এক।
হাসির আয়ু।
দুপুরের খাওয়া কোনওক্রমে সেরে হাত-মুখ ধুচ্ছিল অরিন্দম। সাড়ে তিনটে। শনিবার রাত আর রবিবারের মর্নিং শিফট্ কভার করে বাড়ি ফিরেছে তিনটেয়। রাতে ওর জোন এ একটা মেজর কেবল ফল্ট হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে ওর স্তরের এঞ্জিনিয়রকে সচরাচর ফিল্ড এ যেতে হয় না, জোনাল অফিসে বসে তদারকি করলেও চলে। কালকের ব্যপার হল, এক জাঁদরেল মন্ত্রীপুত্রের ডুপ্লেক্স আর এক ততোধিক জাঁদরেল মহিলা এমপি র বাড়ি ওই এলাকায়। স্বয়ং ডিরেক্টর কে ডেকে আনতে পারলে ভাল হত। সারারাত জেগে ভোরবেলা কানেক্ট করা গেছে। কাজের চাপ, সাথে নেতাদের পিএর হুমকি ফোন, পাবলিকের খিস্তি। শরীর আর দিচ্ছে না, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কখন একটু গিয়ে বিছানায় গা এলাবে।
কুলকুচি শেষ হওয়ার আগেই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন – “কি রে, এই বছর যাবি তো? গত সপ্তাহে বলেছিলি, যাবি।” অরিন্দমের মনে পড়ে গেল আজ তাদের স্কুলের রি -ইউনিয়ন। বাবাও সেই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। কোভিডের জ্বালায় গত দুই বছর যাওয়া হয়নি। ওর নিজের এতশত মনে না থাকলেও বাবার এখনও এইসব ভুল হয় না। আশায় আশায় বসে আছেন বিকালে ছেলে এসে স্কুলে নিয়ে যাবে। বুজে আসা চোখ টেনে, বিরক্তি লুকিয়ে, একটু হেসে অরিন্দম বলে – “একটু গড়িয়ে নিই, ছটা নাগাদ বেরোবো’খন। তুমি রেডি হয়ে নিও।”
সাড়ে ছ’টাতেও অঘোরে ঘুমোচ্ছিল অরিন্দম। বাবা দরজায় এসে ডাকলেন – ” হ্যাঁ রে, যাবি? না কি – আচ্ছা, এবারও তবে থাক। সারারাত ডিউটি করে এলি।” এই সুর অরিন্দম চেনে। অশক্ত, নিরুপায় প্রৌঢ়ত্বের নাছোড় আবদার। রাগ হল এই বয়সে স্কুলের রি ইউনিয়নে যাওয়ার আদিখ্যেতায়, হাসিও পেল ভদ্রতা দেখে। দেহটাকে টেনে লেপের তলা থেকে বার করে বলল – “চলো, আসছি”। রবিবার শীতের সন্ধ্যায় কোনওরকমে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে হার্টের রোগ কার্ডিওমায়োপ্যাথি আর হাঁটুর বাতে ঘরে আবদ্ধ, সত্তর বছরের বাবাকে নিয়ে রি ইউনিয়নে চলল অরিন্দম। ট্যাক্সি থামল স্কুলগেটের উল্টোদিকে। রবিবারের রাস্তায় গাড়ি কম, কিন্তু যে কটা যাচ্ছে – একেবারে হুশহুশ করে। এক হাতে বাবার অকাল জরাগ্রস্ত হাতটা শক্ত করে ধরে, অন্য হাতে ধাবমান গাড়িকে হাত দেখিয়ে স্কুলের রাস্তা পার হতে হতে অরিন্দম উপলব্ধি করল – দিন কেমন পাল্টে যায়।
মাঠের চেয়ারে গোল হয়ে বসে আড্ডা চলছিল অরিন্দম আর সহপাঠীদের। কিছু পুরোনো জাবরকাটা, কিছু আদিম রসিকতা, কিছু হামবড়াই। জয়দীপ এখনও প্রতি বছর শ্যাডো করে দেখাবে ঠিক কিভাবে সে সেন্ট জেভিয়ার্স এর সাথে ম্যাচে সৌরভকে মাঠের বাইরে ফেলেছিল। অরিন্দমের শরীর মন কোনোটাই ঠিক তালে নেই। স্রেফ চারটে হা-হা আর হুঁ হুঁ। এমনিতেও, যেকোন কারণেই হোক, এই সদলবল ব্যপারগুলো কোনওদিনই ওকে অত টানে না। আগের রি-ইউনিয়নে এসেও খুব একেবারে ডুবে গেছে, তা নয়। সে জানে, ফিরে এলেই ঠিক ফিরে আসা হয় না।
মাঝে একবার উঠে গিয়ে বাবাকে দূর থেকে দেখে এল সে। শীর্ণ, রোগজীর্ণ, পক্ককেশ, সাত বছর আগে ব্রেস্ট ক্যান্সারে মা চলে যাওয়ার পরে সদা বিষণ্ণ, নিয়মিত ডিপ্রেশনের ওষুধ খাওয়া বাবা হাসছেন। কত বছর পরে সে এ দৃশ্য দেখল, মনে করতে পারছে না। লাস্ট রি ইউনিয়নে কি? বাবা হাসছেন হা হা করে, সারা দেহ কাঁপছে। সে হাসি সংক্রামিত হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘিরে বসে থাকা তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে। একজন বাবার পায়ে চাপড় মেরে বললেন – “মিমিক্রিতে তুই এখনও গুরুদেব রয়ে গেলি….”
অরিন্দম দেখল। ঠিক করল, সামনের বছর জানুয়ারীর তৃতীয় রবিবারটায় সে কোনওভাবেই ডিউটি রাখবে না। সকাল থেকেই বাবাকে নিয়ে আসবে। নিজের ভালো লাগুক আর নাই লাগুক। অবশ্য যদি…. তার মনে পড়ল, শেষ ইকোকার্ডিওগ্রাফিতে বাবার হার্টের ইজেকশন ফ্র্যাকশন এসেছিল ৩২ শতাংশ।
*******************************************
দুই।
ফেস ও বুক।
নিশীথ আজ খুব উত্তেজিত, কারণ অমরেশদার সাথে মুখোমুখি আলাপ হবে। তাকে সে একতরফা চিনত কেবল দূর থেকে। সবেমাত্র হাইস্কুলে ওঠা সিক্সের গড়পড়তা ছাত্র আর ইলেভেনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মাঝে যে দুস্তর ব্যবধান হয়, সেভাবেই। নব্বইয়ের দশকে মাধ্যমিকে নশোয় সাড়ে সাতশোর ঘরে নম্বর পেয়েও নিজের পছন্দে হিউম্যানিটিস্ পড়েছিল অমরেশ। কথায় তুখোড়, যুক্তিতে অকাট্য। প্রবন্ধ, আবৃত্তি, বক্তৃতা, বিতর্ক সবেতে স্কুলস্তরে রাজ্য জোড়া নাম। উচ্চ মাধ্যমিকে আর্টস থেকেই প্রথম কুড়ির মধ্যে। মাঝারি মানের সরকারি স্কুলে হৈহৈ কাণ্ড।
নিশীথ গল্পগাছা পড়তে ভালোবাসত ছোটবেলা থেকেই। এখনও বাসে, অবসরমত। স্কুলে পড়িয়ে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশন করে, সময় ও পয়সার সংস্থান করে যেটুকু সাহিত্যচর্চা হয় আর কি। সেভাবেই পরিচয় হয়েছিল অমরেশ লাহিড়ীর লেখার সাথে। বাংলা প্রকাশনের জায়ান্ট উল্লাস পাবলিশিং হাউসের পাক্ষিক, মাসিক, পূজাবার্ষিকীর একচেটিয়া লেখক, মূলত ঔপন্যাসিক। গত কয়েক বছর ধরে বেস্ট সেলার। বছর পাঁচেক আগে সোশ্যাল মিডিয়া মারফত নিশীথ জানতে যে ইনি ওদের স্কুলেরই সেই অমরেশদা। কথা উঠলে পরিচিতজনকে নিশীথ বলত, বেশ খানিকটা শ্লাঘা নিয়েই – জানো ত, অমরেশ লাহিড়ী আমার স্কুলের সিনিয়র দাদা।
সরকারি স্কুলে ইতিহাস পড়ায় নিশীথ। আপাতত থিতু কৃষ্ণনগর কলেজিয়েটে। দিব্যি চলছিল গতানুগতিক ব্যচিলর জীবন। দু হাজার বিশের শুরুতে কি এক রোগ এল, কোভিড। চীন, দক্ষিণ ভারত হয়ে অবশেষে কলকাতা। অনেক কিছুর সাথে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল দীর্ঘ সময়ের জন্য। অনলাইনে ক্লাস আর মাঝে মাঝে মিড ডে মিল বিলি করতে মাস্ক পরে স্কুলে যাওয়া। অবসর আর আতঙ্ক মিলেমিশে একাকার। এমনই এক কর্মহীন সন্ধ্যায় কি মাথায় এল, প্রায় অব্যবহৃত ফেসবুক খুলে ‘গাঁয়ের মাস্টার’ নামে একটা লেখা শুরু করল সে। সরকারী চাকরি পাওয়ার আগে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের এক স্কুলে বছর তিনেক পড়িয়েছিল সে। সেই গ্রাম্যতা-যাপন, মানুষজন, হাসি-কান্না আর তারই মাঝে মাস্টারি নিয়ে সরল ভাষায় সোজাসাপটা স্মৃতিচারণ। লেখার গুণে আস্তে পাঠক বাড়তে থাকল, সাথে নিত্যনূতন ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের আবাহন। কুলগোত্রহীন, সাধারণ সরকারি স্কুলমাস্টার নিশীথের কাছে এ এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা – সে যে এমন লিখতে পারে সে নিজেই জানেনি কখনও। প্রতিটি পর্বে গড়ে শ’দুয়েক লাইক আর চল্লিশ-পঞ্চাশজনের বাঁধা ভাষায় পিঠ-চাপড়ানি – ‘অনবদ্য’, ‘দুর্দান্ত’, ‘অসাধারণ’, ‘কি সাবলীল গদ্য’৷ প্রশস্তির ভেলায় ভাসতে ভাসতে এবারে সাহস করে গল্প লেখায় হাত দিল নিশীথ। এবং দ্বিতীয় গল্পটি, করোনার ভয়াবহ আবহে একটি নিটোল প্রেমের ছোটগল্প – একেবারে মারমার-কাটকাট জনপ্রিয় হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায়। হাজারের উপরে শেয়ার, যাকে বলে প্রায় ভাইরাল হব হব। বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বাহিত হয়ে তারই লেখা তার কাছে ফিরে আসতে লাগল ‘সংগৃহীত’ নাম দিয়ে। এক ধাক্কায় নূতন বন্ধুত্বের অনুরোধ এল প্রায় পাঁচশোর মত। রীতিমতো বাছাই করতে হয় তাকে – কাকে সে নেবে আর কাকে ফেলবে।
এরই মাঝে এক সকালে চমকে ওঠে নিশীথ। তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন অমরেশ লাহিড়ী! তাদের অমরেশদা! ভালো করে দেখল সে – ফ্রেন্ড সাজেশন নয়তো। সেই সাহিত্যিক অমরেশ লাহিড়ী ই তো – এও সম্ভব! সাথে তার গল্পে মন্তব্য করেছেন ‘এরকম লিখতে পারলে গর্বিত হতাম’। গদগদ হয়ে রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করল নিশীথ এবং পরিচয় দিল স্কুলের জুনিয়র হিসাবে। এরপরে নিশীথের লেখা আরও বাড়ে। ফেসবুকের মাপে ছোটগল্প, রম্যরচনা। প্রথম প্রথম অমরেশদা প্রশংসা করেন, পরের লেখাগুলোয় শুধু লাইক দেন। তারপরে নিরুত্তর হয়ে যান। নিশীথ ভাবে – হতেই পারে, কোনও কারণে অমরেশদার কাছে লেখাগুলো পৌঁছচ্ছে না। একটা ছোটগল্প নিজেই বেশ ভালো হয়েছে মনে করে সে অমরেশ লাহিড়ীকে পড়তে অনুরোধ জানিয়ে ‘মেনশন’ করে দেয় সাহস করে। রাতে উত্তর আসে – ‘এখন একটু ব্যস্ত আছি ভাই। সময় করে পড়ে নেব, কেমন?’ বিব্রত হয় নিশীথ। তারপরে অধীর আগ্রহে অগ্রজ সাহিত্যিকের প্রশংসার অপেক্ষা করতে করতে একসময় ভুলে যায় সে।
দিন পনের আগে স্কুলের ফেসবুকে নিশীথ লক্ষ্য করল জানুয়ারির বাইশে রি ইউনিয়ন। হরেক অনুষ্ঠানের মাঝে দুপুরে সাহিত্যসভার প্রধান আকর্ষণ অমরেশ লাহিড়ী। বিষয় – ‘সোশ্যাল মিডিয়ার বেনোজল বাংলা সাহিত্যের কতটা ক্ষতি করছে’। শিরোনাম দেখে একটু টলে গেলেও ভোরের লোকাল ধরে কেশনগর থেকে কলকাতায় চলে আসে নিশীথ। কোনও আমজনতার ভিড়ে নয়, নিজের স্কুলের গণ্ডিতে দাদার সাথে আজ আলাপ হবে। অবশ্য শুধু নিষ্কাম লেখক-দর্শন নয়, একটু দ্বিধাগ্রস্ত ধান্দাও আছে মনে। এতগুলো ভালো ভালো লেখা লিখেছে সে – এত সাধুবাদ ত সবাই এমনি এমনি দেয় না। অমরেশদা একটু বলে দিলে কোনও ছোটখাটো পাবলিশারও কি তার ক’টা গল্প ছেপে দেবে না! নাহয় সে নিজেও কিছু… এরকম ত হয় সে শুনেছে।
সকালে স্কুলের কচিদের নানা প্রতিযোগিতার পরে বারোটা থেকে সাহিত্যবাসর। দুটো থেকে চারটে প্রাক্তনীদের পনের-পনের ওভারের ম্যাচ। তারপর জলসা। সাড়ে বারোটায় খবর পেল অমরেশদা আসছেন। কি বলবে সে – আপনি, না তুমি! ভাবতে ভাবতেই স্কুলগেট দিয়ে সটান মাঠের উপরে উঠে আসে বেস্ট সেলার সাহিত্যিকের দুধসাদা ইনোভা। লাফ দিয়ে নামে দুজন কালো পোশাকের বাউন্সার। বাংলা সাহিত্যিক বাউন্সার নিয়ে ঘোরেন! তাও নিজের স্কুলে! চোখ কচলে দেখার আগেই দ্রুত মঞ্চে উঠে যান অমরেশ লাহিড়ী। সুললিত বাছাই শব্দে, অতি মার্জিত ভঙ্গীতে পেশ করেন ওঁর বক্তব্য – ফেসবুক ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার এই রাক্ষুসে আগাছা-সাহিত্য অচিরে বন্ধ করতে না পারলে বাংলা সাহিত্য সরস্বতীর বিসর্জন অতি আসন্ন এবং অনিবার্য। কারণ, পাঠককুল প্রকৃষ্ট সাহিত্যের গোদুগ্ধ ত্যাগ করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাগনার পিটুলিগোলা পান করছেন গোগ্রাসে। প্রচুর হাততালি পড়ল, পড়ার কথাও তাই ছিল।
বক্তৃতা শেষে অমরেশের প্রস্থানের সময় কর্তাদের ধরাধরি করে, ভিড়ের গুঁতো খেয়ে, গাড়িতে ওঠার ঠিক আগে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায় নিশীথ। “দাদা, আমি নিশীথ। আপনার ছ বছরের জুনিয়র।” ঘাড়ের উপরের নবলব্ধ উত্তরীয় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসু চোখে তাকান অমরেশ। প্রশ্ন বুঝে লোকের ঠেলা খেতে খেতে দ্রুত উত্তর দেয় নিশীথ – “সেই যে ফেসবুকের গল্পগুলো – অনিকেত, তিন ছক্কা, ভরাডুবি – আপনি অনেক প্রশংসা করেছিলেন গল্পগুলোর – আমি সেই নিশীথ বটব্যাল।” বাউন্সার এবারে হাত ধরে টানছে। অমরেশদার কিচ্ছু মনে পড়ছে না! তবে যে একটা গল্পের কমেন্টে লিখেছিলেন – ‘আমি ভাই তোমার নিয়মিত পাঠক হয়ে পড়ছি’! গাড়ির দরজা খুলল, দৃঢ় বাহুতে আরেক বাউন্সার সরিয়ে দিল নিশীথকে। গাড়িতে উঠতে উঠতে বেস্ট সেলার লেখক বললেন – “আপনি লিখতে থাকুন ভাই। এক্ষুণি বললাম না, সৎ দায়বদ্ধ সাহিত্যের কদর চিরদিন থাকবে।” দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই চাকা গড়ায় গাড়ির। কয়েক ডজন চোখের সামনে থেকে কোনওরকমে পালিয়ে স্কুল গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে নিশীথ। ঘড়ি দেখে। তিনটে সাতের কৃষ্ণনগর লোকালটা ধরা যাবে এখুনি একটা বাস পেয়ে গেলে।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পরে পাশে বসা সেক্রেটারি অনুপ্রিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন অমরেশ লাহিড়ী – “কি নাম বলল রে লোকটা?” “নিশীথ বটব্যাল, দাদা।” – উত্তর দেয় অনুপ্রিয়া। “ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ভাগা। আর এরপর থেকে গদগদ কমেন্টগুলো লেখার সময় একটু খেয়াল রাখবি। কাশী, টেনে চালাও। গ্রিনটাউন। সি এম আসছেন।” উত্তরীয় ঘাড় থেকে নামিয়ে পিছনে গা এলিয়ে দেন অমরেশ।
*******************************************
তিন।
কালচৈত্র।
মাঠের আর এক কোণে জটলা করে বসে ছিল তুষার দের ব্যাচটা – তুষার, সুজন, নিখিলেশ, অসীম, চন্দ্রজিৎ.. আরও কয়েকজন। তুষার বহুবছর মুম্বই প্রবাসী। ওষুধ কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রায় দশ বছর পরে জানুয়ারির এই তৃতীয় রবিবারটায় কাকতালীয়ভাবে সে আজ কলকাতায়। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র সুজনের সাথেই যোগাযোগ ছিল ওর। সুজনই জোর দিয়ে বলল – ‘চলে আয়। কতদিন সামনাসামনি দেখা হয়নি। সবাই মিলে গ্যাজানো যাবে।’ বরাবরই চতুর, বলিয়ে কইয়ে তুষার ছিল বন্ধুদের এইসব আসরে মধ্যমণি। অতএব আসা। তাছাড়া আজ সন্ধ্যায় কিছু করারও নেই।
চন্দ্রজিৎ এর সাথে দেখা তিরিশ বছর পরে। চোখাচোখি হল, ওই পর্যন্ত। চন্দ্র ব্যাঙ্কিং এ আছে, সেটাও জানা গেল আড্ডার ফাঁকে। এতকালের পুরানো কথা হ্যাজ করতে বসলে স্থান-কাল-পাত্রের তাল থাকে না। একথা থেকে সেকথা শাখা-প্রশাখা ছড়াতে ছড়াতে কোন গাছের ডাল কোথায় গিয়ে জড়িয়ে যায়। কথার তোড়েই যেন কতকটা মুখ ফসকে বলে ফেলে তুষার – “হ্যাঁরে চন্দ্র, তোরা এখনও ভবানীপুরের ওই বাড়িতেই থাকিস ত?” বলেই চমকে উঠল, কিন্তু ছিলা ছেড়ে তীর বেরিয়ে গেছে। মাথা তুলে সোজা তাকিয়ে চন্দ্রজিৎ সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় – “হ্যাঁ, ওখানেই”। সিগারেট খাওয়ার নাম করে স্কুল গেটের বাইরে বেরিয়ে আসে তুষার।
দুটো আলাদা সেকশনে পড়লেও ছোটবেলা থেকেই চন্দ্রজিৎ আর তুষার গলাগলি জুড়ি। অঙ্কের মাষ্টারমশাই শৈলেশবাবুর কল্যাণে চন্দ্রজিৎদের ভবানীপুরের বাড়িতে তুষারের যাতায়াত নিয়মিত হল ক্লাস নাইন থেকে। শৈলেশবাবু থাকতেন চন্দ্রজিৎদের বাড়ির পাশেই – ওদের বাড়িতে বসেই চন্দ্র, তুষার, হিমাংশু আর চন্দ্রর এক বছরের বড় ছোড়দি চন্দনাকে অঙ্ক করাতেন উনি। বাড়তি আকর্ষণ ছিল চন্দ্রর মা’র জলখাবার। কখনও ঘুগনি, কখনও অল্প চিনেবাদাম আর আলুর টুকরো দিয়ে চিঁড়ের পোলাও, এক আধদিন ডিম পাঁউরুটি – যাকে বড় হয়ে তারা জেনেছে ফ্রেঞ্চ টোস্ট বলে। তারপরে মেঝেতে বসে চারজনে একঘন্টা ক্যারম পেটানো। তুষার ছিল চন্দনার বাঁধা পার্টনার। স্কার্টটা টানটান করে সরস্বতী ঠাকুরের মত হাঁটু মুড়ে বসে, সামনে ঝুঁকে, মাথার সামনে চলে আসা চুলের সরু গোছটা আলতো করে সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে স্ট্রাইক নিত ছোড়দি। চোদ্দর তুষারের কিশোর বুকে রক্ত ছলাৎ ছলাৎ। লক্ষ্যভ্রষ্ট হত অনবরত আর সেইজন্য শাস্তিও ছিল বাঁধা – সিনিয়র পার্টনার চুলের মুঠিটা ধরে আস্তে করে ঝাঁকিয়ে দিত মাঝে মাঝেই – “অ্যাই হাঁদা, মন দিয়ে খেল”। কণ্ঠস্বর সুন্দর হলেও গলায় সুর ছিল না তুষারের। তাই আবৃত্তি প্র্যাকটিস করত খুব। সেখানেও বাঁধা শ্রোতা ছোড়দি চন্দনা। খুব ভালো লাগলে তুষারের গালটা টিপে বলত – “এক্সেলেন্ট, হাঁদারাম”। মাধ্যমিকের পরে হিউম্যানিটিজ নিয়ে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে গেল ছোড়দি – অঙ্ক ক্লাসের দল গেল ভেঙে, পড়ার চাপে ক্যারমও স্থগিত হল। তবে আবৃত্তি শোনানো চলত, জলখাবার এর ফাঁকে ফাঁকে। কখনও দেবতার গ্রাস, কখনও ক্যামেলিয়া, কখনও ঝুলন।
মাধ্যমিকের পরে সে আমলে প্রায় আড়াই মাস ছুটি। বন্ধুর বাড়ি যেতে তখন ফোন লাগত না – হুট বলতে যাওয়াটাই ছিল রেওয়াজ। এপ্রিলের এক দুপুরে চন্দ্রজিৎ এর বাড়িতে কড়া নাড়ল তুষার। দরজা খুলল ছোড়দি। বন্ধু আছে কিনা জিজ্ঞাসা করাতে একটু যেন থমকে উত্তর দিল -“আছে, আয়।” মিনিট কয়েক পরে তুষার বুঝল বাড়ি ফাঁকা। আসলে কেউই নেই। মিথ্যে বলার কারণ জানতে চাইলে ছোড়দি চোখ বড় করে হেসে উত্তর দিল “এমনি এমনি। ভাই এখুনি চলে আসবে। ততক্ষণ তুই কবিতা শোনা। নতুন কি শিখলি বল।” সোফায় এসে তুষারের গা ঘেঁষে বসল চন্দনা। মাধ্যমিকের অবসরে তুষার তখন পড়ছে শেষের কবিতা। ষোলর কিশোর সামান্য কিছু বোঝে, বেশিটাই বোঝে না। কি হয়ে গেল ওর মধ্যে কে জানে, আবেগমথিত গলায় আরম্ভ করল, “প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।” শেষ করতে করতে দেখল ছোড়দি চন্দনার নিঃশ্বাস গাঢ়। মুখ আরক্ত, ঘর্মাক্ত। কেমন অস্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল তুষারকে, “তুই এর মানে বুঝিস, হাঁদা গঙ্গারাম?” বিমূঢ় তুষার যেন আসন্ন ঝড় আন্দাজ করে বলল – “না, না, এমনি পড়লাম”। “আমি তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি” বলে তুষারের আরও কাছে এগিয়ে এল চন্দনা। তারপর শেষ চৈত্রের বাউল বাতাসে সর্বনাশা আগুন খেলা।
এর পরের গল্প খুব সংক্ষিপ্ত। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মাসিমা ফিরে এলেন ম্যাটিনি শোয়ের টিকেট না পেয়ে। দুজনের চেহারা দেখে অভিজ্ঞ চোখের কিছু ভুল হল না।গম্ভীর গলায় বললেন -“বাড়ি যাও তুষার। এ বাড়িতে আর কোনওদিন এসো না।” উচ্চ মাধ্যমিকে পুরানো স্কুল ছাড়িয়ে চন্দ্রজিৎ কে ভর্তি করা হল অন্য স্কুলে। এদিকে স্কুল কলেজের পালা মিটিয়েই তুষার হল প্রবাসী। চন্দ্রর সাথে আর দেখা হয়নি। চন্দ্র বা দিদির খবর কাউকে জিজ্ঞাসা ও করতে পারেনি সে।
তুষার ভাবছিল সিগারেট টা খেয়েই একেবারে বেরিয়ে যাবে। সুজনকে কিছু একটা বলে দিলেই হবে পরে ফোন করে। অন্য কেউ ওর খোঁজ করবে না। ও এখন সবার আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড। হল না। শেষ টানটা দেওয়ার আগেই পাশে এসে দাঁড়াল চন্দ্রজিৎ। তুষার আড়ষ্ট। কঠিন মুখে চন্দ্র জিজ্ঞাসা করল – “ছোড়দির খবর জানতে চাইলি না?” তুষারের পা যেন তুষারাহত। চুপ করেই থাকে সে। তুষারের চোখে চোখ রেখে, গলার মাফলারটা ঠিক করে নিয়ে, বাঁকা হেসে চন্দ্রই কথা শুরু করে আবার – “শুনেই যা। দেখা হল যখন। উচ্চ মাধ্যমিক আর পড়া হয়নি ছোড়দির। দু মাসের মধ্যেই মা বিয়ে দিয়ে দিল। ওর থেকে আঠেরো বছরের বড় আগরতলার এক দোজবর প্রোমোটারের সাথে। সে ভদ্রলোক কেমন ছিলেন আলোচনা করে আর লাভ নেই। পঞ্চাশেই গন ফট্। শালা মারা যাওয়ার তিন দিন আগে জানা গেলএইডস্। ছোড়দিও পজিটিভ। ও তখন বত্রিশ, দুটো বাচ্চার মা। এইডস্ ওয়ালা বউকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ভাগিয়ে দিল বাচ্চা সমেত। ব্যাক টু ভবানীপুর। মা পর্যন্ত ওকেই দায়ী করত যাচ্ছেতাই বলে, সেই দুপুরের খোঁটা দিয়ে। তাও পিজি থেকে গুচ্ছের ওষুধপত্র খেয়েদেয়ে ভালই টানছিল। দু হাজার কুড়িতে টিবি হল। ওই কি একটা আছে না, কোনও ওষুধ কাজ করেনা, সেই টাইপের টিবি। একুশের মে তে ওই অবস্থায় কোভিড। ফিনিশ। আমি আর বিয়ে থা করিনি – সরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করে দুটো ভাগ্নে-ভাগ্নী সামলে নিজের সংসার করা যায়না।”
থেমে থেমে একটানা বলে থামল চন্দ্রজিৎ। তুষারের দুহাত রাস্তার রেলিং ধরে। সিগারেট শেষ। চারপাশের পৃথিবীর সব কিছু যেন পাক খাচ্ছে আঠাশ বছর আগের এক চৈতী দুপুরের পাঁচ মিনিটের ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে। কোনও কথা বলার নেই, বলা যায়ও না। সময় যেন অন্তহীন। আবারও নীরবতা ভাঙল চন্দ্রজিৎ ই। “চলি। ভালো থাকিস। এই বয়সে এসে তোর প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই।” বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিল চন্দ্র।