বেশ গরম। খুব জোরে সাইকেল চালাছিলাম। ভারী চশমাটা নাকের ওপর নেমে এসেছে। আমি উত্তেজনায় টানটান।
পুষ্পা হাসপাতাল থেকে জরুরী ডাক এসেছে। একটা অপারেশন করতে হবে। এমন অপারেশন আগে করিনি। সন্তানের জন্ম।
তখন আমি ছত্তিশগড়ে। ছত্তিশগড় মাইনস শ্রমিক সঙ্ঘ (সি এম এস এস) গ্রামের গরীবদের জন্য একটা আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তুলতে চাইছে।
একবছর আগে আমি ছত্তিশগড়ের দল্লী রাজহরায় এসেছি। পিঠের ব্যাগে নিয়ে এসেছি এম বি বি এস-এর সার্টিফিকেট, টুকিটাকি এটা সেটা আর স্বপ্ন। একটা নতুন কিছু প্রমাণ করে দেখানোর মতন, একটা কিছু বানানোর স্বপ্ন। সি. এম. এস.এস.-এর নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়া স্পষ্ট মনে আছে ।
পরিচিত হবার পরেই আমাকে ভিলাইতে এক বন্ধুর কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। আমরা সারা দুপুর কথা বললাম।
শঙ্কর গুহ নিয়োগী লম্বা, মজবুত শরীর, উঁচু চোয়াল, তীক্ষ্ণ চোখ। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রতিটা ইঞ্চিতে জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন লিডার।
নিয়োগীর নিজের জীবন আর আদর্শ নিয়ে কথা বলার সময় আমি খুঁজে পেলাম এক স্বপ্ন সন্ধানীকে। আকৃষ্ট হলাম।
নিয়োগী কথা বলছিলেন নানান বিষয় নিয়ে—মজদুরদের জীবন বদলে দেওয়া নিয়ে। ওদের জন্য ইস্কুল আর হাসপাতাল বানানো নিয়ে, মদ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে। এমন আরও কতো কী।
আমার ভাবনায় এল একটা হাসপাতাল বানানো আর চালানোর খরচের কথা। আমি ভাবনাটা নিয়ে অত আশাবাদী হতে পারিনি। আমার সংশয় জানালাম।
নিয়োগী মানলেন না আমার সংশয়। বললেন যদি আমরা কোন স্বপ্ন দেখি আর ঠিক করি তা বাস্তবে করবোই, টাকা কোন সমস্যা নয়। আমি অতটা নিশ্চিত হতে পারিনি।
সেই আলাপে আমি যে ভাবে নিজের অবস্থানটা জানিয়েছিলাম, এখন ভেবে মজা পাই। আমি বলেছিলাম আমার কোন আয় নেই, আমার টাকা লাগবে। নিয়োগী সঙ্গে সঙ্গে রাজি। তারপর বোকা বোকা মুখ করে দ্বিতীয় সমস্যাটা বলি। নিয়োগীজি আপনার মদ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে বলি, আমি মাঝে মধ্যে মদ খাই। কিন্তু কথা দিচ্ছি ছত্তিশগড়ে কখনও মদ খাব না। যখন কলকাতায় বন্ধুদের সঙ্গে থাকবো তখন খাবার লোভ হতে পারে।
নিয়োগী বুঝতে পারলেন। বললেন ডাক্তার সাব, মদ বিরোধী আন্দোলনের কারণ মদ রাজহরার আদিবাসী মানুষদের সামাজিক জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছে, ঘর ভেঙ্গে দিচ্ছে।
রাজহরায় থাকার সময় আমিও এটা দেখতে পেয়েছি। ফলে নিয়োগীর কথাকে সমর্থন করেছি আর আমার প্রতিশ্রুতিকেও রেখেছি।
নিয়োগী আর আমি বন্ধু হয়ে গেলাম। আমি থেকে গেলাম। এরপর চলে এলো বিনায়ক, সি এম সি ভেলোরের শিশুরোগের ডাক্তার। আমরা শুরু করলাম জনস্বাস্থ্য আন্দোলন।
আমাদের চমৎকার হাসপাতালটা তৈরী হয়ে গেল। তিন বছরের মধ্যে। প্রথমে খুব ছোটো করে শুরু করলাম। মোটর গ্যারেজে একটা ক্লিনিক বানালাম। আমার বন্ধু শৈবাল কলকাতা থেকে চলে এলো কাছেই পুষ্পা হাসপাতালে ডক্টর ইনচার্জ হয়ে। পুষ্পা হাসপাতাল ক্রিশ্চান মিশনারীদের। এই হাসপাতালে মাঝে মাঝে আমার ডাক আসতো। সার্জারীর জন্য।
পুষ্পাতে আগের দিন সন্ধ্যেয় এক রোগী এসেছে দূরের এক গ্রাম থেকে গরুর গাড়ী করে। অচেতন অবস্থায় কাঁপুনি নিয়ে। এক্লাম্পসিয়া। প্রথমবার সন্তান ধারণ। গর্ভে থাকা সন্তান মৃত। তাকে বাঁচাতে হলে গর্ভ থেকে মৃত সন্তানকে বের করে আনতে হবে। কাছাকাছি একজনই ডাক্তার ছিল যার স্ত্রীরোগ চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ আছে।
সেই চিকিৎসক যোনিপথ দিয়ে বার করে আনার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। উদর ও জরায়ু কেটে সন্তান বার করে আনতে চায়নি। জানতো মা মারা যাবে।
শৈবাল মরিয়া। চঞ্চলা, স্ত্রীরোগের চিকিৎসক হাজার মাইল দূরে কলকাতায়। মহিলাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় উদর ও জরায়ু কেটে সন্তানকে বের করে আনা।
আমি রাজি নই। শৈবাল ছাড়লো না। মিশনারী হাসপাতালের সিস্টাররাও ছাড়ছে না। আমার বিশ্বাস আমার চরিত্রে একটা ‘আ কিউ’ বৈশিষ্ট্য আছে। (আ কিউ লু শুনের একটা কাহিনীর চরিত্র, যাকে ভিত্তি করে জগন্নাথ নাটকটা বানানো।)
এক কথায় বললে আমি ওদের চাপে রাজি হলাম। ওটিতে দাঁড়িয়ে দর দর করে ঘামছিলাম। আমি হাতে ছুরি ধরেছি, সিস্টার আমাকে থামালেন। প্রার্থনা শুরু হলো। সেই ফাঁকে আমি ট্রেনিং-এ থাকার সময় দেখা সার্জারির কাজগুলো মনে করে নিলাম।
উত্তেজনাটা তাড়াতাড়ি কেটে গেলো। মৃত সন্তানটাকে বের করে আনতে পারলাম। মার শরীরের কাটা জায়গা মেরামত করে দিলাম। কিন্তু মার অবস্থা খুব খারাপ। এখনি রক্ত দিতে হবে। ব্লাড গ্রুপ ‘এ পজিটিভ’।
চট করে খোঁজ করে দেখা গেলো শুধু আমারই ‘এ পজিটিভ’। আমি জানতাম কি হতে চলেছে। একদিনে দুবার শহীদ হবার কোন আকাঙ্খা আমার ছিলনা। শৈবাল নাছোড়। জোর করে আমাকে টেবিলে শুইয়ে দিয়ে আমার রক্ত নিয়ে মহিলাকে দিয়ে দিল।
মহিলাকে একটু ঠিকঠাক হতে দেখা অব্দি এক কাপ চিনিওলা চা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
খানিক বাদে তিন কিলোমিটার দূরে আমার সন্ধ্যে ক্লিনিকের দিকে সাইকেলে উঠে বসলাম।
সাইকেল চালাতে ক্লান্ত লাগছিলো আবার খুশি ও তৃপ্তি। নিজের পিঠ নিজে চাপড়ে দিয়ে বললাম “ওয়েল ডান”।
সাজানো ছবির মতো টাউনশিপের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় লোভনীয় খাবারের দোকানগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলাম। হায়রে আমার পকেট তো ফাঁকা।
মুক্তি মোর্চা আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। যতটা পারে মদত দিয়েছে। কিন্তু দুবেলা নিরামিষ খাবারের বেশি বিলাসিতা যোগান দেবার ক্ষমতা ওদের নেই।
আমি খাবারের একঘেয়েমি কাটাবার একটা উপায় বের করেছিলাম। সপ্তাহের শেষ দিকে কোন না কোন মজদুরের বাড়িতে, নিয়োগীর বাড়িতেও রাতের নেমন্তন্ন খেয়ে নিতাম, যেখানে মুরগির মাংস দিয়ে বেশ ভালোই খাওয়া দাওয়া হতো।
রাজহরায় আমার ছয় বছরের থাকায় এতো মুরগি খেয়েছি যে এই উপাদেয় খাদ্য বস্তুটি পরে ছেড়ে দিয়েছি, পরলোকগত মুরগিদের আত্মার শ্রদ্ধায়।
সাজানো টাউনশিপ পার হয়ে টাউনের অন্য অংশে ঢুকে পড়লাম। মজদুর মহল্লা। আগের ভূগোল থেকে একেবারে আলাদা। ছোটো ছোটো পাহাড় দিয়ে ঘেরা মালভূমি। চওড়া রাস্তা। ট্রাকে করে খনিজ লোহা যাচ্ছে ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টে। চারদিকে লালধুলো উড়িয়ে। সুর্য ডুবে যাচ্ছে। তার পড়ন্ত আভায় আকাশ সিঁদুরে রঙ্গীন।
কয়লা খনি শহর ঝরিয়াতে জন্মে আমার ধারণা ছিল সমস্ত খনির কাজই মাটির নীচে ঢুকে গিয়ে। এখানে দল্লী রাজহরাতে আকরিক লোহা পাহাড়ের মাথা কেটে বের করা।
শ্রমিকরা উপত্যকায়। কি যে ভালো লেগে গিয়েছিল জায়গাটা। “ডক্টর সাব” নিয়োগীর ডাকে স্বপ্ন লোক থেকে ফিরে এলাম। “আসুন এককাপ চা খেয়ে যান, খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।“
নিয়োগী জনা কয়েক মজদুর নেতাদের সাথে বসেছিলেন। কথা বলছিলেন মজদুর সমবায়ে স্কুল ও মোটর গ্যারেজ বানানো নিয়ে। আমি আড্ডায় জুড়ে গেলাম। হাসপাতালে আজকের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী শোনালাম। নিয়োগীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। দাঁড়িয়ে উঠলেন। “ডক্টর সাব, রোগী বাঁচবে। আপনি আপনার ক্লিনিকে যান। আমি বাকিটা দেখছি। মাকে বাঁচাতে হবে। আমরাই বাঁচাবো।“
ঘন্টা তিনেক বাদে পুষ্পায় ফিরে এসে আমি অবাক। বারান্দায় নিয়োগীর সাথে ৫০ জন লাইনে দাঁড়িয়ে। এরা সবাই দল্লী রাজহরার খনি শ্রমিক। আমাকে দেখে বললো “জোহার, লাল জোহার”– ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের সম্ভাষণ। শৈবাল দ্রুততায় ‘এ-পজিটিভ’ রক্ত খুঁজে চলেছে।
নিয়োগী সারারাত থেকে গেলেন, সাথে ‘এ-পজিটিভ’ রক্তদাতারা। শ্রমিকেরা নিয়োগীকে নমস্কার করে জোহার জানাচ্ছে আর নিজেদের পছন্দের ব্র্যান্ডের বিড়ি নিয়োগীর মুখে ধরিয়ে দিচ্ছে। আমাকেও কয়েকজন দিল। (প্রথাটা হল, একসাথে দুটো বিড়ি হাতেই ধরিয়ে নেওয়া। তারপর জোহার বলে নমস্কার করে অন্যজনকে একটা দেওয়া আর নিজে অন্যটা টানতে থাকা।)
মা পরদিন সকালে জেগে উঠলো। কথা বললো। তার সন্তানের খোঁজ করলো। আর তখন নিয়োগী ও অন্যরা চলে গেলো। সেদিন সন্ধ্যেয় মা মারা গেলো। নিয়োগী আমার কাছে এলেন। “ডক্টর সাব, পরের রোগীর বেলায় আমরা একসাথে আবার করবো।“
ইংরেজি থেকে অনুবাদ – শুভেন্দু দাশগুপ্ত