খুব সম্প্রতি, আমার একটা লেখায়, (সে লেখাটা অবশ্য সম্পাদকের নির্দেশে ফেসবুকে দেওয়া যায়নি) আমি অব-সামাজিক বলে একটা শব্দ ব্যবহার করেছি। অসামাজিক নয় অথচ সঠিক অর্থে সামাজিকও নয়।
প্রচলিত সামাজিকতার একটু নীচেই হয় তো যার জায়গা, তেমন কিছু বোঝাতে শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম।
যাই হোক, মূল কথায় ঢুকি। আমার পাঠকেরা যে আমাকে ইয়ে মানে ভীরু ধার্মিক সামাজিক অথচ মৃদু বিপ্লবী এক সত্তা বলে ভাবেন, সবিনয়ে বলি, সেটা ভুল। এর মধ্যে এক ওই ভীরু কথাটা ছাড়া আর কোনওটিই আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। অন্যান্য সমস্ত গুণাবলীর লেশমাত্র খুঁজে পাই না আমার মধ্যে।
ধার্মিক মোটে নই। অন্তত খাদ্যের স্কেলে ধর্ম মাপার যে ভারতীয় পদ্ধতি তাতে ডাহা ফেল। গরু শুয়োর সাপ ব্যাং কুত্তা, বাদ যায়নি কিছুই।
সামাজিক মানদণ্ডে হরমোনাক্রান্ত হয়ে কত না বেসামাল কাজ করেছি। সে সব লজ্জার কথা বিস্তারিত থাক। এমনকি আমার ছাত্র রাজনীতিতে জড়ানোর ব্যাপারটাও ওই হরমোনেরই কারসাজি বলে আমার ধারণা।
গ্রাম থেকে আসা সাতচল্লিশ কিলো ওজনের আর পাঁচফুট সাড়ে চার ইঞ্চি এক সদ্য যুবকের সপ্রতিভ ঊনিশটি সহপাঠিনীর কাছে নিজেকে প্রমিনেন্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল বোধহয় স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটার সেই লোক দেখানো চেষ্টা।
এবং ওই বিপ্লবী সাজার ব্যাপারটাও। একবার বোমার স্প্লিনটারে আহত হয়েছিলাম বিপ্লবীপনা করতে গিয়ে। ইউনিভার্সিটির সামনে। তো আমাদের মানে সিউডোবিপ্লবীদের নিজেদের মধ্যে আকচা-আকচি ছিল খুব। দীর্ঘদিন আমাকে খোঁটা শুনতে হয়েছে, বোমা তো তোর পিঠে লেগেছিল। পিঠে লেগেছিল মানে তুই পালাচ্ছিলি। যেন বুকে লাগলে খুব কাজের কথা হত সেটি। কাজেই নিজেকে বিপ্লবীটিপ্লবী ভাবাটাও আমার পক্ষে বেশ ইয়ে।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছিল ওই সামাজিক মানে আমার ওই কিঞ্চিৎ অব-সামাজিক অবস্থান নিয়ে। সৌমিত্রর ‘মৃত্যু আয় তিনপাত্তি খেলি’ কবিতাটা ভাইরাল হতেই আবার মনে পড়ে গেল সব। আমার সেই তিনপাত্তি খেলার দিনগুলি।
তার আগে বলি তাস আর দাবার দিনগুলো শুরুর কথা। দাবার মেধা আমার ছিল না। কিন্তু তাসে ছিল প্রবল আসক্তি। পরে ভেবে দেখেছি তাতে ওই মেধার পার্টটা বাদ দিয়ে একটা জুয়ার এলিমেন্টও থাকত তো। তাইই বোধহয়। প্রত্যেকবার হেরে যাবার পর আশা করা যে এর পরের বার অন্য রকম তাস পাবো। অন্য রকম বিন্যাস। আহা, যুধিষ্ঠিরও তো তাইই ভেবেছিল। পৃথিবীর সমস্ত জুয়ারিরাই ভাবে।
তিয়াত্তর সালে ডাক্তারি ছাত্রদের এক বিরাট আন্দোলন হয়েছিল। সিএসি মুভমেন্ট বলতাম সবাই। মেডিকেল কলেজের এমসিএইচ বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যে চত্বর( রেফারেন্স- সপ্তপদী ও অন্যান্য ছায়াছবি) সেখানে অবস্থান চলেছিল। সেইখানে এক দাদা, গ্রাম থেকে আসা তাস না চেনা বালককে কদিন হাতেনাতে শিখিয়েছিলেন তাসের জুয়ার প্রকরণ। তাঁর ভাষায়- একতাস থেকে বাহান্ন তাস সব জুয়া তোকে শেখাব আয়।
হ্যাঁ, মশাইয়েরা। এক তাসের জুয়াও হয়। দাদা বলেছিলেন খেলাটার নাম বিবি অন্দর বাহার। শাফল করা তাস বাজি রেখে একটা একটা করে চিত করা হবে। বাজির শর্ত ও অর্থমূল্য আগেই নির্ধারিত। এবার কথা মত, প্রথম বিবিটি অন্দর মানে যে বাজি ধরেছে তার দিকে পড়বে নাকি বিপক্ষের দিকে। পাতি ভাগ্যনির্ভর প্রোবাবিলিটির খেলা। যদিও ওস্তাদ দাদা বলেছিলেন শাফলের সময় প্রতিভার পরিচয় রাখা যায়। আমার তত প্রতিভা ছিল না। তার পর দু তাস। এবং তিন তাস। মানে তিন পাত্তি। যেটা খেলব বেশ কিছু পরে।
এর পর শিখলাম, টুয়েন্টি নাইন, কল ব্রিজ, ব্রে, ফিস, পাতি ব্রিজ, অকশন ব্রিজ, রামি আর সর্বোপরি আবার বলি, ওই তিনপাত্তি।
পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে যাঁরা রসিক তাঁরা জানেন কোনটার কী প্রকরণ। আর যাঁরা জানেন না তাঁদের আর চরিত্রটি নষ্ট করে কাজ নেই।
আমার জিগরি দোস্ত আশিস, ব্রিজ খেলত খুব ভাল। এই খেলাটিতে বিচার শক্তি, স্মৃতি শক্তি, পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞান খুব দরকারি। পর্যবেক্ষণ মানে সহ খেলোয়াড়দের আচরণ পর্যবেক্ষণ। উঁকিঝুঁকি মেরে অন্যের হাত দেখার মত ছ্যাঁচড়ামি পদস্থ খেলোয়াড়েরা করে না।
সেই সময়ে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে বিকেল বেলায় তাসের আসর বসত। চার পাঁচটা গ্রুপ খেলত। যে কোনও গ্রুপের মধ্যিখানে মূল খেলোয়াড় চারজন। তাদের ঘিরে কুড়ি তিরিশটি উৎসুক দর্শক, যারা প্রত্যেকে মূল খেলোয়াড়দের চেয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে। প্রত্যেক পিটের পরে, কী তাস খেলা উচিত ছিল তা ব্যক্ত করে।
অবশ্যম্ভাবী ভাবে ঝগড়া হয় খুব। খেলার পার্টনাররাও পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া করে। আশিস সমস্ত বিকেলবেলাগুলিতে এই আসরের তন্নিষ্ঠ দর্শক ছিল। একদিন সেখান থেকে ফিরল ভারি উত্তেজিত হয়ে। কী ব্যাপার? একজন নাকি নো কল দিয়েছিল। খেলা শেষে সে তার পার্টনারকে উত্তেজিত ভাবে বুঝিয়েছে এই নো কলের অর্থ নাকি সাতাশ রকম হয়। প্রত্যেকটা অর্থই অকাট্য।
এই বিবৃতিটা অন্যান্য ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে এক্সট্রাপোলেট করলে কী বিপুল সম্ভাবনা বেরোতে পারে বলবার নয়। ধরুন প্রেমিকাটি প্রেমিককে বলল, না। অথবা কেউ তার এক্সকে বলল না। অথবা ধরুন এক্স নয় ওয়াই বা জেডকেই বলল।
এই ‘না’এর কত কত অর্থ থাকতে পারে? যে বলেছে আর যাকে বলেছে তারাই শুধু জানে। সত্যিই জানে কি? কত কত অণুগল্প ছোটগল্প উপন্যাস তৈরি হল ওই ‘নো’ কলের মানে খঁজতে গিয়ে!
কিম্বা ধরুন অধিকারী কেউ ইয়ে দলকে বলল ‘নো’। সেই ‘না’এরই বা কী কী অর্থ? কবে কখন কোথায়।ওপিনিয়ন পোল করেও তল মেলা ভার। ক্যাডাভারাস কাণ্ড মশাই!
সেই যে তাস খেলা শুরু হল তা চলতেই থাকল। সেই অকারণ তাস পেটানো। কত না শাফল হল জীবনের। বাইরে ও ভেতরে। মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয়, পড়তে গেছিলাম না তাস খেলতে। চূড়ান্ত ঘটেছিল, মেডিসিন প্র্যাক্টিক্যালের আগের রাত্তিরে ভোর চারটেয় যখন দেবাণু জোর করে তাসের আসর থেকে ঘুমোতে পাঠাল। – অরুণাচলদা’, তোমার না প্র্যাক্টিক্যাল ন’টার সময়ে!
ওঃ, হচ্ছিল তো তিন পাত্তির কথা। সে এক অপরূপ জুয়া। এখন যখন টিভিতে মোবাইলে রামি সার্কেলের অ্যাড দেওয়া হয় প্রকাশ্যে,আমি হাসি। তখনও ওই আমাদের চেনা তিন পাত্তি কিন্তু তুলনাহীন।
নাটকে গল্পে বাস্তবে তিন পাত্তি খেলে যে কত লোক ফতুর হত আর কতজন রাজা উজির। হিন্দি ছবিতে খলনায়ককে ভ্যাম্প গুছিয়ে বলে দিচ্ছে অপাপবিদ্ধ নায়কের হাতের তাস এরকম হরবখত দেখেছি। সেই তিন টেক্কার স্বপ্ন, রান আর কালারএর মায়া… আহা।
ইডেন রুফ হাউসস্টাফ কোয়ার্টারে তিন তাসের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিল।
এতক্ষণে বোঝানো গেছে নিশ্চয়ই, আমি ছিলাম নাম কাটা সেপাইদের দলে। আবডু দা ওরফে সুশান্ত ছিল আমাদের কম্যান্ডার যেন বা। তখন হাউসস্টাফশিপ মানে এখনের আটচল্লিশ ঘণ্টা হাসপাতালে দিয়ে, বাকিটা নার্সিং হোমের বা কর্পোরেটের খেপ খাটা নয়। বাধ্যতামূলক 24X7। উপায়ান্তর ছিল না। অপশন ছিল না তো!
তো যাই হোক, রোজকার সন্ধ্যের রাউন্ড শেষে ইডেন রুফে ফিরেই কম্যান্ডারের প্রেতছায়ার খপ্পরে পড়তাম। আবডুদার স্টেথো রাখার যে ছোট ব্যাগ সে রকম এক ব্যাগ ভর্তি দু পয়সা আর তিন পয়সার কয়েন ছিল। সেই যে হাল্কা অ্যালুমিনিয়ামের পয়সা। যে গুলি ফুঁ দিলে নাচত হাতের চেটোয়। সাবধানে জলে ভাসাতে পারলে এমনকি ভাসতোও। ফিজিক্সের স্যার বলতেন সারফেস টেনশনের পর্দা ডুবতে দিচ্ছে না।
সেই পেটমোটা খুচরো ভরা ব্যাগ বগলে আবডুদা এ রুম ও রুম থেকে ধরে আনত তিন তাসের নিমিত্ত বলিপ্রদত্ত পাঁঠাদের। টাকা ভাঙিয়ে খুচরো করে দিত। তার পর শুরু হত সেই নৈশ অভিযান। জুয়ার। বোর্ড মানি তো নয় বোর্ড পয়সা। তাও ওই দু পয়সা তিন পয়সা। তাতেই রাত ভোর হবার মুখে টের পেতাম গলে গেছে পনেরো কুড়ি টাকা। মাইনে ছিল কুল্লে চারশোটি টাকা। আমার ভবিষ্যতে যিনি স্ত্রী হবেন, তাঁকে পরদিন ক্যান্টিনে এককাপ চা খাওয়ানোর পয়সায় টান পড়ে যেত।
তার পরেও তিন পাত্তি খেলিনি কি? অন্য অনুষঙ্গে খেলেছি বই কি। কেউ সেই হেলায় বোর্ডে ছুঁড়ে দেওয়া ঝুঁকির খুচরোকে ভেবেছে রাজদ্রোহ।
ওরা ভাবতেও পারেনি খেলা যেখানে পেতেছে পাহাড়ের সেই বোর্ডে শেষ বাজি জিতে যাব আমিই। আমিই কি ভেবেছিলাম?
খেলতে খেলতে যেই না জীবন, আনসিন খেলার মাঝে চেঁচিয়ে বলেছে show, হাতের তাস উপুড় করে নিজেই অবাক হয়ে গেছি। জিতে গেছি তিন টেক্কার বাজি। ইন ফ্যাক্ট সেই টেক্কাও অবাক।
ঠিকই, মুর্খ বড় সামাজিক নয়। কিন্তু অসামাজিকও নয়।
অব-সামাজিক।
এই হল, অব-সামাজিক ইতিহাস আমার।
এখন আমিও বলতেই পারি, আয় মৃত্যু তিনপাত্তি খেলি…