প্রায় কুড়ি বাইশ বছর আগের কথা, আমি তখন একটি ছোট হাসপাতালে কর্মরত। কর্মী ইউনিয়নগুলির অত্যুগ্র মনোযোগের জন্যে এই হাসপাতালের বিশেষ খ্যাতি। কর্মী ইউনিয়নগুলির নেতৃবৃন্দ হাসপাতালের সমস্ত দৈনন্দিন কাজকর্ম, চিকিৎসকদের ছুটিছাটা, ডিউটি রোস্টার, ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে তাঁদের নাতিদীর্ঘ নাসিকাগুলি গলিয়ে থাকেন। কর্তৃপক্ষ ভয়ে, ভক্তিতে অথবা অসীম অনুরাগে তাঁদের কথার অন্যথা করেন না। সহকর্মীরা প্রায় সকলেই বাঁচার জন্য এ কোল বা ও কোল অথবা উভয় কোলই আশ্রয় করে থাকেন। এই অধম ‘স্থান ত্যাগেন দুর্জনাৎ’ এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে, কারো প্রতিই বিশেষ কোন পক্ষপাতিত্ব না দেখানোর জন্য উভয় ইউনিয়নেরই নেতৃবৃন্দ আমায় বিশেষ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন এবং সর্বদাই আমায় হেনস্থা করার জন্য বিশেষ একাত্মতা অনুভব করেন।
আমার অস্থিশল্যচিকিৎসার আউট ডোরের দিনে সকালে ওয়ার্ড রাউন্ড দিয়ে একটি খুপরিতে আউট ডোরে বসি। রোগীর সংখ্যা সাধারণত একশ কুড়ি পঁচিশ, এদের নাম ডাকা, খাতায় নাম, কার্ড নম্বর লেখা, রোগী দেখে প্রেসক্রিপশন করে ওষুধের স্লিপ লেখা, পরীক্ষা নিরীক্ষার কাগজ তৈরী সব কিছুর জন্যে একটিই লোক। একমেবদ্বিতীয়ম ‘ইওরস্ ট্রুলি’। আউটডোর শেষ হলে সেদিনের সব প্লাস্টার, ড্রেসিং, ইনজেকশন ইত্যাদি শেষ করে আমার মধ্যাহ্ণভোজন সাধারণত সায়মাশে পরিণত হত।
প্রতিকূলতা আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে। এখানে হাড়ভাঙ্গা রোগীর অ্যানাস্থেশিয়ার জন্য অ্যানাস্থেটিস্ট সহকর্মীর কাছে পাঠালে উনি অতি সঙ্গত কারণেই তার সমস্ত রক্ত পরীক্ষা, বুকের এক্স রে, ই.সি.জি ইত্যাদি লিখে দিতেন। মুশকিল হল সরকারী হাসপাতালে এই সব কিছুর তারিখ নিয়ে, সেই পরীক্ষা করিয়ে, তার রিপোর্ট নিয়ে, আবার অ্যানাস্থেটিক ফিটনেস নিতে প্রায়শই দশবারো দিন গড়িয়ে যেত। ফলে একটি সাধারণ হাড়া ভাঙ্গার প্রশ্ন এই অতি নগন্য চিকিৎসকের কাছে জটিল হয়ে দাঁড়াত। অতএব আমি লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে হাড় ভাঙ্গার সেটিং শুরু করলাম। ফলাফল সন্তোষজনকই হতো। তাই আউট ডোর শেষে সেদিনকার হাড়ভাঙ্গা রোগীদের সেদিনই ‘রিডাকশন্’ করে প্লাস্টার করে দিতাম। রোগীদেরও স্বস্তি আর আমারও।
এরকমই এক আউট ডোরের দিন সকাল এগারোটা নাগাদ তাঁর ক্রন্দসী কন্যাকে নিয়ে একজন উদ্বিগ্ন পিতা আউট ডোরে এলেন। সবাইকে সরিয়ে আগে মেয়েটিকে পরীক্ষা করলাম। দেখি চার পাঁচ বছরের কন্যাটির ডান হাত ভেঙে বেঁকে গেছে, যন্ত্রণায় মেয়েটি অতি কাতর। তাড়াতাড়ি তাকে এক্সরে করতে পাঠালাম। রিকুইজিশন স্লিপে ‘আর্জেন্ট এক্সরে প্লিজ’ লিখে দিলাম। হাসপাতালের
একজন রেডিওগ্রাফার ভদ্রলোক, একটি কর্মী ইউনিয়নের দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা। জনশ্রুতি আছে তাঁর দাপটে ব্যাঘ্র এবং বৃষভ একই ঘাটে নীরপানে রত হয়। তাঁর তুলনায় আমি নিতান্তই মূষিকবৎ। কিছুক্ষণ পরে সেই মেয়েটির বাবা ফিরে এসে আমায় বললেন ‘স্যার, মেয়ের এক্সরের তারিখ আগামীকাল দিয়েছে’ । আউটডোরের ভীড়ের মধ্যে আমি একটু অবাক হলাম। ‘আর্জেন্ট এক্সরে’ সাধারণত ফেরানো হয় না। আমি আবার রিকুইজিশন স্লিপে, ‘মেয়েটির হাত ভেঙেছে এবং এক্সরে দেখে, আজই ফ্র্যাকচার্ রিডাকশন করতে চাই’ এসব লিখে ‘ ভেরি আর্জেন্ট’ লিখে এক্সরে করে আসতে বললাম। অনতিবিলম্বেই মেয়েটির অতি উদ্বিগ্ন বাবা ফিরে এসে বললেন, ‘স্যার,এবার তিন দিন পর এক্সরের তারিখ দিয়েছে’। এবার বুঝলাম, মানুষ কত নির্মম আর বিবেকবোধহীন হতে পারে। একটি শিশুর অশ্রুজলও ঐ নেতার কাছে মূল্যহীন। শুধু মাত্র আমায় কিঞ্চিৎ শিক্ষাদানের জন্য তাঁর এই অপূর্ব প্রয়াস।
নিজের যন্ত্রণাকে নিজেই চেপে রেখে, ওই শিশুকন্যা ও তার বাবাকে অপেক্ষা করতে বললাম। আমি জানতাম যে এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে কোন লাভ নেই, কারণ ‘ওই নেতা সর্বদাই সঠিক’। আউট ডোর শেষ করে মেয়েটিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলাম। লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে, জীবনে প্রথমবার (এবং শেষ বার) এক্সরের সাহায্য ছাড়া সম্পূর্ণ আন্দাজে ‘ফ্র্যাকচার্ রিডাকশন’ করলাম। মেয়েটির চোখের জল মোছানোর দায়িত্ব আমার ওপর ছিল, আমি তা পালন করার চেষ্টা করেছিলাম।
প্লাস্টার করার পর উজ্জ্বল মুখে সে যখন তার বাবার কোলে চেপে বাড়ি গেল, তার চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমি খুব কমই দেখেছি। দিন দুই পরে ‘পোস্ট রিডাকশন চেক্ এক্সরে’ নিয়ে ওর বাবা আমার কাছে এল, দেখলাম ‘রিডাকশন’ ঠিকই আছে। তখন মনে হলো, এই হাসপাতালে প্রতিদিন যেভাবে একটু একটু করে আমার মৃত্যু হয়, প্রতি দিনের অপমান, গ্লানি এসব কিছু ছাপিয়েও কোথাও প্রাণ আছে, আশা আছে।
নাকি এই ভাবনাও আসলে আত্মপ্রবঞ্চনা, আমার জানা নেই।
ভাই এই সব আমাদের দৈনন্দিন যাপন । আপনার কলমে আমি মুগ্ধ । ভাষাহীন ।
আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।আমি আপ্লুত।
আপনার এই সহৃদয় মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি আপ্লুত।
ঘটনাটা জানতাম না।ভিলেন কে চিনি।তোমার লেখাটি চমৎকার হয়েছে।
? Thank you very much.
Salute sir
Apnader Moto Dr der jonnoi ajo jikitsa babostha tike ache.
Saikat Ghosh
HA/Orthopaedic Hospital
Thank you so much.
এমনই হোক, সব চিকিৎসক।