(পূর্ব প্রকাশিতর পরে)
কথাটা একটু বিতর্কিত জায়গায় যেতে চলেছে এবার।
আমাদের কোনো নৈতিক সিদ্ধান্ত বা অবস্থানকেই ইতিহাস বা সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা উচিত নয়। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যে সব ডাক্তাররা অনায়াসেই হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ‘নাৎসি ডাক্তার’, মনে রাখুন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কিছু চিকিৎসক, সেরা মানের কয়েকজন চিকিৎসক-গবেষক বা চিকিৎসক-শিক্ষকেরা। ব্যক্তিজীবনে বা পারিবারিক জীবনে তাঁরা খুব নিকৃষ্ট শ্রেণীর প্রাণী ছিলেন, এমন মনে করার কারণ দেখি না। তারপরও এমনটা হতে পারল কী করে?
বাজারচলতি একটা ধারণা আছে, যে, বিজ্ঞান একটা অরাজনৈতিক ব্যাপার, এবং বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বলতেও, সেই বিজ্ঞান-ই। বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের উদ্দেশে বা ‘বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ’-এর লক্ষ্যে চলতে না দিয়ে তার মধ্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ এসে পড়লে তা আর বিজ্ঞান থাকে না। ভুলের শুরুটা এখান থেকেই।
বিজ্ঞান, বিশেষত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন বিজ্ঞান, এবং যাকে বলা যায় মূলধারার বিজ্ঞান – তা অবশ্যই সমকালীন রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের হাতে যে বিজ্ঞান জনগণের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে – দমনমূলক রাষ্ট্রনীতির হাতে সেই একই বিজ্ঞান বিপজ্জনক হয়ে ওঠে – কর্পোরেট বিনিয়োগের (সেও তো রাষ্ট্রই হয়ে দাঁড়িয়েছে একপ্রকার) নিয়ন্ত্রণে সেই বিজ্ঞানের এক এবং একমাত্র মোক্ষ হয়ে দাঁড়ায় মুনাফা, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বা অজস্র প্রাণের বিনিময়ে হলেও মুনাফা (হাতেগরম উদাহরণ হিসেবে রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের অবাধ প্রয়োগ, জেনেটিকালি মডিফায়েড শাকসব্জির কথা ও তজ্জনিত অসুখবিসুখের কথা বলা যায়)। বৃহত্তর অর্থে বিজ্ঞান ও বিশেষত বিজ্ঞানীর দায় বা কর্তব্য নিয়ে আলোচনা বর্তমান লেখার বিষয় নয় – এই লেখা চিকিৎসা তথা চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে।
চিকিৎসা বিষয়টা প্রথাগত বিজ্ঞানের থেকে খানিকটা আলাদা হলেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়। চিকিৎসকের রোজকার ওঠাবসা বিজ্ঞান নিয়ে হলেও, তাঁর কাজ সেই বিজ্ঞানকে সামনের মানুষটির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা – যে মুহূর্তে তাঁকে মাথায় রাখতে হয় বিজ্ঞানের বাইরে অনেক কিছু। চিকিৎসা বা চিকিৎসকের দায়কে স্রেফ বিজ্ঞানে পর্যবসিত করে ফেলা গেলে রাষ্ট্রের পক্ষে ব্যাপারটা সুবিধের হয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখব, শুধুমাত্র নাৎসি জার্মানিতেই নয়, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসক-ভূমিকা বিস্মৃত হয়ে রাষ্ট্রের হাতে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন – নিজের সাথে সঙ্ঘাতের মুহূর্তে বা পরবর্তীতে বিচারের মুখোমুখি হয়ে সান্ত্বনা খুঁজেছেন নিজেকে বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রয়াসে। কিন্তু, সে তো পরের কথা। আপাতত, নাৎসি জার্মানিতে ফেরা যাক।
নাৎসি জার্মানির রাজনৈতিক চেহারার নীচে যে খড়মাটির দর্শনগত কাঠামো, তার মূল ছিল রেসিয়াল হাইজিনের তত্ত্ব। জাতিগত শুদ্ধতা বলতে, একটি জাতি বিবর্তনগতভাবেই বাকি জাতির তুলনায় উন্নত – এবং দুনিয়ার কর্তব্য সেই উন্নত জাতির সামনে মাথা নত করা। পাশাপাশি, দুনিয়ার সামনে সেই সম্ভ্রমের যোগ্য দাবিদার হয়ে উঠতে হলে, সে জাতির দায়িত্ব নিজেদের শুদ্ধতা রক্ষা করা। এই পরিস্থিতিতে, নির্ভেজাল শুদ্ধতা যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে ভেজাল দূর করা এবং ভেজাল আসতে পারে যে সব উৎস হতে, সেগুলোকেও নির্মূল করা জরুরী – একইসাথে, দুর্বল উপাদানগুলোকেও ছেঁটে ফেলে স্রেফ সবল এবং যোগ্য উপাদানগুলিকেই রক্ষা করা কর্তব্য। এই ‘যোগ্য’, ‘উন্নত’, ‘সবল’ উপাদানের উৎস কী? খুবই সরল ব্যাপার – সে উপাদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয় – অর্থাৎ জিন। একইসাথে বলা হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে, যারা উন্নত জিনের অধিকারী, তাঁরা কম সংখ্যায় সন্তান উৎপাদন করছেন, আর যারা অনুন্নত জিনের অধিকারী, তাদের পরিবারপিছু সন্তানের সংখ্যা বেশী (একইরকম কথা আজকাল আশেপাশে খুব শোনা যায়, তাই না?)। এরকম চলতে থাকলে কোনো একদিন সমগ্রভাবে জাতিটিই দুর্বল হয়ে পড়বে। সুতরাং, অযোগ্য উপাদান যাতে প্রবাহিত না হতে পারে, সেই উপাদানের অধিকারীদের সন্তানোৎপাদনে অক্ষম করা প্রয়োজন – পরবর্তী সময়ের সিদ্ধান্তানুসারে, অযোগ্য উপাদানের নজিরসমূহকে রাষ্ট্রের পয়সায় খাইয়েপরিয়ে বাঁচিয়ে রাখাই যেহেতু নিষ্প্রয়োজন, তদনুসারী ব্যবস্থাগ্রহণ। মূল চিন্তাক্রম বলতে এই।
মনে রাখা যাক, রেসিয়াল হাইজিনের তত্ত্ব শুরু হয় জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে এবং এর মূলে ছিল উন্নত মেধাকে শিরোধার্য করার আবেদন – মেরিটোক্রেসি। পরবর্তীতে একেই ইহুদি-জাতিবিদ্বেষে বদলে দেওয়া হয় – যদিও, মেধার বাজারচলতি মাপকাঠি অনুসারে ইহুদিরা, সম্ভবত, গড়পড়তা ‘আর্য জার্মান’-এর থেকে এগিয়েই ছিল, কেননা সেদেশে বিজ্ঞান বা গবেষণার শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই ছিল ইহুদি বিজ্ঞানী-গবেষকের দখলে – জনসংখ্যায় ইহুদিদের অনুপাতের চাইতে ঢের বেশী অনুপাতে। কিন্তু, সে আলোচনা এখুনি অপ্রাসঙ্গিক। আমরা সেই মুহূর্তে চিকিৎসকদের অবস্থানটা ফিরে দেখতে চাইছি।
সামনের মানুষটি যোগ্য নাকি অযোগ্য গুণাবলীসম্পন্ন এই বিচারের মনোভাব থেকে চিকিৎসক যখন রোগীর মুখোমুখি হন, তখন তিনি আর চিকিৎসক নন, তিনি বিচারক। দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা বিচারের মুহূর্তে একইসাথে কাঁদেন কত শতাংশ ক্ষেত্রে, সে নিয়ে তর্ক বাড়ানোই যায় – কিন্তু, কঠোর দণ্ডবিধানের জন্যে বিচারককে আলাদা করে নৃশংস বলার মানে হয় না। অতএব, সমস্যার মূলে যদি পৌঁছাতে চাই, তাহলে চিকিৎসক-বিচারক ঠিক কী কী কাজ করেছিলেন, তার চাইতে আরো বেশী করে দেখা দরকার, ঠিক কেন ও কোন পথে চিকিৎসক এমন নির্মম বিচারক হয়ে উঠলেন। আর, আলোচনা এজন্যেই আরো জরুরী, কেননা চিকিৎসক যদি নৈর্ব্যক্তিক ও জাজমেন্টাল হয়ে ওঠেন, তাহলে, হুবহু নাৎসি অত্যাচারের পর্যায়ে না পৌঁছালেও, চিকিৎসক আবারও এবং বারবারই অন্ধকারের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারবেন।
আরো একবার বলে নেওয়া যাক, নাৎসি জার্মানির মূল আদর্শের মধ্যে ছিল একপ্রকার বিকৃত ডারউইনবাদের চর্চা। ন্যাচারাল সিলেকশনের তত্ত্বে প্রজাতির টিকে থাকার পক্ষে (এবং প্রজাতির বংশবৃদ্ধির পক্ষে) সবচাইতে উপযোগী জিনটি প্রবাহিত করার ধারণা ছিল অবশ্যই – কিন্তু অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে অনিবার্য উপাদান টাইম-স্কেল, যেকথা মাথায় না রাখলে ধারণাটিই বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। দুই কি তিন কি চার প্রজন্মের মধ্যেই ইভোলিউশন-এর ধারণা কার্যকরী করে ফেলা সম্ভব, এ ধারণা সর্বৈব ভুল। পাশাপাশি, আপনার কাছে যে জিনটি ভারী উপকারী বলে বোধ হচ্ছে, অতি দীর্ঘ মেয়াদে ঠিক সেই জিনটি আপনার প্রজাতির পক্ষে অমন কাজের জিন বলে প্রতিপন্ন নাও হতে পারে। অতএব, তথাকথিত ‘অনুন্নত’ মানুষ বেশী হারে বংশবৃদ্ধি করছেন বলে ‘অনুন্নত’ জিন প্রবাহিত হয়ে যেতে পারে আর সেই অধোগামী নির্বাচন পদ্ধতিকে মোকাবিলা করার জন্যে জরুরী ‘সঠিক নির্বাচন’ – অর্থাৎ ‘অনুন্নত’ মানুষদের সন্তানোৎপাদনে অক্ষম করে তোলা, বা মেরে ফেলা এবং ‘উন্নত’ মানুষদের বেশী করে সন্তান উৎপাদনে উৎসাহী করে তোলা – উন্নত সমাজ গড়ে তোলার এই পথটিই ভ্রান্ত।
কিন্তু, লক্ষ্য করুন, কথাগুলো আপাত বিজ্ঞানের – এবং পরিভাষাসমূহ জীববিদ্যার, বায়োলজির। এই তত্ত্বের অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারেন নি অধিকাংশ চিকিৎসকই।
আসলে, নাৎসি দর্শনের মূলে বায়োলজির প্রয়োগ ছিল অহরহ। একটি ধারণা নাৎসি রাষ্ট্রভাবনার মধ্যেই ছিল – নাৎসি রাষ্ট্র হবে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম তথা বায়োলজির অনুসারী – অর্গ্যানিক। যেমন, নাৎসি রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবনযাপন হবে প্রকৃতিকে মান্যতা দিয়ে। হিটলার, আশা করি জানেন, ছিলেন নিরামিষাশী। নিরামিষ ভোজন ও ফলাহারের, এককথায় প্রাকৃতিক আহার্য গ্রহণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। নিয়মিত শরীরচর্চার কথা বলা হত। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি সংরক্ষণের আইন পাস হয়েছিল। মহিলাদের প্রসাধনীর ব্যবহার কমাতে উৎসাহ দেওয়া হত। ধূমপানের বিপদগুলো বিশদে জানার অনেক আগেই নাৎসি জার্মানি ধূমপানের বিরুদ্ধে নাগরিকদের সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। ইন ফ্যাক্ট, জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যকর অভ্যেস গড়ে ক্যানসারের হার বেশ কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল নাৎসি জার্মানি।
আবার এই অর্গ্যানিক রাষ্ট্রের তত্ত্বের মধ্যেই ছিল বিদ্বেষের বীজ। মানবশরীর ঠিক যেমন করে শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর উপাদান তথা জীবের বিরুদ্ধে লড়াই করে – এবং তাদের মেরে ফেলতে চেষ্টা করে – ঠিক তেমনভাবেই জৈব-সমতুল নাৎসি রাষ্ট্র ক্ষতিকর উপাদান তথা মানুষদের নিকেশ করতে চেষ্টা করবে, এমনটাই ছিল ঘোষিত।
অর্থাৎ, রাষ্ট্র একবার কোনো জনগোষ্ঠীকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে ফেললে – এবং সেই চিহ্নিতকরণকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে মান্যতা দিয়ে ফেলতে পারলে – তাদের মেরে ফেলার ক্ষেত্রে আলাদা করে আপত্তিকর কিছু থাকে না। অন্তত একবার যদি আপনি এই রাষ্ট্রীয় মডেলটিকে আগাপাশতলা মেনে নিতে শুরু করেন, তাহলে ক্ষতিকর মানুষদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা বা মেরে ফেলা খুবই স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়, তাই না? (মাথায় রাখুন প্লীজ, এই মডেল হুবহু কপি না হলেও, উনিশ-বিশ বদল ঘটিয়ে বিভিন্ন সময়ই পেশ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে – এবং এখনও হয়ে চলেছে।)
ঠিকঠাক গুছিয়ে পেশ করা গেলে এই প্রাকৃতিক-জৈবিক রাষ্ট্রের মডেল যে চিকিৎসক বা চিকিৎসক-গবেষকদের মনে ধরবে, সেটা কি খুব অবিশ্বাস্য ঘটনা? বিশেষত, যদি চিকিৎসকরা একবার বিশ্বাস করে নিতে থাকেন, যে, অসুখের চিকিৎসার বাইরে তাঁদের আর কোনো দায় নেই, রোগ সারানোর চিন্তার বাইরে তাঁদের আর কিছুই বিবেচ্য নয় – তারপরেও??
(চলবে)
ভাবছিলাম একদম শেষ হলে লিখবো। অসাধারণ বিশ্লেষণ।
Ek nishswashe 4 tei pore fellam.. waiting for the rest