওয়ার কথাও নয়। মিঞ্জিরি সেই প্রথমবারের পরে আর আসেনি। শ্রীপর্ণ একটু মন দিয়ে শানুর কথার ধরণ লক্ষ করছিল। অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিনের পরিচিতর মতো আচরণ করতে হলে যে রকম কথার ধরণ হয়, তেমনটা যেন। কেন এমন বাধ্যবাধকতা? বুঝতে পারে না শ্রীপর্ণ। ও তো জোর করে পুরোনো বন্ধুত্ব চাগাড় দিতে চাইছে না, তাহলে?
কথা বলতে বলতে শানু বাড়ির দিকে হাঁটছে, শ্রীপর্ণও চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। শানুর পরনে একটা হালকা শাড়ি। কাপড়টা খুবই ফিনফিনে। আঁচলের আড়ালে কি আছে প্রায় স্পষ্টই দেখা যায়। এই শানুর সঙ্গে শ্রীপর্ণর পরিচয় নেই। যখন স্কুলে পড়ত, তখন শানুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার সময় থেকেই শানু শাড়ি ধরেছিল দেরি করে, এবং সে-ও স্কুলের ইউনিফর্মের শাড়ি। মোটা সাদা জমির ওপর তিন ইঞ্চি নীল পাড়। ব্লাউজ পরত পুরো গলাবন্ধ, হাতা থাকত কনুই পার করা। মেয়েদের স্কুলে তখন খুব কড়াকড়ি ছিল, তবে শানুর মতো কলার দেওয়া ব্লাউজ আর কেউ পরত না। ক্লাস এইটের পরে স্কার্ট ব্লাউজ বারণ ছিল। আর কেউ কেউ তো সিক্স, বা সেভেন থেকেই শাড়ি ধরত। শানু বোধহয় একমাত্র, যে ক্লাস ইলেভেনে…
শানুর কাঁধের ওপর একটা ছোটো চাদর… স্টোল। গাঢ় মেরুন স্টোলটা সাদা শাড়ির ওপরে বেশ মানিয়েছে। দু’কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে এনে দু’দিক ওড়নার মতো ঝুলিয়ে রেখেছে শানু। স্টোলের নিচ থেকে দু’হাত বেরিয়ে রয়েছে। এত ফর্সা কি ছিল শানু? প্রায় কনুই অবধি ব্লাউজের হাতার নিচ থেকে যে বাহু শ্রীপর্ণর স্মৃতিতে রয়েছে, তা এর চেয়ে অনেক পোঁচ বেশি বাদামী ছিল না? বহু বছর বিদেশবাসের ফল।
বাগানের দিকের দরজা দিয়ে বসার ঘরে ঢোকা যায়। শ্রীপর্ণর মনে হলো ওর বাড়িতেও এমন একটা বিরাট দেওয়াল জোড়া কাচের দরজা চাইলে হত। স্লাইডিং ডোর টেনে খুলে শানু ঢুকছে, বাগানের জুতো বাইরে খুলে কাঁধের স্টোলটা খুলে ছুঁড়ে সোফায় ফেলে ভেতরে রাখা ঘরে পরার চটি পায়ে দিচ্ছে। শ্রীপর্ণও বাইরে চটি খুলে খালি পায়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, হঠাৎ যেন দেহের ভারসাম্য রাখতে পারল না, হাত পড়ল স্লাইডিং দরজার ওপর, যেখানে চাপ পড়লে দরজা খোলে। আধখোলা দরজা পুরো খুলে গেল। শ্রীপর্ণ হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল। শানু চমকে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?” শ্রীপর্ণর ডান বাহু ধরে নিল দু’হাতে। আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?” শ্রীপর্ণ বলতে চেষ্টা করছিল কিছু হয়নি, শুনল না, ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল।। সোফায় বসিয়ে বলল, “শরীর খারাপ লাগছে?”
মাথা নেড়ে না বলল শ্রীপর্ণ। শানু ছুটে ভেতরে গিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে এল। শ্রীপর্ণ ততক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছে। বলল, “আমার তেমন কিছু হয়নি কিন্তু। পা স্লিপ করে গেছিল।”
শানু বলল, “বললেই হলো? আমি তিন বার জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? কিছু বললে না। তারপরে শরীর খারাপের কথা বললাম যখন তখন কেবল মাথা নাড়লে।”
কেন কথা বলতে পারেনি শ্রীপর্ণ বলল না। জল খেয়ে বলল, “না, ঠিক আছি, ভেবো না।”
শানু আজ নিজে থেকেই ‘তুমি’ বলছে। শ্রীপর্ণও ‘তুমি’ বলা শুরু করল।
বসার ঘরে মেঝে থেকে এক ধাপ নেমে সোফা। বাইরের বাগানের থেকেও হয়ত কয়েক ফুট নিচে। শ্রীপর্ণর মনে হলো, বৃষ্টির সময়ে বাইরের জমি, নিচের জমি ভিজে যায় না? তখন এই নকল কাঠে ড্যাম্প লাগে না? শ্রীপর্ণর ডান দিকে পেছনের বাগানের দরজা। আগের দিন বোধহয় পর্দা বা ব্লাইন্ড টানা ছিল, তাই দেখা যায়নি, আজ খেয়াল করল, বাইরের বাগানের জমি ওর কাঁধের কাছে।
“কিছু বলছ না যে?”
আবার শানুর ‘তুমি’ বলা-টা খট করে কানে লাগল শ্রীপর্ণর। চট করে তাকাল ওর দিকে। বলল, “কী বলব?”
“কোনও কথাই নেই?” শানুর কথার সুরে তামাশা? প্রগল্ভতা? বুঝল না শ্রীপর্ণ। কথা তো অনেক আছে। কিন্তু সেগুলো কি বলা যাবে? জানতে চাওয়া যাবে, কেন শানু বিদেশ গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল? বিদেশ যাবার আগেও তো অজস্র চিঠি-চালাচালি হয়েছিল দু’জনের। শ্রীপর্ণ যখন কলকাতায়, আর শানু দিল্লিতে?
হাসল শ্রীপর্ণ। বলল, “তোমার কথা বলো। দিল্লির পরে তো আর কোনও খবরই জানি না তোমার…”
শানুও হাসল। বলল, “আমার খবর সামান্য। দিল্লিতে গ্র্যাজুয়েশনের পরে সোজা ইউ-এস-এ, সেখানে পড়াশোনা শেষে চাকরি… এ-চাকরি, ও-চাকরির পরে ইউরোপ, তারপরে আর ইউরোপ ছাড়িনি। ব্রাসেলসেই সেটল করেছি।”
“ব্রাসেলসে কী করতে?” জানতে চাইল শ্রীপর্ণ।
শানু উঠে এসে শ্রীপর্ণর সঙ্গে একই সোফায় পাশাপাশি বসল। এতক্ষণ পাশের সোফায় ছিল, তাকাতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এখন পাশাপাশি হয়ে যাওয়াতে শ্রীপর্ণকে শানুর দিকে ঘুরে বসতে হলো। সোফাটা বড়ো, দু’জন আরামে বসতে পারে। কিন্তু শ্রীপর্ণ এতক্ষণ একা ছিল বলে প্রায় মাঝখানে বসে ছিল। ফলে দুজনের মধ্যে দূরত্ব এখন বেশি নেই। শ্রীপর্ণ ঘুরে বসে খেয়াল করল, দুজনের হাঁটুতে হাঁটুতে খুব বড়োজোর ইঞ্চি-দুয়েকের ফারাক।
শ্রীপর্ণর মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। শানু ব্রাসেলসে কী করত বলছে, কিন্তু ওর কানে ঢুকছে না। ওর মন-প্রাণ-সত্তা একভাবে লক্ষ করছে শানুর হাঁটুটা ওর হাঁটুর কত কাছে। একই সঙ্গে শানুর ডান হাত ওর গলার হারের একটা সিংগ্ল মুক্তো লাগানো লকেটটা নিয়ে খেলছে, সেদিকে। সেটা শানুর চোখ এড়াল না। থেমে বলল, “আমি ব্রাসেলসের কথা বলছি, তোমার নজর কোন দিকে?”
চোখ সরিয়ে নিয়ে শ্রীপর্ণ শুকনো ঠোঁট চেটে বলল, “বাড়িতে কেউ নেই? তুমি একা?”
শানু বলল, “এখনও পর্যন্ত একা। সোমু গেছে বাজারে। ফিরতে রাত হবে। আমাকে দেখে বোঝা যায় না, আমি যে আজ বাড়িতে একা?”
শ্রীপর্ণ অবাক হয়ে বলল, “দেখে কী করে বুঝবে কেউ?”
শানু বলল, “তুমি অবশ্য আমাকে অতটা দেখনি, তাই জানবে না। এই যে এই পোশাক…”
শ্রীপর্ণ বুঝল না। চেয়ে রইল।
শানু বলল, “ও বেশ প্রাচীনপন্থী। স্লিভলেস, ডিপ-কাট — পছন্দ করে না। দেখবে আমি সব সময়েই হাতা-ওয়ালা, গলাবন্ধ ব্লাউজ বা কামিজ পরি।”
বুকের অনেকটা খোলা স্লিভলেস ব্লাউজটা খেয়াল না করা কঠিন এবং স্টোলটা খুলে ফেলার পর থেকে সেদিক থেকে নজর সরাতে অসুবিধেও হয়েছে, কিন্তু সে নিয়ে কিছু বলল না শ্রীপর্ণ। বলল, “কাজের লোকও কেউ নেই?”
খিলখিল করে হেসে উঠল শানু। বলল, “আশ্চর্য লোক তো! লোকের বাড়ি এসে কাজের লোকের খোঁজ করো?”
তা-ও শ্রীপর্ণ এদিক ওদিক দেখছে বলে বলল, “সৌদামিনীকে আজ ছুটি দিয়েছি। তোমার ভয় নেই… কেউ জানতে পারবে না…”
শ্রীপর্ণর বুকটা আবার ঢিপঢিপ করে উঠল। বলল, “কী জানতে পারবে না?”
শানু আবার হাসল। এই হাসি কি অভ্যর্থনার হাসি? কাম-হিদার কি একেই বলে? তাহলে শ্রীপর্ণর কেন বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে? হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে?
শানু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “শোনো। আমি জানি তোমার আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের ছিল না আমাদের সোশ্যাল সিচুয়েশনের জন্য। কিন্তু সে তো কেবল তোমার-আমার নয় — গ্রামের কারওর সঙ্গেই তো আমার বন্ধুত্ব ছিল না। সে তো আমি বন্ধুত্ব করতাম না বলে নয়, সে আমার বাড়ির রেস্ট্রিকশনের জন্য…”
কী বলছে শানু! শ্রীপর্ণর এবারে ভয় করতে শুরু করেছে।
শানু বলে চলল, “আমি যদি জমিদারবাড়ির মেয়ে না হতাম, তাহলে তো অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলে বড়ো হতাম, হয়ত মাঠে গিয়ে ক্রিকেট ফিকেটও খেলতাম… কে জানে…”
আর সন্দেহ নেই। আর বসে থাকা যাবে না। শ্রীপর্ণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠার ভাব করে বলল, “এই রে! ওরা আবার এক্ষুনি বেরোবে। আচ্ছা, আমি তবে উঠি।”
হাতের ঘড়ি দেখে শানু বলল, “গাড়ি এনেছ? এখন তো আর ট্রেন পাবে না?”
শ্রীপর্ণ বলল, “কনট্র্যাক্টরের সঙ্গেই যাব। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রওয়ানা দিতে হবে। গিয়ে বাক্স গোছাই।”
শানু বলল, “বেশ। আমারও এখন পোশাক বদলের সময় এসে গেছে। সোমু এখনই ফিরবে না, তবু সাবধানের মার নেই। গিয়ে ঢাকাঢুকি দেওয়া জামা পরে বসতে হবে। কিন্তু কথাটা মনে রেখো। তখন বন্ধু ছিলাম না বলে এখন বন্ধু হতে পারব না, এমন কেউ বলে দেয়নি। বিশেষত এখন আমার গুরুজন কেউ বাকি নেই — পিসি তো আর আমার চলাফেরা আটকাতে পারবে না… উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস নাও।”
বাগানের দিকের স্লাইডিং ডোরটা ধরে টানতে গিয়ে শ্রীপর্ণ বুঝল শানু পাল্লাটার অন্য দিকটা ধরে আছে শক্ত করে। শ্রীপর্ণর খুব কাছে এসে বুকে অন্য হাতের দুটো আঙুল রেখে হেঁটে যাবার ভঙ্গী করে বলল, “বাগানটা পেরোলেই আমার বাড়ি। কাম এগেইন, মাই ফ্রেন্ড…”
৭
সারা রাস্তা শ্রীপর্ণর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। অনেক বার ভেবেছে ট্রেনে ফিরে আসলেই হত। তাহলে সারা রাস্তা মানিকের বকবক শুনতে হত না, আর — তার চেয়েও বেশি জরুরি, বিকেলের ঘটনাটাও ঘটত না। যত ভাবছে তত মাথা জ্যাম হয়ে যাচ্ছে, আর যত ভাবছে আর ভাববে না, তত চিন্তাগুলো আরও জড়িয়ে ধরছে সব ভাবনাকে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। ভেবেছিল মিঞ্জিরি নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু গিয়ে দেখল মিঞ্জিরি কেবল জেগে বসে আছে নয়, খায়ওনি। বলল, “কাল অফিস নেই? এত রাত অবধি না খেয়ে বসে রইলে?”
মিঞ্জিরি বলল, “না হয় রইলাম। বেশি তো সুযোগ পাই না এরকম পতিসেবা করার… পতিসঙ্গ দেবার… দেখে এলে বাড়ি? কী অবস্থা?”
বাড়ির অবস্থা বোঝাতে দু’কথাই লাগল। বলল, “বাথরুম-টয়লেট নিয়ে ব্যাপার, আমাকে মানিক বলল, সাধারণত ম্যাডামরা আসেন, আপনি ম্যাডামকে ছাড়াই এলেন?”
মিঞ্জিরি হেসে বলল, “তুমি কী বললে? যে টয়লেট বাথরুমের ব্যাপারে তুমিই বেশি পিটপিটে?”
শ্রীপর্ণ হাসল না। রুটির ক্যাসেরোল খুলে আর একটা রুটি নিয়ে এক টুকরো ছিঁড়ে মুরগির ঝোলের বাটিতে ডোবাল। মিঞ্জিরি বলল, “কী হয়েছে?”
অন্যমনস্ক শ্রীপর্ণ বলল, “কই, কিছু না তো?”
মিঞ্জিরি বলল, “ঠিক বললে না। তোমাকে আমি কম দিন চিনি না। কী হয়েছে?”
শ্রীপর্ণ বলল, “আরে, কিছু হয়নি। ওদের গাড়িতে ফেরাটা ভুল হয়েছে। ও তো গাড়ি নয়, একেবারে লজঝড়ে ভ্যান-কাম-ট্রাক। সারা রাস্তা ঝাঁকিয়ে শরীর একেবারে খেয়ে নিয়েছে। টায়ার্ড কেবল।”
মিঞ্জিরি আর কথা বাড়াল না, কিন্তু খুব যে আশ্বস্ত হয়েছে, তা-ও মনে হলো না।
শ্রীপর্ণ জীবনে এই প্রথম মিঞ্জিরি বাদে দ্বিতীয় একজন কাছের মানুষের অভাব বোধ করল। কলেজ জীবনের শেষ থেকেই জীবনসঙ্গীনী মিঞ্জিরি, আর খুব বেশি হলে জিতুদার কাছেই পরামর্শ নেওয়া অভ্যেস। কখনও ভাবেনি ওদের কাছ থেকে লুকোতে হবে এমন কোনও সমস্যা ওর জীবনে আসবে। স্কুল বা কলেজ জীবনের কোনও বন্ধু আজ ওর ‘কাছের’ নয়। চাকরি-জীবনে? পরদিন কলেজের স্টাফরুমে চারিদিকে তাকিয়ে সুবিধে হলো না। সমবয়সী হতে হবে। পুরুষ হতে হবে। বুদ্ধিমান হতে হবে। গোপনীয়তা বজায় করতে পারবে… সব কটা গুণবিশিষ্ট কেউ নেই কলেজে। আজ যদি মোইদুলটা থাকত…
হঠাৎ শ্রীপর্ণর প্রায় লাফিয়ে ওঠার ফলে পাশের চেয়ারে সুধীরবাবু চমকে উঠলেন। কিন্তু কিছু বলার আগেই শ্রীপর্ণ ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
মোইদুল শ্রীপর্ণর কোলিগ ছিল এই কিছুদিন আগেও। বছর দুয়েক হলো যাতায়াতের সুবিধের জন্য মফস্বলে ওর বাড়ির কাছাকাছি একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার পরে যোগাযোগ কমে গেছে। শ্রীপর্ণর চেয়ে বয়স কয়েক বছর কম, কিন্তু চিন্তাভাবনা একেবারে ঝকঝকে সাফ।
কপাল ভালো। ফোনটা বাজামাত্র ধরল মোইদুল। নিজের চিন্তায় শ্রীপর্ণ এতটাই মগ্ন ছিল, যে মোইদুল ফোন ধরে, “কী খবর দাদা, কেমন আছ? মিনি কেমন আছে…?” দিয়ে আরম্ভ না করলে হয়ত মোইদুল আর ওর বাড়ির কুশল জানতে ভুলেই যেত। প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে মোইদুল বলল, “তারপরে, কী মনে করে ফোন করেছিলে?” তখন বলল, “তোর সঙ্গে একটা বিশেষ প্রয়োজন আছে। ব্যাপারটা একটু গোপন। দেখা করে বলতে হবে। কবে সময় হবে তোর?”
(ক্রমশঃ)