“শেষ পর্যন্ত আমরা এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম যে ঢিবিগুলো পেরিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম বিশাল খোলা আকাশ আর বাদামি উপত্যকা। নিচে তাকিয়ে দেখলাম দূরে তিব্বতের পাহাড়। আমাদের সামনে কেবল একটা উচুঁ ঢিবি – শেষ ঢিবি। বিরাট কিছু উঁচু নয়, মোটামুটি সহজ তুষার আচ্ছাদিত ঢাল, দু’জন পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার মতো চওড়া। তিরিশ ফুট যাওয়ার পরে একটু দাঁড়ালাম দু’জনে, ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আবার চলতে শুরু করলাম।”
১৯৫৩ সালের ২৯শে মে এভারেস্ট জয় করার পরে যে প্রশ্নটা তেনজিং আর হিলারিকে তাড়া করে বেরিয়েছে সেটা হল এই যে তাঁদের মধ্যে কে প্রথম এভারেস্ট চূড়ায় পা রেখেছেন। ওই দুই পর্বতারোহী বন্ধু নিজেদের মধ্যে চুক্তি করেছিলেন যে এই প্রশ্নের উত্তর তারা দেবেন না। সাংবাদিককূল কাঠমাণ্ডুর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন থেকে শুরু করে কোনোদিনই জিজ্ঞেস করে ওই প্রশ্নের উত্তর পান নি।
কেন দিতে চান নি, সেই ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন তেনজিং। দু’জন মানুষ যখন বাঁচার তাগিদে একে অন্যের সাথে তিরিশ ফুট লম্বা একটা দড়ি দিয়ে যুক্ত, যেটা তেনজিং এর হাতে গুটিয়ে ছোট হয়ে মাত্র ছয় ফুটে দাঁড়িয়েছে, তখন কে প্রথম চূড়ায় পা ফেলেছে এই প্রশ্নটা দুজনের কাছেই অবান্তর মনে হয়েছিল।
অনেক পরে, তেনজিং তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন, ” আমি দুঃখের সাথে বলছি, ভারতে আর নেপালে আমার ওপর খুব চাপ তৈরি করা হয়েছিল এটা বলার জন্য যে আমিই প্রথম পা ফেলেছি।” ওই ঘটনার যেহেতু কোনো সাক্ষী ছিল না সেহেতু ঘটনার বর্ণনা ওই দুজনের যে যেমন খুশি দিতে পারতেন তাদের নিজের নিজের দেশের মানুষজনকে খুশি করতে, তারা সেটাই বিশ্বাস করতো। কিন্তু সেটা দেন নি।
তেনজিং এর মনে গিয়েছিল যে সত্যিটা জানানো দরকার। কেন মনে হয়েছিল তার উত্তর উনি নিজেই দিয়েছিলেন এই ভাবে, “রহস্যটা রহস্য হিসেবে রেখে দিলে, ভবিষ্যত প্রজন্ম কি ভাববে আমাদের সম্বন্ধে ? আমরা, যারা দুজন জীবনে মরণে কমরেড ছিলাম, তাদের কি কিছু লুকোনোর আছে ? এই প্রশ্ন আমি নিজে নিজেকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। প্রতিবারই এক উত্তর পেয়েছি। ওনলি দ্যা ট্রুথ ইজ গুড এনাফ ফর দ্যা ফিউচার, ওনলি দ্যা ট্রুথ ইজ গুড এনাফ ফর এভারেস্ট।”
প্রিয় পাঠকদের মধ্যে যারা তেনজিং এর আত্মজীবনী “টাইগার্স অফ দ্যা স্নো” পড়ে ফেলেছেন তারা ওই বহুল চর্চিত প্রশ্নের উত্তরটা জানেন। আর আমিও কোনো আগাথা ক্রিস্টি মার্কা মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার লিখতে বসিনি। লেখাটা এখানেই শেষ করে দেয়া যায়। হিমালয়ের যে বিশালতা সত্যকথনে তেনজিংকে উদ্বুদ্ধ করে ছিল সেটাই তো আজকের গল্প।
এই পোস্ট ট্রুথ এর যুগে চারদিকে সত্য যখন ম্যানুফ্যাকচার করা হচ্ছে আমাদের গেলাবার জন্য, আমাদের নেহাৎ নির্বোধ অবোধ ঠাউরে তখন তেনজিং এর ওই সহজ সরল স্বীকরোক্তি কেমন একটা অদ্ভুত সাহস যোগায়। দরিদ্র পরিবারের শেরপা, ঘরের পাশের দার্জিলিং এর বাসিন্দা, পৃথিবী বিখ্যাত খ্যাতি পেয়েও যার মাথাটা ঘুরে যায় নি, সেই মানুষটার কথা আজ এত দিন বাদে ২৯শে মে স্মরণ না করাটা অপরাধ হবে।
এবার সেই বহু প্রতীক্ষার উত্তরে ফেরা যাক। তেনজিং এর নিজের ভাষায়, “হিলারীই পাহাড় চূড়ায় প্রথম পা ফেলেছিল, তার পরে আমি। আমরা পা ফেলেছিলাম চূড়ায়, আমাদের স্বপ্ন সফল করতে।”
সত্যি কথা বলার সাহস যদি হারিয়ে ফেলি কোনো দিন, তাহলে একটিবার উত্তরের দিকে তাকাবো, হিমালয়ের দিকে তাকাবো। মনে রাখবো পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত দ্বিতীয় স্থান অধিকারী মানুষটার কথা। তেনজিং।