মহিলাদের মধ্যে যে ক্যান্সার শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি হয় তা হলো ব্রেস্ট (স্তন) ক্যান্সার। শহুরে জীবনযাত্রা, কম শারীরিক পরিশ্রম, স্থুলতা, সন্তানকে স্তন্যপান না করানো, পারিবারিক ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস– এ সবই ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার জন্য এক একটি রিস্ক ফ্যাক্টর।
আসুন জেনে নিই ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে (স্টেজ) ডায়াগনোসিস করার জন্য মহিলারা কি কি স্ক্রিনিং টেস্ট করতে পারেন আর যদি ব্রেস্ট ক্যান্সার একবার ডায়াগনোসিস হয় তাহলে তার চিকিৎসা কি।
ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিংঃ
স্ক্রিনিং হলো সুস্থ মানুষদের কিছু কিছু পরীক্ষা করা যাতে তাদের কারো কারো মধ্যে যদি ক্যান্সার বা ক্যান্সারের সম্ভাবনা (প্রিক্যান্সারাস লিসন) থেকে থাকে তাকে সিম্পটম আসার আগেই ধরে ফেলে চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা। ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এটি একটি খুবই কার্যকরী পদ্ধতি, একে খুব প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়েগনোসিস করে সম্পুর্ন রূপে সারিয়ে তোলা যায়।
কারা করবেন স্ক্রিনিং, কি ভাবে করবেন ?
সমস্ত ৪৫ বছরের ওপরে মহিলারা এই স্ক্রিনিং– ম্যামোগ্রাম অবশ্যই করান বছরে একবার আর ৪০ থেকে ৪৫ বছর অব্দি মহিলারাও এতে সামিল হতে পারেন। এটি একটি বিশেষ ধরনের এক্স রে এবং খুবই নিরাপদ ও ব্যথা-বেদনাহীন পদ্ধতি। যাঁদের পারিবারিক ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তাঁরা আরো কম বয়স থেকে স্ক্রিনিং শুরু করুন, সেক্ষেত্রে কম বয়েসিদের এম আর আই স্ক্রিনিং করতে হবে। এছাড়া বছরে একবার একজন ট্রেইনড ডাক্তারের কাছে ব্রেস্ট এক্সামিনেসন করানোটাও খুব ই কার্যকরী পদ্ধতি। যদিও নিজেই নিজের ব্রেস্ট পরীক্ষা করার গুরুত্ব খানিকটা কমেছে তাও ভারতের মতো বিরাট দেশে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হতে পারে কেননা অনেকের পক্ষেই নিয়মিত ডাক্তার দেখানো অথবা ম্যামোগ্রাম করানো সম্ভব নাও হতে পারে।
ব্রেস্ট ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হলে কি করবেন?
আপনাকে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ অনকোলজিস্ট বা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের তত্বাবধানে চিকিৎসা করাতে হবে। সাধারণত ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অপারেশন, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং প্রয়োজন হলে হরমোন থেরাপি ও টারগেটেড থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে। মনে রাখবেন ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্পূর্ণ সেরে যাবার হার খুবই ভালো এবং এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্রেস্ট সম্পূর্ণ কেটে বাদ না দিয়েই চিকিৎসা সম্ভব। এজন্য ব্রেস্ট ক্যান্সার ডায়াগনোসিস হলে অবশ্যই এমন কোন হাসপাতালে যান যেখানে এই সব সুবিধাগুলি পাওয়া সম্ভব। ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় অভুতপুর্ব উন্নতি হয়েছে রেডিয়েশন (রেডিওথেরাপি) এবং সার্জারী চিকিৎসায়। উন্নত রেডিয়েশন মেশিনের সাহায্যে ন্যূনতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এখন খুব কম দিনের মধ্যে চিকিৎসা করা সম্ভব আর এর ফলে স্তন ক্যান্সারে স্তন কেটে বাদ দেওয়ার আর প্রয়োজন হয় না। একজন ক্যান্সার সার্জন শুধু টিউমারটা বাদ দিয়ে দেন আর তারপর একজন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট রেডিয়েশন চিকিৎসার মাধ্যমে বাকি আণুবীক্ষণিক ক্যান্সার কোষকে বিনষ্ট করেন। এর ফলে স্তনের আকার ও আকৃতি বজায় রেখে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব হয়। ব্রেস্ট অপারেশনের পরে উন্নত পদ্ধতিতে রেডিয়েশন চিকিৎসা করে খুবই ভালো নিরাময় ও কসমেটিক রেজাল্ট পাওয়া সম্ভব। সামাজিক ভাবেও রোগীকে কোনপ্রকার অস্বস্তিতে পরতে হয় না কেননা চিকিৎসার পর স্তনের গঠনগত পরিবর্তন যতসামান্যই হয়।
স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় হরমোন থেরাপিও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। এটি একটি খাওয়ার ওষুধ এবং বাড়িতে রোগী নিজেই রোজ সেবন করতে পারেন।
কিছু কিছু স্তন ক্যান্সার হার টু নিউ বলে একধরনের মলিকুলার মার্কার পজিটিভ হয় এদের ক্ষেত্রে টারগেটেড থেরাপি প্রয়োজন। এই টার্গেটেড থেরাপি হল ওই বিশেষ টার্গেটকে আক্রমণ করে ক্যান্সার কোষকে বিনষ্ট করা। ট্রান্সটুযুম্যাব হলো এইরকম একটি টার্গেটেড এজেন্ট বা ওষুধ।
পৃথিবীতে হাজার হাজার মহিলা স্তুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, কিন্তু সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে একে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তা আরও সুনিশ্চিত হয় যদি অসুখটা আগে ধরা পড়ে মানে আর্লি স্টেজে ধরা পড়ে, তাই স্ক্রিনিং করান অবশ্যই। স্ক্রিনিং খুবই স্বল্পব্যয়ে এবং কম সময়ে করা সম্ভব। ব্রেস্ট ক্যান্সারকে হারাতে প্রয়োজন তাড়াতাড়ি ডায়াগনোসিস এবং সময় নষ্ট না করে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের অধীনে সুচিকিৎসার।
(সুচিকিৎসা পত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ, কারো দরকারি মনে হলে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন।)