প্রথমেই ভালো দিকটা দিয়ে শুরু করি। বড়দের তুলনায় শিশুদের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং ভাইরাস আক্রান্ত হলেও রোগের ভয়াবহতা তুলনামূলক ভাবে কম।
এই লেখায় শিশুদের কোভিড বিষয়ে আমার সামান্য কিছু জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করবোঃ–
১. রোগ লক্ষণঃ
সাধারণ জ্বর, সর্দিকাশি, গলা ব্যথা, মাথা বা গায়ে ব্যথা, পাতলা পায়খানা ইত্যাদিই বেশি। রোগের খারাপ পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট, পেটে ব্যথা, বারবার বমি, পায়খানার সাথে জনশূন্যতা ইত্যাদি দেখা দেয়। সংকটজনক পরিস্থিতিতে হৃৎপিণ্ড, কিডনিসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে।
২. বাড়িতে কীভাবে চিকিৎসা হবে?
অধিকাংশ কোভিড আক্রান্ত শিশুকেই বাড়িতে রেখে সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলা সম্ভব। আর পাঁচটা ভাইরাসঘটিত রোগের মতোই লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাড়িতে পালস অক্সিমিটার দিয়ে বারবার রক্তের অক্সিজেনের পরিমাণ দেখে নিতে পারলে ভালো। জল, শাকসব্জী, টাটকা ফল, পর্যাপ্ত ঘুমের দিকে নজর রাখুন। জ্বর এলে ডাক্তারের পরামর্শ মতো ডোজে প্যারাসিটামল দিন।
৩. বাড়িতে কী কী সতর্কতা নেবো?
বাড়ির বয়স্কদের বাচ্চার থেকে দূরে রাখুন। বাচ্চাকে যথাসম্ভব আলাদা রাখুন। দেখভালকারীর সংখ্যা এক বা দুইয়ের বেশি না হলেই ভালো। দু’বছরের বড় বাচ্চাকে মাস্ক পরিয়ে রাখার চেষ্টা করুন। পায়খানা থেকেও কোভিড ছড়ায়। বয়স্কদের বাচ্চার পায়খানা পরিষ্কার করতে দেবেন না। উপসর্গ সৃষ্টির পর থেকে ১০ দিন (এবং জ্বর ছাড়ার পর থেকে অন্তত তিন দিন) অব্দি আলাদা রাখুন। প্রয়োজনে তার পরেও দিন সাতেক আইসোলেশন বাড়ানোর দরকার হতে পারে।
৪. কখন হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার?
শ্বাস বা হৃৎস্পন্দনের হার খুব বেড়ে যাচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন। শ্বাসকষ্ট হ’লে বাচ্চার দুই পাঁজরের মধ্যে এবং বুক-পেটের সংযোগস্থলের পেশী ভেতরের দিকে ঢুকে যায়। ঠোঁট, জিভ নীল হয়ে যাচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন। বারবার বমি, সাংঘাতিক পেটে ব্যথা বা জলশূন্যতার জন্য পেচ্ছাব কমে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন। বাচ্চা নেতিয়ে পড়লে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলে, একদমই খেতে না পারলে দ্রুত হাসপাতালে যান।
কোভিডের একটি মারাত্মক রূপ হ’ল মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম। এটি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গে প্রদাহজনিত মারাত্মক অসুস্থতা। জ্বরের সাথে র্যাশ, চোখ লাল হওয়া, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, রক্তনালীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া, হৃৎপিন্ডের রক্তবাহ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যায়।
খুব জটিল হচ্ছে কি?
বেশ। তাহলে মাথায় রাখুন, পালস অক্সিমিটারে ৯৪-র নিচে নামা মানেই খারাপ লক্ষণ। শ্বাসের গতি ২ মাসের নিচে ৬০-র বেশি, ২-১২ মাসে ৫০-র বেশি, ১-৫ বছরে ৪০-র বেশি, তার ওপরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ৩০-র বেশি হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন। যে কোনও হঠাৎ করে তৈরি হওয়া উপসর্গের জন্য বাচ্চাকে অস্বাভাবিক ভাবে অসুস্থ লাগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৫. কাদের ক্ষেত্রে কোভিড মারাত্মক হ’তে পারে?
আগে থেকেই ফুসফুস, হৃৎযন্ত্র, কিডনি বা অন্য কোনও দীর্ঘদিনের রোগ থাকলে। দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি বা অনাক্রম্যতা কমে যাওয়ার রোগ থাকলে। দীর্ঘদিন অনাক্রম্যতা কমানোর ওষুধ খেলে।
৬. কীভাবে রোধ করা যায়?
বাচ্চারা খুব বেশি বাড়ির বাইরে যায় না। কাজেই আপনার সুরক্ষাই পরোক্ষভাবে বাচ্চার সুরক্ষা। বাড়ির বাইরে বেরোলেই মাস্ক পরুন। সাবান-জল বা স্যানিটাইজারে বারবার হাত পরিষ্কার রাখুন। প্রয়োজন ছাড়া ভিড় এড়িয়ে চলুন। ধর্মকর্ম করার ইচ্ছে হ’লে বাড়িতে করুন। মাথায় রাখুন কোনও ধর্মের কোনও উপাস্য কোভিড আটকানোর ক্ষমতা রাখেন না। একটু বড় বাচ্চাদের মাস্ক পরা বা হাত ধোওয়ার অভ্যেস করিয়ে দিন। সব ধরনের টিকা দিন। অন্য কোনও রোগ কোভিডের জন্য জটিল হয়ে উঠতে পারে। আর্থিক সমস্যা না হ’লে বাচ্চাকে অন্তত ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোকক্কাল টিকা দিন।
৭. নবজাতকের কোভিডঃ
কোভিড আক্রান্ত মায়ের নবজাতকের কোভিড সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাচ্চা ও মা’র খুব খারাপ উপসর্গ না থাকলে এক জায়গায় রেখে চিকিৎসা হবে। বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ খাবে। মা গুরুতর অসুস্থ হ’লে বাচ্চাকে আলাদা রেখে চিকিৎসা করতে হবে। মা বুকের দুধ বের করে বাচ্চাকে দিতে পারেন। বাচ্চা অসুস্থ হ’লে উপসর্গের ধরন অনুযায়ী সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট বা নিওনেটাল আইসিইউ-তে চিকিৎসা হবে।
৮. পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ
আপনার ডাক্তার বাচ্চার রোগলক্ষণ অনুযায়ী কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, সি আর পি, প্রোক্যালসিটোনিন, লিভার ও রেনাল ফাংশন টেস্ট, ফেরিটিন, ডি-ডাইমার, সোডিয়াম, অ্যালবুমিন, বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান ইত্যাদি পরীক্ষা করতে বলতে পারেন। তাছাড়া রোগের পর্যায় অনুযায়ী ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, পেটের ইউএসজি ইত্যাদি করার প্রয়োজন পড়তে পারে।
৯. ভয় হচ্ছে তো… ভালো রাখবো কীভাবে?
অনেকদিন স্কুল বন্ধ। বাচ্চারা বন্ধুদের সাথে মিশতে পারছে না। ফলে বিভিন্ন রকম মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন, উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। অনলাইন ক্লাস আর মোবাইল আসক্তির কারণে কায়িক পরিশ্রম বন্ধ। অনেক বাচ্চার অস্বাভাবিক ভাবে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে। রোজ অন্তত পনেরো মিনিট ব্যায়াম করান। প্যাকেটের খাবার দেবেন না। বেশি করে সবুজ শাকসব্জী খাওয়ান। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
১০. শেষপাতে…
কোভিড-ই একমাত্র রোগ নয়। শুধুই কোভিডের কথা ভাবতে গিয়ে শিশুর স্বাভাবিক যত্নের অন্যান্য দিকগুলো ভুললে চলবে না। প্রথম ছ’মাস বুকের দুধ, তারপর থেকে বাড়ির স্বাভাবিক খাবার, টিকাকরণ ইত্যাদি সবদিকেই নজর রাখা দরকার। সবকিছু মিলিয়েই বাচ্চার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। নিজের সচেতনতা পাশের মানুষটির মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন; কোভিডকালে, কোভিডকালের পরেও।