আগেরদিন আন্দ্রেই তারকভস্কির সাক্ষাৎকার শুনছিলাম – ইউটিউবে – আমার চোখে, সম্ভবত, মহোত্তম চিত্রপরিচালক। তাঁর ছবির চরিত্রের মধ্যে তাঁর ছেলেবেলা কতখানি মিশে আছে, এই প্রশ্নের উত্তরে একটা অদ্ভুত ছাড়াছাড়া গলায় বলছিলেন –
…আমার মনে হয় প্রতিটি শিল্পীই তাঁর সৃষ্টির উপাদান তুলে আনেন নিজের শৈশব থেকে… মানে তিনি যে মাধ্যমেই সৃষ্টি করুন না কেন, তার উৎস সেই শৈশব বা কৈশোর, সেই স্মৃতি… যাঁর ছেলেবেলার স্মৃতি তেমনভাবে নেই, বা যিনি ছেলেবেলার স্মৃতিতে ফিরে যেতে পারেন না সেভাবে… আমি ঠিক জানি না, তিনি নিজের শিল্পকে সৃষ্টি করবেন কী করে…
এই সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতেই টাটকা পড়া একটি স্মৃতিচারণ আমার মনে আরো একবার ভেসে উঠল। এভা মোজেস কর নিজের ছেলেবেলার কথা বলেছেন, ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির টুকরো। না, তাঁর লক্ষ্য কোনো মহৎ শিল্পকর্ম সৃজন নয় – লক্ষ্য নেহাতই আটপৌরে – চিকিৎসক হিসেবে যাঁরা রোগীর সামনে দাঁড়াবেন, তাঁদের নিজের কর্তব্যটুকু মনে করিয়ে দেওয়া।
এভা মোজেসের বয়ানে যাওয়া যাক –
পৃথিবীর কোনো কিছুই কোনো মানুষকে আউশভিৎসের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে পারে না। আপনার সবচেয়ে ভয়ানক দুঃস্বপ্নও মেনগেল-এর ল্যাবরেটরিতে আমার যে বাস্তব অভিজ্ঞতা, তার কাছে নস্যি। আমি তো একটা ছোট্ট মেয়ে ছিলাম, ন’বছর মাত্র বয়স – কিন্তু আমাকে বড় হয়ে উঠতে হয়েছিল দ্রুত। প্রতিমুহূর্তে জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যে শিশুদের, তাদের যে বেড়ে উঠতেই হয় তাড়াতাড়ি। আমি অনেক জায়গাতেই বলেছি, আমাদের, অর্থাৎ মেনগেল-এর পরীক্ষার যমজ বাচ্চারা (মানে, তার মধ্যে যারা বেঁচে রয়েছি), না, আমাদের কোনো ছেলেবেলা নেই। শৈশব বা কৈশোরের বিস্ময়ের দিনগুলোর কথা বলতেই আমাদের মনে পড়ে খুব উঁচু চিমনি, মাংস পোড়ার গন্ধ, অজস্রবার আমাদের শরীর থেকে রক্ত নেওয়া, অসংখ্য ইনজেকশন, ল্যাবে পরীক্ষার পর পরীক্ষা, উকুন, ইঁদুর আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ।
তারকভস্কি-কথিত পরিণত মানবজীবনের সৃজনশীল চর্চায় বাল্যস্মৃতির অনিবার্য গুরুত্ব মাথায় রেখেই এভা মোজেসের স্মৃতিচারণে এগোতে থাকি –
….১৯৪৪ সালের বসন্তকাল। আমরা এসে পৌঁছাই আউশভিৎস-বির্কেনাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সাথে সাথেই আমাদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয় – আমরা, অর্থাৎ আমি আর আমার যমজ বোন। আরো দেড়হাজার যমজ ভাইবোনের সাথে আমরা ডাঃ মেনগেল-এর পরীক্ষার বিষয় হয়ে উঠি – না, ঠিক পরীক্ষার বিষয় নয়,,আমরা হয়ে উঠি তাঁর ল্যাবরেটরির আরো একজোড়া গিনিপিগ।…
…সপ্তাহে তিনবার আমাদের রক্তপরীক্ষার জন্যে নিয়ে যাওয়া হত। আমার দুটো হাতই বেঁধে দেওয়া হত – একহাতে ইনজেকশন দেওয়া হত, আরেকহাত থেকে রক্ত নেওয়া হত – একেকবারে অনেকখানি করে রক্ত নেওয়া হত – দুই শিশি বা তারও বেশী। আমি অনেক যমজকে চোখের সামনে অজ্ঞান হয়ে যেতেও দেখেছি – স্রেফ বেশী রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার কারণে। পরে শুনেছিলাম, শরীর থেকে নিয়মিত কতখানি রক্ত বেরিয়ে গেলেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, মেনগেল তখন পরীক্ষা করছিলেন সে নিয়েই।…
…সপ্তাহে আরো তিনবার নিয়ে যাওয়া হত আউশভিৎস ওয়ানের ল্যাবে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্যে – গড়ে আট থেকে দশ ঘন্টা চলত সেসব পরীক্ষা। আমাদের সবাইকে – বয়সে সবাই অবশ্য বাচ্চা – উলঙ্গ করে একটা বড় ঘরে দাঁড় করানো হত। শরীরে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাপা হত, ছবি তোলা হত, দাগ দিয়ে রাখা হত, চার্টের সাথে তুলনা করে দেখা হত। আমাদের প্রতিটা নড়াচড়া লিখে রাখা হত। নিজেদের মানুষ নয়, মনে হত স্রেফ একটা রক্তমাংসের ডেলা। আউশভিৎস ওয়ানের ল্যাবের এই পরীক্ষানিরীক্ষার দিনগুলো মানসিকভাবে খুবই কষ্টকর ছিল – কিন্তু যদি জানতে চান, তাহলে বলব, ওই রক্তপরীক্ষার ল্যাবেই আসল প্রাণঘাতী পরীক্ষার কাজগুলো হত।…
…ওই ১৯৪৪ সালেরই জুলাই মাসে একবার আমাকে কিছু একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। সন্ধে নাগাদ আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। প্রচন্ড জ্বর, কাঁপুনি। নড়াচড়া তো দূর, ঠিক মতো চিন্তাও করতে পারছিলাম না। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল রক্তপরীক্ষার ল্যাবে। অন্যান্য দিনের মতো সেদিন আর আমার হাত বাঁধা হল না। আমার জ্বর মাপা হল। আমি প্রাণপণে লুকোনোর চেষ্টা করছিলাম আমার অসুস্থতার ব্যাপারটা – কেননা, অসুস্থতা মানেই হাসপাতাল আর হাসপাতাল থেকে কেউ বেঁচে ফিরত না। কিন্তু আমার জ্বর এতটাই বেশী ছিল, যে, হাসপাতালে আমাকে যেতেই হল। হাসপাতালে ডাঃ মেনগেল আমাকে দেখতে আসতেন। দিনে দুবার। সাথে আরো চারজন ডাক্তার। না, কেউই আমাকে ছুঁয়ে দেখতেন না, শুধুই জ্বরের চার্ট দেখতেন আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। আমাকে খাবার বা জল বা কোনো ওষুধ কিছুই দেওয়া হত না। একজন ডাক্তার আর সামনেই ব্যঙ্গের সুরে অন্যকে বলছিলেন, খারাপ লাগছে, এটার আয়ু আর বড়জোর হপ্তাদুয়েক। কিন্তু, আমি জানতাম, আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে, আমাকে সুস্থ হতেই হবে, আমাকে আমার যমজ বোন মিরিয়মের সাথে দেখা করতেই হবে। কেননা, আমি জানতাম, আমার মৃত্যু হলেই ডাঃ মেনগেল মিরিয়মের হৃদপিণ্ডে ফেনল ইঞ্জেকশন দিয়ে ওকে মেরে ফেলবেন – আর তারপর শবব্যবচ্ছেদ করতে বসবেন – ইঞ্জেকশনের ফলে রোগগ্রস্ত আমার অঙ্গগুলির সাথে মিলিয়ে দেখবেন মিরিয়মের অঙ্গ। আমার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে, হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছি আমি – জ্ঞান হারানো আর জ্ঞান ফিরে আসার মাঝে নিজেই নিজেকে বারবার বলছি, আমাকে বাঁচতেই হবে, আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। ঘরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তের জলের কলের কাছে ঘষটে ঘষটে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছাতাম। আমাকে বাঁচতেই হবে, বেঁচে থাকতেই হবে। এরকম করে দু”সপ্তাহ কাটানোর পর আমার জ্বর ছাড়ে। বোনের সাথে আবারও দেখা হয়। ভাগ্যিশ! এর আর মাত্র ছ’মাসের মাথাতেই আউশভিৎস থেকে আমাদের উদ্ধার করে রাশিয়ান সৈন্যরা।…
মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এই স্মৃতিচারণ যিনি করছেন, করছেন ঘটনার চার দশকেরও বেশী সময় পরে। এবং ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র নয় বছর।
ঘটনার ডাক্তার যিনি, তিনি ডাঃ জোসেফ মেনগেল। তৃতীয় রাইখের পতনের পর এভা মোজেসের মতো অনেকেই মুক্তি পান এবং নাৎসি চিকিৎসকদের মধ্যে অনেককেই গ্রেফতার করা হয় ও বিচার হয় তাঁদের। কিন্তু, জোসেফ মেনগেল ধরা পড়েন নি। তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং বারবার এদেশ থেকে ওদেশে বাসস্থান বদলাতে হলেও প্রভাবশালী পরিবারের সহযোগিতায় দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকতে পারেন। সাঁতার কাটতে কাটতে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সাতষট্টি বছর বয়সে।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ডাঃ মেনগেল ঠিক কীভাবে দেখতে চেয়েছিলেন নিজের অতীতকে, তার নির্ভরযোগ্য কোনো বয়ান নেই – কেননা, জীবদ্দশায় তাঁকে ধরা যায় নি, এবং তাঁর ধনী পরিবার, যাঁরা তাঁর পালিয়ে বেড়ানোর রসদ জোগাচ্ছিলেন, তাঁরা জোসেফ মেনগেলের সাথে যে নিয়মিত চিঠির আদানপ্রদান, সেগুলো নষ্ট করে ফেলেন।
যেটুকু জানা যায়, তার থেকে ডাঃ মেনগেল তাঁর কৃতকর্মের জন্যে কোনোরকম অনুতাপ বোধ করতেন, এমন কোনো প্রমাণ মেলেনা। আউশভিৎস থেকে পালানোর আগে ডাঃ মেনগেল তাঁর তথাকথিত “এক্সপেরিমেন্ট”-এর নোটের খাতাটি জমা রেখেছিলেন বিশ্বাসভাজন এক নার্সের কাছে – এবং পালানোর মুহূর্তে সে খাতা তিনি মনে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি, পালানোর দিনগুলোতেও, খাতা থেকে তাঁর পরিচিতি প্রকাশ পেয়ে গেলে তিনি নিজেই বিপদে পড়তে পারেন, এমন ঝুঁকি নিয়েও তিনি খাতা সাথে নিয়েই ঘুরতে থাকেন এদেশ থেকে ওদেশে। নিজের “গবেষণা”-র গুরুত্ব তাঁকে অবিস্মরণীয় বৈজ্ঞানিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, এমনটাই ছিল তাঁর ভাবনা।
মৃত্যুর দুবছর আগে তাঁর সাথে দেখা হয় ছেলে রলফ-এর – যে ছেলের সাথে যুদ্ধশেষের পরে ডাঃ মেনগেল-এর দেখা হয় মাত্র দুবার – প্রথমবার রলফ জানতেও পারেননি, যে, সামনের মানুষটি তাঁর বাবা, আর দ্বিতীয়বার দেখা হয় মৃত্যুর দুবছর আগে। নাৎসিবাদের তীব্র বিরোধী রলফ-এর সামনে বাবা বিন্দুমাত্র অনুতাপ প্রকাশ করেননি – ডাঃ মেনগেল নাকি যা করেছিলেন, সবই একজন অফিসারের কর্তব্য পালন হিসেবে, এবং অবশ্যই বিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে।
আর এখান থেকেই আমাদের প্রশ্ন শুরু হতে পারে। চিকিৎসকের দায়িত্ব ঠিক কতদূর অব্দি? চিকিৎসক যদি ক্ষমতা-দ্বারা সংগঠিত অপরাধের অংশ হয়ে থাকেন, বা যদি তাঁর হাত দিয়েই ঘটে থাকে জঘন্যতম অমানবিক পরীক্ষানিরীক্ষা, তখনও কি তিনি যে স্রেফ ক্ষমতার বেতনভুক কর্মীমাত্র ছিলেন, সেই যুক্তি আদপেই প্রযোজ্য??
(চলবে)
অসাধারণ একটা লেখা ।অদ্ভুত সময়ে এই লেখা অনেক প্রশ্ন তুলে আনে।
সময়োপযোগী তো বটেই, এ লেখা অস্বস্তিকর মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখিও দাঁড় করায়। আমরা আদপে কতটা স্বাধীন, বিবেকী অথবা শিক্ষিত, সে প্রশ্নও উঠে আসে। অন্ধকার ও আলো, ন্যায় অন্যায়, উচিত অনুচিতের সংজ্ঞা আপেক্ষিক কিনা তাও ভাবায়। চলুক লেখা, আমরাও সেই সাথে চলি।
আমি ভয় পাচ্ছি । শরীরের ভেতরে কাঁপুনি দিচ্ছে । লেখক তুমি এ কোন দিনের ভবিষ্যতের ছবি দ্যাখাচ্ছো ?
একটা মৌলিক প্রশ্ন এবং যে ঘটনা বর্ণিত হলো এই প্রশ্নের গুরুত্ব আরোপে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আশা করছি পরবর্তী পাঠগুলিতে সমৃদ্ধ হবো নিরন্তর।অনেক কৃতজ্ঞতা।
সুন্দর একটি প্রতিবেদন
একটা তীক্ষ্ম প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়!
আসলে এইরকমই হওয়া উচিত, সত্যের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হয় না …
পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
As things become less real, we pass from unreeality to reality. The absence of morality not the benchmark thereof marks these stark, naked times and that in itself is a frightening proposal. A world where science is amoral. But the seed of destruction lies in our birth. We have not been able to transcend the fact that there is only one hominid species. Bats off Bishan.
চিকিৎসক কেন, কোনো পেশার মানুষ সমাজ/রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন হতে পারেন কি?? (ডঃ) মেনগেল কোনো।বিচ্ছিন্ন একক ভাবনা নয়, নাজি দর্শনের একটা উপাদান মাত্র।