গরম গরম আলুর পকোড়ায় কামড় বসাতে বসাতে কর্তা তারাভরা আকাশের তলায় দূরের পাহাড়ের গায়ে আলোমাখা এক অচিনপুরীর দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, “ঐ… ঐ যে বাঁদিকে দূরে ঝলমল করছে..ওটা দার্জিলিং। আর পাশের ওটা কালিম্পং। সামনে আলোকমালার মত যেটা দেখা যাচ্ছে, ওটা তিস্তা ভ্যালি। ওপরে টাইগার হিল, চটকপুর আর ডানদিকে উপরে ডাউহিল!”
সামনের আবছায়া পাহাড়ের গায়ে যেন সহস্র জোনাকি জ্বলেছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছি আমি। এতবার পাহাড়ে গেছি আমি; তবু, পাহাড় আমায় মুগ্ধ করে আজও।
দার্জিলিং এ দুরাত্তির কাটিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল তিনচুলে। দার্জিলিং থেকে দূরত্ব মাত্র ৩২ কিমি হলেও রাস্তা খুব একটা সুবিধের নয়। গাড়িগুলো যে কারণে এটুকু পথ আসতে ২৫০০ টাকার চেয়ে একপয়সা কম নিল না।
যাই হোক, তাকদা-কে পিছনে ফেলে আমরা যখন তিনচুলে-তে এসে পৌছলাম ঘড়িতে তখন দুপুর একটা। তিনচুলে-তে দারুন সব রিসর্ট (যেমন, গুরুং গেস্টহাউস, রাই রিসর্ট, অভিরাজ গেস্টহাউস) থাকলেও আমরা জেনে বুঝেই অপেক্ষাকৃত কম-প্রচারিত হামরো গেস্টহাউসে বুকিং করেছিলাম। এর একটাই কারণ –জনপ্রিয় ট্রাভেল গ্রুপে গেস্টহাউসের মালিক সুরেন রাই এর আতিথেয়তা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।
তো, সুরেনজী বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন আমাদের আগমনের। আমাদের দেখেই এক গাল হেসে অভ্যর্থনা জানালেন । ওনার সাথে ফোনে বহুবার কথা হয়েছিল এবং সেই থেকেই মানুষটি কেমন একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল। রাস্তা-লাগোয়া সুন্দর ছবির মত হোমস্টে, ফুলে ফুলে ভরা। রাস্তার উচ্চতা থেকে সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমেই থাকবার ঘরগুলো। এখানে সব আস্তানাগুলো এই প্যাটার্নের। উনি আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন। বিছানা, টেবিল, চেয়ার, টিভি, গিজার নিয়ে দারুন সুন্দর কাঠের ঘর। উপরে দুটি আর নীচে দুটি–মোট চারটি ঘর। ঘরের বারান্দা থেকেই পাহাড় দেখে দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।
ডাক পড়ল দুপুরের খাবারের। সুরেনজীকে আগে থেকেই কর্তা বলে রেখেছিলেন ওনার অর্গানিক ফার্মের সবজি খাওয়ানোর জন্যে। কথামত তিনি সব ব্যবস্থা করেই রেখেছেন — গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডাল, রাই শাক, অর্গানিক সব্জি, চিকেন, তিল দিয়ে বিনস ফ্রাই, দারুন একটা আচার আর পাঁপড়। তখন, তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে; তার মধ্যে গরম গরম সুস্বাদু খাবার অমৃত-সম লাগছিল। সুরেনজী নিজের হাতে আমাদের পরিবেশন করে খাইয়েছিলেন।
দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সুরেনজী তিনচুলের গল্প শুরু করলেন। তাকদা থেকে ৩ কিমি উপরে ৫৮০০ ফুটে অবস্থিত এই গ্রামে উনুনের মত দেখতে তিনটি চূড়া ছিল, সেখান থেকেই এই নামকরণ। WWF ( World wide Federation) এর উৎসাহে এখানকার গ্রামবাসীরা প্রায় সকলেই মডেল অর্গানিক ভিলেজ এবং ভিলেজ ট্যুরিজম শুরু করেছেন। উনি নিজেও পর্যটকদের কথা ভেবে তৈরি করছেন অর্গানিক ফার্মিং– কমলালেবু, প্যাশন ফ্রুট, চায়ের বাগান; অ্যাংগলিং-এর ব্যবস্থা।
সুরেনজী জানালেন, সামনেই একটা বৌদ্ধগুম্ফা আছে, যেখানে এক লামা দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ধ্যান করেছিলেন।
বিকেলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, পায়ে হেঁটে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখবার জন্যে। রাস্তার দুপাশে দীর্ঘ পাইনের সারি সূর্যালোক প্রবেশে বাধা দেয়। জংগল থেকে ভেসে আসছে ঝিঁ-ঝিঁ-র ডাক, সাথে অচেনা বুনো ফুলের গন্ধ। ইতি-উতি বনমুরগিরা দৌড়ে ঢুকে যাচ্ছে জংগলে। সামনেই সেই বৌদ্ধগুম্ফাটি, নিভে আসা আলোয় যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আলো-আঁধারি পথ ধরে গুম্ফাতে পৌঁছালাম, সেখানে তখন সন্ধ্যের প্রার্থনা চলছে। গম্ভীর মন্ত্রধ্বনি ও দ্রিম-দ্রিম বাদ্যধ্বনি এক অলৌকিক পরিবেশ তৈরি করেছে।
ফেরার পথে এক অচেনা সারমেয় বন্ধু হয়ে পুরো রাস্তা সঙ্গ দিল, যেন কতকালের চেনা। ঝর্ণার কুলু কুলু ধ্বনি শুনে খুঁজতে গিয়ে দেখি, আরে, এতো পাইনবনের মধ্যে দিয়ে বাতাসের ছোয়াছুঁয়ি খেলা। নেশার মতো ঝিমঝিমে।
সন্ধ্যেবেলা গরম পকোড়া সহযোগে চা আর আড্ডা। রাতের ডিনার তাড়াতাড়ি সারলাম, এবং যথারীতি সেই এলাহি ব্যাপার।
পরেরদিন ভোরে দরজায় ঠক-ঠক শব্দে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। দরজা খুলে দেখি সুরেনজী সূর্যোদয় দেখার জন্য ডাকছেন।একটা দারুন সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকলাম।
আজ বেরোবো সাইট সিং এর জন্য। ৯টায় ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে উঠলাম।
প্রথমেই গেলাম গুম্বাদাঁড়া ভিউ পয়েন্ট–সেখানে দিগন্ত জুড়ে সপার্ষদ তিনি–মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোটা দেখা যাচ্ছে। কাঞ্চনজংঘার নীচেই নামচি শহরটি দেখা যাচ্ছে আবছা।
পরের গন্তব্য লামাহাট্টা । পাহাড়ের ধাপে পাইন আর রংবাহারি ফুলের সমারোহ এখানে। অনেকটা চড়াই ভেংগে লামাহাট্টা পার্কের এক্কেবারে উপরের ‘হোলি লেক’-এ এসে পৌঁচ্ছালাম। পার্কটি থেকেও ‘স্লিপিং বুদ্ধ’কে পরিষ্কার দেখা গেল।
সেখান থেকে চললাম লাভার্স পয়েন্টে। এটি তিস্তা- রঙ্গিতের সংগমস্থান। কথিত আছে, কোনও এক যুগল এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেয় নীচের চড়ায়।
লাভার্স পয়েন্ট থেকে গাড়ি করে নেমে এলাম তিস্তার পাড়ে। একদল বাচ্চা হৈ-হৈ করে পিকনিক করছে। ইতিউতি মাছ ধরার যন্ত্রপাতি লাগানো। কয়েকটা তাঁবুও নজরে এলো। নীলচে সবুজ তিস্তাকে ছুঁয়ে দেখলাম জলে নেমে।
ফেরার পথে রাস্তায় পেশক চা-বাগান দেখে নিলাম ।
আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল বড়ামাংগওয়ার ওরেঞ্জ গার্ডেন। ৩০ টাকা মাথাপিছু টিকিট কেটে গাইড সহযোগে গার্ডেনে ঢোকা যায়। এসময় বাগান উপচে পড়ছে কমলালেবুর ভারে। নীচে একটি জুস ফ্যাক্টরিও আছে।
বেলা পড়ে আসছে, সাথে পেট চুঁইচুঁই। এবার ফেরার পালা। তিনচুলেতে ফিরে দেখলাম সুরেনজী হাসিমুখে বসে রয়েছেন লাঞ্চ রেডি করে।
এখানে ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে। সন্ধ্যের পর বিশেষ কিছু করার থাকে না। আমরা কটেজের লনে বসে সুরেনজীর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। সে গল্পে উঠে এল সেখানকার আপাত-সাধারব মানুষগুলোর জীবন-যাপন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সুরেনজীর ইকোট্যুরিজমের প্রেরণার উৎস। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন ফেরার টিকিট বাগডোগরা থেকে ১০.৩০ এর ফ্লাইটে। ভোর ছটাতেই গাড়ি চলে আসলো। এত্ত সকালেও ভাবিজী আমাদের জন্যে পুরি-সব্জি বানিয়ে দিয়েছেন যত্ন করে। সুরেনজীর মা ও স্ত্রী খাদা পড়িয়ে বিদায় দিলেন। বারবার বললেন, আবার যেন আসি।একরাশ মনখারাপ নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আবার সেই ইঁট-কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলে ফেরা।
ফেরার পথে দেখলাম অপূর্ব সুন্দর তিনটি চা-বাগান–‘রংলি – রংলিয়ট’, ‘গিয়েল’ আর ‘তিস্তা ভ্যালি’। যতদূর চোখ যায় মনমাতানো সবুজের গালিচা বিছানো আর নীল পাহাড়ের বুকে আলগোছে আটকে থাকা মেঘের দল। মনটা ভারি হয়ে আসছে। আসলে, তিনচুলের উষ্ণতা তখন জড়িয়ে ধরেছে মনের প্রতিটি খাঁজে আর তাই গাল বেয়ে নামছে নোনা ধারা।