দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা প্রথমবার এক লাখ ছাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
আগের বছর প্রথম ঢেউ এর সময় রোগীর সংখ্যা আস্তে আস্তে বেড়েছিল। তখন লকডাউন চলছিল। লকডাউন ওঠার পরও লোকাল ট্রেন অনেক দিন চলেনি। লোকজনও সচেতন ছিলেন।
এবছর রোগীর সংখ্যা বাড়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার চিহ্ন মাত্র নেই। সামান্য মাস্ক পরেই রোগের ছড়ানোটা অনেক কমানো যেতো। কিন্তু ৯০% লোকই মাস্ক পরছেন না।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে ভোটের জন্য। নেতা- নেত্রী থেকে প্রশাসনের সকলের এখন পাখির চোখ ভোট। ভোটের পরে আবার করোনা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হবে।
রাজনৈতিক দলগুলি এই মহামারীর মধ্যেও যেভাবে জমায়েত করছে সেটা রীতিমতো অপরাধ। এব্যাপারে ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী- সব দলই এক। কিন্তু তাঁরা সব নিয়ম কানুনের ঊর্ধ্বে।
একটাই ভালো ব্যাপার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মৃত্যু হার এখনো ১% এর কম। না হলে এতোদিনে ঘরে ঘরে হাহাকার শুরু হয়ে যেতো।
তা বলে হাল ছেড়ে বসে থাকা একেবারেই উচিৎ নয়। মহামারী বারবার তার চরিত্র বদলায়। ফলে মৃত্যু হার যে পরবর্তী কালে আচমকা বেড়ে যাবে না, সেটাও বলা মুশকিল।
আমাদের মতো খুপরিজীবি চিকিৎসকদের কাছে সময়টা মোটেও সুখের নয়। আগের বছর লকডাউনের সময় মনের উপর যতই চাপ থাক, রোগীর চাপ অনেক কম ছিল। এবছর রোগীর চাপ সামলানো মুশকিল হচ্ছে। তাছাড়া দিনের পর দিন একঘেঁয়ে রোগী দেখতে বেশ ক্লান্তি লাগছে।
বাংলায় শতাধিক চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন। এভাবে সহকর্মীদের অকালে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কষ্টকর। সাধারণ মানুষের মাস্ক ব্যবহারের অনীহা দেখে রাগ আরও বাড়ছে।
নানা রকম অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি। বয়স্কদের ভ্যাকসিন দেওয়া বেশ কিছুদিন শুরু হয়েছে। এতোদিন বেশিরভাগ মানুষই তা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। ঘরের পাশে করোনা এসে যাওয়ায় সকলেরই টনক নড়েছে।
দলে দলে মানুষ আসছেন। একটাই প্রশ্ন ‘আমি কি ভ্যাকসিন নিতে পারি? আমার নানা রকম অসুখ আছে।’
একই উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ ইত্যাদি রোগে ভ্যাকসিন দেওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বস্তুত এনাদেরই আগে ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ। কারণ অন্য অসুখ থাকলে করোনায় মৃত্যু হার বেড়ে যায়।
ভ্যাকসিন রোগ কতদূর প্রতিরোধ করে এখনো বলা মুশকিল। কিন্তু এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। আর ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নিয়ে নিলেও কিন্তু মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ।
অদ্ভুত অদ্ভুত কারণেও অনেকে আসছেন। যেমন একজন ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়ে ফিরছিলেন। রাস্তাতেই কুকুরে কামড়েছে। তাঁর প্রশ্ন কুকুরে কামড়ানোর ভ্যাকসিন কি এই অবস্থায় নেওয়া যেতে পারে?
মানুষের জিজ্ঞাসার শেষ নেই। ‘ভ্যাকসিন নেওয়ার আগের দিন কি নিরামিষ খেতে হবে? ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে কি টক খাওয়া চলবে?’
‘ভ্যাকসিন দেওয়ার পর রাত্রে জ্বর আসেনি। তাহলে কি ভ্যাকসিন কাজ করবে না?’
‘দু-রকম ভ্যাকসিন আছে শুনেছি। কোনটা নেওয়া ভালো?’
‘দিদিমণিরা বলেছেন চার সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ নিতে। অথচ খবরের কাগজে দেখলাম ৪৫ দিন বাদে নিলে ভালো কাজ করবে। কী করবো?’
‘বাবা বিছানায় শয্যাশায়ী। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কোনো ভাবে কি বাড়িতে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়?’
অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও স্পষ্ট নয়। মাঝে মাঝে ধৈর্য্যও হারিয়ে ফেলছি।
তবে এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি এবারের লড়াইটা আগের বারের থেকে অনেক কঠিন। আমরা নেতৃত্ব বিহীন সাধারণ সৈন্যদল একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
সকলের কাছে করজোড়ে অনুরোধ মাস্ক পরুন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আবার লকডাউন আমরা কেউই চাই না। লকডাউনকে ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরুন।
খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে, পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থে মাস্ক পরুন।
ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো এক বছরের উপর স্কুলে যায়নি। বদ্ধ ঘরের মধ্যে তাদের মানসিক বিকাশ থমকে গেছে। বাচ্চাগুলোর স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে মাস্ক পরুন।
বাংলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে করোনায় মৃত্যু হার বেশ বেশি। তাঁদের বাঁচতে দিন- মাস্ক পরুন।