সাড়ে তিন বছরে ‘ডিপ্লোমা ডাক্তার’ তৈরির একটি প্রস্তাব এসেছে। প্রস্তাব পেরিয়ে সেটা বাস্তবের মুখ দেখবে কিনা সেটা সময় বলবে। আপাতত বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলাম। যেখানে খাতায় কলমে এখনো পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে ভালো র্যাঙ্ক করা ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। আমরা নিট ইউজির বহু আগের ব্যাচ। পশ্চিমবঙ্গের জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকতে হ’ত। জেনারেলের জন্য সব মিলিয়ে রাজ্যে সাড়ে সাতশো সিট ছিল। মোট বোধহয় এগারোশো মতো। মেডিক্যাল কলেজে একশো পঞ্চান্ন জনের ব্যাচ ছিল। তখনই মেডিক্যাল-শিক্ষার যা হাল দেখেছি তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না, প্রান্তিক মেডিক্যাল কলেজগুলোতে অবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। কুমিরছানা দেখানোর মতো চিকিৎসক-শিক্ষক দেখিয়ে অনুমোদন আদায় করা চলতো। কুমিরছানা দেখানোর কাজে এ আমল, ও আমল কেউ কারো থেকে কম যায় না। “সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে।”
তারপর হঠাৎ একদিন সরকারের মনে হ’ল, এবার ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। ব্যাস! রাতারাতি সিট বাড়তে শুরু করলো। মেডিক্যাল কলেজে এক ধাক্কায় একশো পঞ্চান্ন থেকে আড়াইশো। বাকি সব কলেজেই বাড়লো। তারপর শুরু হ’ল ধরে ধরে জেলা হাসপাতালগুলোকে ‘ইহাও একটি মেডিক্যাল কলেজ’ নাম দিয়ে ডাক্তার তৈরি। অগুনতি বেসরকারি কলেজ তৈরি হয়ে গেল। এখন অবস্থা এমনই যে হঠাৎ করে কেউ পশ্চিমবঙ্গের মোট মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারবো না। জনসংখ্যার অনুপাতে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো দরকার, এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকতে পারে না। তা বলে ন্যূনতম পরিকাঠামোর দিকে নজর না দিয়ে শুধুই সংখ্যা বাড়ালে নামেই ‘এমবিবিএস’-এর সংখ্যা বাড়ে। ‘ডাক্তার’ বাড়ে না। তারপর চিন, রাশিয়া, বাংলাদেশ থেকে পাশ করা ডাক্তার তো আছেই। ইন্টার্নশিপের সময় রাশিয়া-ফেরত কিছু ‘চিকিৎসক’কে দেখেছিলাম। ওখানে আবার শুনেছি এমবিবিএস হয় না, সবাই সরাসরি এমডি। এসব জায়গা থেকে আসা অধিকাংশ লোকজন ডাক্তারির খুব সাধারণ বিষয়গুলোই কেউ কিচ্ছু জানে না। পশ্চিমবঙ্গের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা একজন ‘এমবিবিএস’কে হাউসস্টাফ হিসেবে পেয়েছিলাম। থ্যালাসেমিয়া বাচ্চার রক্ত চালাতে বলতে দেখলাম, আজ অব্দি কোনোদিন রক্ত চালায়নি। এমনকি কেস শিটে রক্তের ইংরেজি বানান লিখেছে ‘Blud’ এবং সেও ডাক্তার! আমি এক বিন্দুও বাড়িয়ে লিখছি না। সেদিনের ঘটনার সাক্ষী অনেকেই আমার বন্ধু-তালিকায় আছেন। টাকা দিয়ে সিট কেনা আর অসংখ্য ‘কোটা’র গল্পগুলো নয় আজ বাদই দিলাম। এভাবেই হাজারে-অযুতে এমবিবিএস বানানো চলছে। আমার সময়ের থেকে সিট সংখ্যা প্রায় চারগুণ হয়েছে। অথচ সে তুলনায় পরিকাঠামো আর পড়ানোর মতো শিক্ষক বাড়েনি। নিতান্ত অন্ধভক্ত না হ’লে সবাই স্বীকার করবেন। তিরিশটা নতুন বিল্ডিং আর তিনশোটা লোহার খাট ঢুকিয়ে দেওয়াকেই শিক্ষার পরিকাঠামো বাড়ানো বলে না।
এরপরেও যুক্তি, রাজ্যে ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। এর মতো আকাট মিথ্যে কথা আর কিছু হয় না। বন্ড সার্ভিসের বেগার খাটিয়ে হাসপাতালগুলো চলছে। শেষ পাঁচ বছরে নিয়োগ হয়েছে নামমাত্র। ডেন্টাল সার্ভিসে বোধহয় প্রায় সাত বছর বাদে কিছুদিন আগে অল্প কিছু নিয়োগের নোটিশ এসেছে। জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার আর স্পেশালিষ্ট নিয়োগও শেষ ক’বছরে খুবই কম হয়েছে। ক’দিন আগে লোক দেখানো শুধু সংরক্ষণের আওতায় থাকা চিকিৎসকদের নিয়োগের নোটিশ এসেছে। এক্ষুনি ‘ওপেন ক্যাটিগরি’ নিয়োগের নোটিশ দিলে অন্তত নব্বই শতাংশ আসন পূর্ণ হবেই। আসলে সরকার নিজেই স্থায়ী-চিকিৎসক চায় না। বদলে অল্প পয়সায় ঠিকে-ডাক্তার দিয়ে কাজ চলে গেলে মন্দ কী! জনগণকে সংখ্যা দেখানো নিয়ে কথা। গুণমান নিয়ে কী যায় আসে? যত বেশি জোগান বাড়বে তত সংখ্যাতত্ত্বের নিয়ম মেনে তার গুরুত্ব কমবে। কম পয়সায় খাটিয়ে নেওয়ার মতো শ্রমিক পাওয়া যাবে।
অপরদিকে যে বন্ডের ঠিকে-ডাক্তার জানে তাকে দুই কিংবা তিন বছর বাদে এই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে হবে তার রোগী বা সংশ্লিষ্ট এলাকার সাথে আত্মিক যোগাযোগটাই তৈরি হবে না। ডাক্তারি মানে তো আর শুধু খসখসিয়ে অবুঝ প্রেস্ক্রিপশন লেখা নয়…
এর ওপরে পনেরো দিনের শিক্ষায় নার্সিং স্টাফ আর সাড়ে তিন বছরের ডিপ্লোমা ডাক্তার পেলে তো পোয়াবারো। এদের কাছে কারা যাবেন চিকিৎসা করাতে? যাবেন তো সেই গরীবগুর্বো শেখ হাসান আর হরেন দাস। তাঁরা ভালো চিকিৎসা পেলেন কিনা কার কী যায় আসে? ন্যাতামোন্তীদের জন্য আকাশঝাড়ু কর্পোরেট আর চিকিৎসা নিতে বিদেশযাত্রা তো রইলোই। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার দিকটা অল্প খরচে মোটামুটি চালিয়ে দেওয়ার নাটকটা করতে পারলেই দুকূল বাঁচে। তারপর চুন থেকে পান খসলে ডাক্তারের মুন্ডুটা তো থাকলো। ওটা সহজলভ্য।
অথচ, কথা ছিল সবার জন্য সমমানের চিকিৎসা হবে। গরীব গুর্বোর জন্য সাড়ে তিন বছরের ডিপ্লোমা ডাক্তার আর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী কিংবা বড় ব্যবসায়ীর জন্য বিলিতি দামী হাসপাতালের চিকিৎসা, এই পার্থক্যটা থাকবে না। ভালো চিকিৎসা দিতে একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রস্তুতি লাগে। অর্থ লাগে, সময় লাগে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সমস্ত রাজনীতির কুশীলবরা এগুলো ভালো করেই জানেন। শুধু সদিচ্ছার অভাবেই এই অসাম্য।
তাহলে ব্যাপার কী দাঁড়াচ্ছে? আজ থেকে বছর কয়েক বাদে গ্রামে গ্রামে ডিপ্লোমা ডাক্তার। (ডিপ্লোমা ডাক্তার তৈরি সংক্রান্ত কূট প্রশ্ন আর সম্ভাব্য টেবিলের তলার আদান-প্রদান নিয়ে প্রশ্নগুলো বাদই দিলাম)। ওদিকে রাস্তায় বাটি হাতে সদ্য পাশ ‘এমবিবিএস’। বড় হাসপাতাল চালাচ্ছে বন্ডের ঠিকে-ডাক্তার। সরকার বলবে সব হাসপাতালেই ডাক্তারের ব্যবস্থা করা গেছে। বেশ উইন-উইন ব্যাপার! নিন, থালা বাজান। এতদিন বাদে স্বাস্থ্যের ব্যাপারটার একটা হিল্লে হ’ল। গুলি মারুন সবার জন্য সমমানের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ভাবনাকে।