জীবনের প্রতিটি অণু পরমাণুতে লুকিয়ে থাকে কোন নতুন অভিজ্ঞতা। কখনো সেটা ব্যক্তি কেন্দ্রিক, কখনো কোন ঘটনা কেন্দ্রিক, আবার কখনও বা সম্পূর্ণ নিজের ভিতরে তৈরি হওয়া কোন গভীর উপলব্ধি। আজ সেরকমই এক অভিজ্ঞতার কথা বলবো যার কেন্দ্র চরিত্রে রয়েছে একটি কয়েক মিলিমিটার লম্বা, জলের ভিতর তরতর করে ছুটে চলা ফাইটার বা বেটা ফিশ।
গতবছর আগস্টে এখানকার এক উইকেন্ড মার্কেট থেকে একজোড়া ফাইটার এনেছিলাম, একটির রঙ লাল, আরেকটি তুঁতে। নাম রাখলাম লালকমল আর নীলকমল। আনার পর বেশ কয়েকদিন তাদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তা গেছে, প্রায় দুসপ্তাহ মতন কেউ কিছু মুখে নেয় নি। লালকমল অবশ্য কয়েক দিন পর থেকে একটু একটু করে খেতে শুরু করলো। কিন্তু নীলকমল ওঠেই না ওপরে, চুপ করে নীচে বসে থাকে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে ওদের দিকে তাকাতাম, মাঝে মাঝে রাতে ফোনের টর্চ জ্বালিয়েও দেখতাম। বেরোবার সময় একবার ভালো করে দেখে নিতাম, আবার দিনের শেষে ফেরার সময়ে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে শুরু হতো টেনশন। ফিরে এসে লাইট অন করে জলের দিকে তাকিয়ে তবে শান্তি!
এইভাবে প্রায় একমাস চললো, তারপর নীলকমল আমায় দয়া করলো। একদিন সকালে ঢাকা সরানোর পর আস্তে করে ওপরে উঠে এলো, আমি সঙ্গে সঙ্গে খেতে দিলাম। ওহ্! সে যে কি তৃপ্তি, মনে হচ্ছিলো গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দি।
লাল-নীলের জুটি হয়ে উঠলো আমার প্রলাপ বকার শ্রেষ্ঠ শ্রোতা! দিনের শেষে বাড়ি ফিরে একতরফা কথা বলতে ভালোই লাগতো, এতো কথা জমে যায়, কখনো রাগ, কখনো বিরক্তি, কখনও বা নিছক কোন মজার কথা। সময়ের সাথে ওরাও বড় হলো, গল্প মজা হাসি ঠাট্টায় দিন কাটছিলো বেশ। কিন্তু এইবছর মার্চের শেষে লকডাউনের প্রথম দিনেই লালকমলকে হারালাম!
আজকাল কোন কিছুতেই আর তেমন কষ্ট পাই না! তাই তিনজন থেকে দুজন হওয়াটা সহজেই মানিয়ে নিলাম! তবে, এই দুজন হওয়ার পর থেকেই নীলকমলের ব্যবহার আমার মনের মধ্যে একটা নিবিড় অনুভূতির সৃষ্টি করলো।
নীলকমলকে যখন এনেছিলাম তখন ও ছিল সম্পূর্ণ নীল (তুঁতে) আর অন্য জন পুরোপুরি লাল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে লাল চলে যাওয়ার পর থেকেই নীলকমল কিরকম নিজেকে বদলে ফেললো। নীলের সারা শরীরে লালের ছোঁয়া, নীল যেন শুধু একটু উঁকি মারে। নীলের দুটো ছবি পাশাপাশি রাখলে কে বলবে দুজন এক! স্বভাবেও নীল শান্ত ছিলো বেশ, নিজের মনে চুপচাপ থাকতো। হঠাৎ করেই যেন দুষ্টুমিটাও বাড়লো লালের মতন। একদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে ওর সামনে বসে আছি, হঠাৎ মনে হলো নীল যেন লালের অভাব পূরণ করতে চাইছে। লালের চলে যাওয়ায় আমার কষ্টটা ও যেন বুঝতে পেরেছে! লাল যেদিন চলে গেলো, ওকে সরিয়ে আনতে গিয়ে নিজের অসাবধানেই হয়তো দু চার ফোঁটা নোনা জল পড়েছিলো নীলের গায়ে! মাঝে মাঝে মনে হয় সেদিন থেকেই হয়তো শুরু নীলের রূপান্তর!
আমার এই ভাবনার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় এটা নিছকই কোইন্সিডেনস- লালের অন্তর্ধান আর নীলের পিগমেন্টেশন। কিন্তু আমার কাছে এটা একটা সংযোগ…. জীবনের সাথে জীবনের। আমরা তো কাছের মানুষের কষ্টে এইভাবেই পাশে থাকতে চাই, নিজের সাথে আপোষ করে, ধৈর্য্য ধরে, যত্ন করে তাকে ভালো রাখতে চাই। প্রয়োজনে নিজেদের বদলেও ফেলি। অনেক সময়ে তো “আগের আমি” আর “এখনের আমি” কে চিনতেও পারিনা আমরা। কিন্তু বদলটার কি খুব প্রয়োজন! নীল যদি নীলের মতোই থাকতো, আমি কি ওকে কম আদর দিতাম! আমি তো ওকে নীল বলেই ভালোবাসতাম। আজও ও আমার কাছে “নীল” ই, তবে সে “লাল” হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, বা বলা যায় লালের ঘাটতি মেটাতে ও ওর “নীল” সত্বাকে স্যাক্রিফাইস করছে। ওর এই নিঃশব্দে অতি সংযতভাবে লাল হয়ে ওঠার পারিশ্রমিকের চাহিদা নেই সেরকম, দু চারবার সামনে আঙ্গুল ঘুরিয়ে খেলা করে নিলেই খুশী। কিন্তু, আমি কি ওর এই রূপান্তরের যথাযথ মূল্য দিতে পারছি? দ্ধিগুন ভালোবাসায় উপচে ফেলতে পারছি ওকে? না তো, বরং একটু একটু করে প্রস্তুতি নিচ্ছি আরেকটা কঠিন সময়ের। তাহলে এই বদলটার প্রয়োজন কি? আমরা কি বাস্তবিক জীবনে নীলের মতন এইটুকুই প্রত্যাশা করি! আমাদের দাবির ঝুলিটাকি এতোটাই হালকা! নিশ্চয়ই নয়, তাই জন্যেই তো রাগ ক্ষোভ হতাশা পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব এতো বেশি!
অসহায় সময়ে এইভাবে পাশে পাওয়া কোন সরল ভালোবাসা একটা মানুষিক পথ্য। যে সকল মানুষ ডিমেনশিয়ায় জর্জরিত, তাদের ভালো রাখার একটা বড় পদ্ধতি হলো তাদের অতীতের চেনা জগতের একটা রেপ্লিকায় দিন কাটাতে দেওয়া। অ্যাকিউট সাইকোসিসের ক্ষেত্রেও সেই একই ভাবে একজন নীর্ভরশীল বন্ধুর প্রয়োজন। শুধু অসুস্থতা নয়, বাস্তব জীবনে একজন মানুষ নিরন্তর খুঁজে চলেছে এইরকম এক শান্ত পবিত্র আশ্রয়। তবে, আমরা “উন্নততম প্রানী”, মস্তিষ্কের জটিলতায় সবাইকে টেক্কা দিয়েছি। তাই আত্মত্যাগ করে অন্যকে ভালো রাখার যত বড় ব্রতই আমরা নি না কেন ফলোপ্রসু করতে গিয়ে তার কাউন্টার ট্রান্সফারেন্সের জালে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু আমার “নীল” পারে অতি সহজে এই অসাধ্য সাধন করতে। শুধু আমার নীল নয়, লালি, কালি, হাঁরু, ভুলু, পেঁচি, টেঁপি, কিংবা রোজের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া নীলের আরও অনেক বন্ধু এই কাজ করছে বহুদিন ধরে। আর এরা আছে বলেই, এখনো এতো না পাওয়ার অন্ধকারে আলোর রোশনাই আছে, ঠিক যেন “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো”!
“Pet Therapy” is a modern tool to address neuropsychiatric issues and to promote Wellness.
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে অত্যন্ত সহজ ছন্দে প্রকাশ করা হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি “পোষ্যদের ভালবাসা সত্যিই মানুষের জীবনবোধ আমূল বদলে দিতে পারে।
বেটা ফিশের রং পরিবর্তনটা এখানে বোধহয় রূপকার্থে বা লেখিকার ভাষায় কো ইন্সিডেন্স ধরা যায়। তবে পেট থেরাপি এখন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অবসাদ, উদবেগ কাটানো একাকিত্ব দূর করা এবং মোটর স্কিল বাড়ানতেও পেট থেরাপি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আরো বিশদে লেখা পাওয়ার আশা রইল।
ভালো লেখা।