“ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খটকা –
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!
…
ঘর্ঘর ভনভন ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচে শোন্ – ধেই ধেই ধিনতা!”
সুকুমার রায়ের “শব্দ কল্প দ্রুম্”-এর এই লাইনগুলোর সাথে পরিচয় নেই এমন বাঙ্গালি পাওয়া ভার। বর্তমান সময়ে আমার মতো প্রায়-নগণ্য, অকিঞ্চিৎকর মানুষের মনেও এরকম একটা রূপকল্প, একটা জলছবি ক্রমাগত তৈরি হয়ে চলেছে। কি আর করা!
“ঘর্ঘর ভনভন ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচে শোন্ – ধেই ধেই ধিনতা!” – ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল যেদিন জানাজানি হল যে (৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২) নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করে কলেজের সমস্ত ডাক্তারকে জানিয়েছিলেন “অনারেবল ডঃ সুদীপ্ত রায়” কাউন্সিলের নির্বাচনে প্রার্থীদের নিয়ে কলেজের সমস্ত শিক্ষক ও চিকিৎসকের সাথে ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ দুপুর ২টোয় দেখা করতে চান। ঐ মেসেজে বিনীত নিবেদন ছিল – “All are requested to make it convenient en-masse that is all doctors of all department5s.” একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সরকারের কাছ থেকে মাইনে পাওয়া প্রিন্সিপাল “সরকার-পন্থী” নির্বাচনপ্রার্থীদের সমর্থনে আবেদন রাখবেন – এর মধ্যে গেল গেল রব তোলার কিছুই নেই।
কিন্তু “শুনে লাগে খটকা”টা হল – ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিল ১৯১৪ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল অ্যাক্ট অনুযায়ী একটি স্বশাসিত সংস্থা – “West Bengal Medical Council is formed with 3 nominated members of the Government of West Bengal, 3 Ex-officio Members, 7 elected members from Teaching Doctors and 7 elected members from General Medical Practitioners of West Bengal”। কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে গেলেই এ তথ্য পাওয়া যাবে। এজন্য একটি স্ব-শাসিত সংস্থার “সরকার-পন্থী” বা সরকারি প্রার্থী বলে কিছু হওয়া তো সোনার পাথর বাটির মতো। যদি না, ভারতের শাসক দল ছাড়া বিরোধীরা যেমনটা বলে থাকে যে ইডি, সিবিআই ইত্যাদি হল “সরকারি” স্ব-শাসিত সংস্থা, সেরকম ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলও “সরকারি” স্ব-শাসিত সংস্থা হয়।
এরকমটা যদি হয়, তাহলে স্বশাসনের মূল বনিয়াদই ধসে যায়। তাহলে ভিন্ন পরিসর, ভিন্ন স্বর, ভিন্ন চিন্তার অবকাশই থাকেনা। অথচ একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে স্বর-পরিসর-চিন্তার ভিন্নতাকে মান্যতা দেওয়া আবশ্যিক শর্ত। যে পরিণত চিকিৎসক ভোটাররা ভোট দেবেন আগামী কাউন্সিল নির্বাচনে তাঁরা একেবারে গোড়ার এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন নিশ্চয়ই। এ বিষয়গুলো ভেবে না দেখে আমরা আমাদের কণ্ঠস্বর, মুক্ত মনে চিন্তা করার অভ্যেস হারিয়ে ফেলছি না তো? নির্বাচনের প্রাক্কালে ভেবে দেখা দরকার।
চিকিৎসকমহলে সবার কাছে মান্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ (ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ৯১.২৪) আমেরিকার নির্বাচনের প্রাক্কালে সম্পাদকমণ্ডলীর সবার তরফে লেখা একটি এডিটরিয়াল প্রকাশিত হয়েছিল “Dying in a Leadership Vacuum” (৮.১০.২০২০) শিরোনামে। এই সম্পাদকীয়তে বলা হয় – ““নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কেউ এভাবে হঠকারীভাবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললে কিংবা টাকা তছনছ করলে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হত। এরপরেও আমাদের নেতৃত্ব তাদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের কাছে অব্যাহতি দাবী করেছে। কিন্তু এই নির্বাচন আমাদের হাতে বিচারের ক্ষমতা দিয়েছে। যৌক্তিক মানুষেরা আমাদের প্রার্থীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আপত্তি জানাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কখনো ‘লিবারাল’ বা ‘কনজারভেটিভ’ নয়। কিন্তু আমাদের জীবদ্দশার সবচেয়ে বড়ো জনস্বাস্থ্যের সংকটের প্রশ্ন যখন আসে তখন পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিপজ্জনকভাবে অকর্মণ্য। আমরা এদেরকে আর উৎসাহ কিংবা সামর্থ্য জোগাতে পারিনা যাতে তারা আবার নেতা হিসেবে ফিরে আসে এবং হাজার হাজার আমেরিকানের মৃত্যু ঘটে। আমরা এদের আর ফেরার অনুমতি দিতে পারিনা।”
এরকম একটি সম্পাদকীয় বিশ্বের সবার কাছেই, সব প্রান্তেই একটি চেতাবনি হিসেবে কাজ করতে পারে। অন্তত নিউ ইংল্যান্ডের মতো জার্নাল যে ভাষায়, যে ব্যঞ্জনায় কথাগুলো বলেছে সেগুলো আমাদের ভাবাবে – এ ভরসা রাখা যায়। এরকম সম্পাদকীয় এবং একাধিক প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে স্বাস্থ্য ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে, রাজনীতির চেয়ে বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে। আমরা এখানে এ কাজটি করতে কবে পারবো? সময় উত্তর দেবে।
১৭৮৭ সালে ফরাসী চিত্রকর জাক-লুই দাভিদ (Jacques-Louis David) সক্রেটিসের হেমলক পান করে মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্ত এক অসামান্য পেইন্টিংয়ে ধরে রেখেছেন।
ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে রাজার নির্দেশে যে হেমলকের পাত্র নিয়ে এসেছে সে মুখ নামিয়ে রেখেছে। সক্রেটিসের বাঁ হাত উর্ধে তোলা – তাঁর শিষ্যদের Parrhesia তথা ভয়হীন কথা বলা (fearless speech) বোঝাচ্ছেন।
১৯৮৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ফুকো ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ায় (বার্কলে) ৬টি লেকচার দিয়েছিলেন Parrhesia-র ওপরে। ২০০১ সালে এই লেকচারগুলোর সংকলন ইংরেজি অনুবাদে FEARLESS SPEECH নামের একটি বইয়ে সংকলিত হয়। এ বইয়ের উপসংহারে ফুকো বলেন – “আমার উদ্দেশ্য ছিলনা যে সত্যের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব। বরঞ্চ উদ্দেশ্য ছিল, যে সত্য-ভাষণ করছে তার সমস্যা নিয়ে কথা বলা কিংবা সত্য-বলাকে একটি অ্যাক্টিভিটি হিসেবে নেওয়া।” (পৃঃ ১৬৯)
ভয়ের মধ্যে বাস করেও সত্যকে বলা, ভয়কে সাথী করে সত্যকে বলা – এমনটাই ছিল ফুকোর ১৯৮৩ সালের মূল প্রতিপাদ্য। আজ ৪০ বছর পেরিয়ে ২০২২ সালে এ কথাগুলো কিছুমাত্র প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। “চুপচাপ –এ ছাপ” – এটা একসময়ের শ্লোগান ছিল কিন্তু।
এবারের মেডিকেল কাউন্সিল ভোট অত্যন্ত তাৎপর্য্যপূর্ণ। সেরকম এক সময়ে দাঁড়িয়ে ডা: ভট্টাচার্যের এই লেখা সংশিষ্ট সকলকে আরো ভাবায়, গভীর ভাবে ভাবায়।
চিরকালীন যাকে বলে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
Excellent sir
অসাধারণ