তিন-বছরে-ডাক্তার প্রকল্প নিয়ে বলার কিছু নেই। বড়রা ভেবেচিন্তে যখন করছেন, নিশ্চয়ই ভালো ভেবেই করছেন। তবু মনের মধ্যে একটা খটকা বড্ড জ্বালাচ্ছে।
সেটা হল, কেন এই উদ্যোগ?
শুনছি, দেশে ডাক্তারের বড় অভাব। সিকি শতক আগে আমরা যখন পাস করেছিলাম, তখন রাজ্যে এমবিবিএস-এর আসন মেরেকেটে সাড়ে সাতশ। এখন সংখ্যাটা ঠিক বলতে পারব না, কেননা রোজই তো এদিক-ওদিক মেডিকেল কলেজ খুলে যাচ্ছে, সিট-ও বাড়ছে, বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে মাঝেমধ্যে দিল্লির হর্তাকর্তারা এসে কমিয়েও দিচ্ছেন, আবার সেগুলো ‘নিয়ম মেনে’ চালু হয়ে যাচ্ছে। তবু, যদ্দূর শুনলাম, এই মুহূর্তে আসনসংখ্যা সাড়ে চার হাজারের বেশিই (মানে, পঁচিশ বছরে ছয় গুণেরও বেশি বৃদ্ধি!!) সম্ভবত। তারপরও নাকি ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না।
তাহলে সংখ্যায় ঠিক কতজন ডাক্তার বছরে তৈরি হলে ঘাটতি পূরণ হবে? সেরকম কোনও হিসেব আছে কি? যদি না থাকে, তাহলে তো এমনও হতে পারে, যে, তিন-বছরে-ডাক্তার তৈরি করেও ঘাটতি রয়েই গেল! বড় বড় লোকেদের বড় বড় মাথা থেকে আসা পরিকল্পনা জলে যাক, এমন তো চাইতে পারি না, তাই না?
আবার দেখুন, সংখ্যায় ঠিক কত ডাক্তার তৈরি হলে আর ঘাটতি থাকবে না, এমন হিসেব যদি সরকারের কাছে থাকে, তাহলে এমবিবিএস-এর আসন সেই অনুযায়ী বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন? পূর্বতন বাম সরকারের কল্পনাশক্তির ঘাটতির কারণে তাঁরা ভেবে উঠতে পারেননি যে যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে মেডিকেল কলেজ খুলে এমবিবিএস-এর আসন মুড়িমুড়কির মতো বাড়িয়ে ফেলা যায়, তাই তাঁরা এসব শর্টকাটের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন তো সেই দিন আর নেই। উদ্যোগই বলুন বা উদ্ভাবনী শক্তি অথবা কল্পনাশক্তি, এসব দিকে বর্তমান সরকার যাকে বলে সেকেন্ড টু নন। যা যা পরিকাঠামোয় এঁরা নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ খুলে এমবিবিএস-এর আসন বাড়িয়ে ফেলেছেন, তাকে চমকপ্রদ বললেও কিছুই বলা হয় না। তাহলে এমবিবিএস আসন আরও হাজার কয়েক না বাড়িয়ে এই তিন-বছরে-ডাক্তার প্রকল্প কেন? কেন এই সঙ্কোচের বিহ্বলতা??
নাকি, শীর্ষে থাকা সদিচ্ছাপ্রবণ মানুষগুলো এতই উতলা হয়ে পড়েছেন, যে – প্রাক-নির্বাচনী স্লোগানের মতোই, ‘অনেক হয়েছে, আর না’ আউড়ে – স্থির করে ফেলেছেন, নাহ্, গাঁয়ের লোকের স্বাস্থ্যসমস্যার সুরাহা এখুনি করে ফেলতে হবে? আপাতত তিন বছর – অত সবুর না সইলে, পরে হয়ত বছরখানেক!!
তবে হ্যাঁ, সরকারের পক্ষেও যুক্তি কিছু কম নেই। আজকের খবরের কাগজে প্রকাশ, রাজ্যের সবচাইতে মান্যগণ্য মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় সত্তর শতাংশ নম্বর পেয়ে একেবারে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন। কেননা, যেখানে তাঁদের সহপাঠীদের অধিকাংশই নাকি পঁচাত্তর শতাংশ না পেয়ে থামেননি, সেক্ষেত্রে সত্তর শতাংশ তো অত্যন্ত ডিজ্যাপয়েন্টিং! তো তাঁরা খাতা রিভিউ করতে দিয়েছিলেন। রিভিউ-এর পরে দেখা গেছে, তাঁদের প্রাপ্ত নম্বর তিরিশ শতাংশ বা তারও কম!! মেডিকেল পরীক্ষায় যেহেতু পাসমার্ক পঞ্চাশ শতাংশ, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা একটু সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন – কেননা, পাস করা ছাত্র খাতা রিভিউ করে ফেল করে গিয়েছেন, এমন নজির স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্রস্ব ইতিহাসে তো নেইই, সুপ্রাচীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেও রয়েছে কিনা বলা মুশকিল।
তো পরীক্ষার এমম্বিধ ফলই প্রমাণ – বড়কর্তারা বলতেই পারেন – রাজ্যে এডুকেশন ব্যাপারটা (মেডিকেলই হোক বা অন্য স্ট্রিম) এমন উচ্চস্তরে পৌঁছে গিয়েছে, যেখানে কত বছর কোথায় পড়ানো হচ্ছে, তা পুরোপুরি অবান্তর। সাড়ে চার বছর পড়ানোর কারিকুলামে যখন এমন অবস্থা, তখন তিন বছরে আলাদা কী হবে!!
সেক্ষেত্রে অবশ্য বাড়তি আশঙ্কার কিছু নেই।