শেষের শুরু
“ মার শালা ডাক্তারটাকে, বাইরে থেকে এসে হিরোগিরি মারাচ্ছে।” বাঁ চোখের ঠিক ওপরে এসে লাঠিটা পড়ে। সাথে সাথে অন্য একজন তলপেটে লাথি কষায়। যন্ত্রণাটা পেট থেকে মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। জনার্দন বেশ বুঝতে পারে রক্তের একটা ধারা বাঁদিকের গাল বেয়ে নেমে আসছে। আবছা ভাবে দেখতে পায় তিতির দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ইঁদুর ধরার মজামাখা মুখ নিয়ে একটা লুঙ্গি পরা লোক তিতিরকে ধরতে যায়। আতঙ্কে চোখ বোজে জনার্দন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘুঁষি এসে পড়ে জনার্দনের মুখে। কে যেন একটা কালো চাদর এনে জনার্দনের চেতনাকে আস্তে আস্তে ঢেকে দেয়।
গোড়ার কথা
“উই ডোন্ট ওয়ান্ট আ রিপিটেশন অব দিজ স্টোরি, জিজি।” সিনেমাটা শেষ হতে একটু মজা করেই বাবা বলেছিলেন। ‘ টু স্টেটস’ নামের এক জনপ্রিয় ইংরাজি উপন্যাস থেকে গল্পটা নেওয়া। দুই ভিন্ন রাজ্যের দুই ভিন্ন সংস্কৃতির ছেলে মেয়ের প্রেম- বিবাহ নিয়ে গল্প। জনার্দনের হায়দ্রাবাদের বাড়িতে বসে সপরিবারে ওরা সিনেমাটা দেখেছিল। বাবা দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার। ওনার নাম শুনলে বড়বড় গুন্ডা বদমাশদের প্যান্ট কাচতে দিতে হয়। গুন্ডাসমাজে বাবার যেরকম নামডাক ঠিক ততোটা ভয়ংকর অবশ্য কোনোদিনই জনার্দনের মনে হয়নি। তবে বাবার চোখদুটো বেশ রাগি রাগি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে এমনিই লোকে হার্টফেল করবে, গুলিগোলা চালানোর প্রয়োজন হবেনা। জনার্দন বাবার চোখকে বেশ ভয় পায়। হায়দ্রাবাদ থেকে এম বি বি এস পাস করে এটা সেটা পরীক্ষায় বসছিল জনার্দন , এখন তো স্পেশালিষ্ট না হলে কোনো দামই নেই। আর লেগেও গেল ডি এন বির মাধ্যমে সার্জারিতে স্পেশালাইজেশন। ডি এন বিতে সারা ভারতের যেকোনো অঞ্চলে পড়াশোনা করে স্পেশালিষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে। জিজির কপালে জুটলো বাংলা।
জিজি জনার্দনের ডাকনাম। তিতির খুব হেসেছিল, জিজি কারো নাম হয় নাকি। জি ফর গোবর অ্যান্ড জি ফর গণেশ। তিতিরের বোনঝি নাকি মাছকে জিজি বলে। আরে, সারা ভারতের অধিকাংশ বাচ্ছা দুর্বোধ্য কারণে মাছকে জিজি বলে। কিন্তু জিজি বেশ স্মার্ট নাম। কে বোঝায় তিতিরকে। আর তিতির একটা নাম হল নাকি? তিতির নাকি একটা পাখির নাম। নিশ্চয় একটা বকবক করা পাখি হবে। সারাক্ষণ বকবক করে যাচ্ছে। তিতির তখন মুড়ি খাচ্ছিল। হাতের মুড়িটাকে দুবার নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো – “ এটাকে তোমরা কি বল?” জিজির উত্তর শুনে হেসে লুটিয়ে পড়ে তিতির – “ বুঙ্গলু? হা হা এরা মুড়ি না খেয়ে বুঙ্গলু চিবোয়।”
তবু ‘ টু স্টেটস’ গল্পের মতো জনার্দনও আপাদমস্তক অন্য রাজ্যের মেয়ে তিতিরের প্রেমে পড়েছে। আর সবথেকে ভয়ের ব্যাপার তিতিরের সাথে বেশীক্ষণ গল্প করলে ও পরিষ্কার বুঝতে পারে বাবা হায়দ্রাবাদের বাড়িতে খুব রাগরাগ মুখ করে ‘ টু স্টেটস ‘ সিনেমার সিডিটা দেখছে। আর জনার্দন তখন তিন বছর ধরে শেখা বাংলা ভাষা ভুলে মাতৃভাষায় তিতিরকে কিছু বলে বসে। তিতির হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।
তিতির মেডিসিনে এম ডি করছে। তিতির পাস করে হায়দ্রাবাদ চলে যাবে বলেছে। অথচ মেয়েটার জনার্দনের ভাষা শেখার কোনো ইচ্ছে আছে বলে মনে হয়না। তিতিরের প্ল্যান প্রোগ্রাম বোঝা দায়। অথচ তিতিরের সাথে জনার্দনের আলাপটাই হয়েছিল ভাষার ঝামেলার জন্য।
তখন সদ্য কলকাতায় এসেছে জনার্দন। বাইপাসের ধারে একটা কর্পোরেট হাসপাতালে ডি এন বির অ্যাটাচমেন্ট। কলকাতার মিষ্টি বিখ্যাত। হাসপাতালের কাছেই একটা মিষ্টির দোকান। সন্ধেবেলায় জনার্দন প্রায় নিয়ম করেই ওখানে মিষ্টি খেতে যেতো। প্রথমবার ওদের ইউনিটের জয়েশদার সাথে এসেছিল। একটা মিষ্টি বেশ ভাল লেগে যায়। জয়েশদাকে মিষ্টির নামটাও জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল। বাংলা ভাষায় অনভ্যস্ত কানের জন্যই হোক আর ভুলে গিয়েই হোক মিষ্টির নামটা জনার্দনের কাছে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। দোকানের ছেলেগুলোও বেশ বদমাশ। বারবার কোন মিষ্টিটা জনার্দন চায় জিজ্ঞেস করতো। তিতির ওর বান্ধবী রূপসার সঙ্গে একই সময়ে একদিন ওই দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে এসেছিল। সুন্দরী মেয়েদের দেখে মিষ্টির দোকানের ছেলেদের সেদিন মারকাটারি ফর্ম। বারবার জিজ্ঞেস করে নিচ্ছিল জনার্দন ‘ল্যাংটা’ই চাইছে কিনা। তিতির জনার্দনকে জিজ্ঞেস করে “ হোয়ার আর ইউ ফ্রম?” তারপর জানায় মিষ্টিটার নাম ল্যাংচা। অনেক পরে এক গভীর মুহূর্তে জিজি ল্যাংটা মানেটা তিতিরের কাছ থেকে জেনেছিল।
তিতির ন্যাশনাল মেডিকাল কলেজ থেকে এম ডি করছে। ওর ব্যাচমেট রূপসা জনার্দনদের হাসপাতালে অ্যানাস্থেসিয়া ডিপার্টমেন্টে আছে। রূপসার সাথে তারপর থেকে ভাল আলাপ হয়ে যায় জনার্দনের। যেহেতু রূপসার কাছে তিতির প্রায়ই আসে সেহেতু তিতিরও জনার্দনের ভাল বন্ধু হয়ে যায়।
বন্ধুত্ব থেকে প্রেম কি করে হয় তা ‘দেবা ন জানন্তি’। একদিন তুমুল বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় তিতিরকে বাসস্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়েছিল জিজি। বেচারি বাস থেকে নেমে আবার ভিজবে- এই ভেবে ছাতাটা তিতিরকে দিয়ে দিয়েছিল জনার্দন। ছাতা নিয়ে দিব্যি বাসে উঠে গিয়েছিল তিতির। কি ভেবে সঙ্গে সঙ্গেই আবার নেবে আসে। ছাতা মাথায় দুজনে আবার হোস্টেলে ফিরে আসে। জনার্দনের মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে তিতির বলেছিল বিদেশ বিভুঁইতে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগালে দেখবেটা কে?
কথাটায় কি কোনো ইঙ্গিত ছিল? নাকি এমনি বন্ধুকে সাবধান করা? বাইরের বৃষ্টি কি দুজনের ভেতর পর্যন্ত পৌঁচেছিল? নাহলে জনার্দনের বুকের ভেতর জলের তোড়ে বাঁধ ভাঙবে কেনো? ভালোলাগার বন্যায় ভেসে যেতে যেতে জনার্দন বলেছিল -” তুমি তো আছো।”
আবার জনার্দন তিতিরকে বাসে তুলে দিয়ে এসেছিল। ফেরার পথটা তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফিরেছিল। এমনিতে জনার্দনের ঠান্ডাফান্ডা কম লাগে। জ্বরজ্বালাও খুব একটা হয়না। কিন্তু সেবারে বাজে রকম জ্বরে ভুগতে হয়েছিল। একটাই লাভ, জ্বরের সময় তিতির রূপসাদের হোস্টেলে এসে উঠেছিল। তিনবেলা তিতির জনার্দনকে দেখে যেতো। সাতদিন বাদে জ্বরটা যখন শেষবারের মতো টা টা করে বিদায় নিল তখন পার্মানেন্টলি তিতিরের একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি জিজির মানিব্যাগে স্থান করে নিয়েছে।
তিতিরের সাথে দুচারদিন দেখা না হলে জনার্দন ভয় দেখায়- যেকোনো মুহূর্তে কিন্তু জ্বরে পড়ে যেতে পারি।
যদিও তারপর থেকে এই আড়াই তিন বছরে জিজি আর জ্বরে পড়েনি তবুও তিতির ওর বাবা মার সাথে ওর আলাপ করিয়ে দেবার সময় বলেছিল – “এই সেই জ্বরজ্বালায় ভোগা চিররুগ্ন ছেলেটা।” তিতিরের মা খুব সহানুভূতির সাথে বলেছিলেন “এতো সুন্দর লম্বা চওড়া ছেলে, এতো অসুস্থ হলে চলে?” তারপর তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন -“তুই মাঝেমধ্যে ওর খোঁজখবর নিস।”
নিয়ম করেই খোঁজখবর রাখে তিতির। জনার্দনের অ্যাডমিশন ডে অর্থাৎ চব্বিশ ঘন্টা ডিউটির দিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একসাথে কাটায়। ইউনিটের সবার সাথে একেবারে ডিনার করে রাতে রূপসার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আর তিতিরের অ্যাডমিশন ডেতে জনার্দন ওদের হাসপাতালে চলে যায়। জনার্দন অবশ্য রাত্রিবেলায় নিজের হোস্টেলে ফিরে আসে।
ইদানীং তিতিরকে অ্যাডমিশন ডেতে আসতে বারণ করে জনার্দন। জিজি বুঝতে পারে যত দিন যাচ্ছে ততো মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। আর বাইপাসের ধারে এই হাসপাতালটা বেশ নির্জন জায়গায়। অনেকের চোখেই তিতিরের এই আসা যাওয়াটা চোখে পড়ে। তবু তিতির আসে। অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আর সত্যি বলতে কি তিতির না আসলে জনার্দনেরও দিনটা অদ্ভুত কাটে। মনে হয় সূর্য বাইপাসের ধারটায় আলো ফেলতে ভুলে যায়, দিনটা আর্থাইটিসের পেশেন্টের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোয়, রাত্রি আসে এক অদ্ভুত আঁধার নিয়ে, জীবনটা যেন ভরা সভায় গান গাইতে উঠে সুর ভুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অবহেলায়, অনাদরে একটা দিন যেন জীবন থেকে টুপ করে খসে পড়ে।
তাই জিজির বারণ করার মধ্যে তেমন জোর থাকেনা। মাঝে কয়েকদিন তিতির জনার্দনের অ্যাডমিশন ডের দিন ওদের হাসপাতালে আসেনি। এখন আবার আসতে শুরু করায় জনার্দন ঠিক করে বারণ করতে পারেনা।
তিতির সেদিন এসেছিল অ্যাডমিশন ডেতে। ওই প্রথম পেশেন্টটাকে দেখেছিল। রোড ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট, ভোররাতে গড়িয়াহাটের দিক থেকে বিজন সেতুতে ওঠার মুখে স্কিড করেছিল ছেলেটার বাইক। মাথায় হেলমেট ছিলনা, মুখে অ্যালকোহলের গন্ধ। যখন হাসপাতালে এসেছিল তখন প্রায় পরোপারের টিকিট বুক করে এসেছিল। জনার্দন ছেলেটার ট্রাকিওস্টোমি করতে বাধ্য হয়। গলার কাছে ফুটো করে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা সেটা। নাহলে ছেলেটি ওখানেই শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যেতো। খবরটা ছড়িয়ে ছিল। হাসপাতালেরই কোনো কর্মচারী নিশ্চয় গলাকাটার গল্পটা বাইরে চালান করেছিল। উদ্দেশ্য যাই থাক – আক্ষরিকভাবে গলাকাটার ব্যাপার শুনে জনগণ একটু উত্তেজিত ছিল। সি ই ও রামানুজ সাহেব বেশ ধমক দিয়ে জনার্দনকে ফোন করেছিল।
“কিন্তু পেশেন্ট তো ট্রাকিওস্টোমি না করলে মারা যেতো।”
“মারা গেলে যেতো। সেটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বুঝে নিতো।” রামানুজ সাহেবের সপাট জবাব। মিডিয়াও খবরটাতে নাকি তেল নুন মশলা মাখিয়ে ফেলেছে। ভেতরের খবর যে এক ডাক্তার- নেতা, যে ডাক্তারিটা মোটামুটি ভুলে গেছে, একজন সার্জেন, যে কোনটা করলে কি কি ক্ষতি হতে পারে সেব্যাপারে বিশেষজ্ঞ আর খানদুই সর্বঘটে কাঁঠালি কলা মানুষকে টিভি চ্যানেল বসিয়ে ফেলেছে। বাজার করতে আসা মানুষ থেকে কিছু না করতে আসা পথচারী নাকি টিভি চ্যানেলটায় পাগলা কুকুরের মতো বাইট দিচ্ছে। গলাকাটা চিকিৎসা ক্যাপশন টিভির তলা দিয়ে সারা দুপুর স্ক্রল করে করে ক্লান্ত। এরকম অবস্থায় তিতিরকে জনার্দন চলে যেতে বলেছিল। তিতির বাইরে বেরনোর সাহস পায়নি।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ আই সি ইউ থেকে খবর এলো পেশেন্টটা মারা গেছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ঘনঘন মিটিং করছে। ভেন্টিলেটর থেকে এখনি সরানো হবে না ঠিক হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিতির চুপ করে ডক্টরস’ রুমে বসেছিল। জনার্দন বেচারির দিকে তাকাতে পারছিল না।
চাপচাপ একটা কালো ভয় ডক্টরস’ রুমের আনাচেকানাচে ছড়ানো। এমার্জেন্সি থেকে সার্জারিতে ভর্তি আটকে রাখা হয়েছে। কাজের চাপ অনেক কম। দুপুরে কারো খাওয়াও হয়নি। চা আর কফির ওপর সবাই রয়েছে। শ্বাপদের মতো আশঙ্কা জাগিয়ে সন্ধে নামে।
প্রথমে তিনজন অচেনা লোক ডক্টরস’ রুমে ঢুকে আসে। জয়েশদাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে জনার্দনের কথা। জনার্দন সেই মুহূর্তে ঘরে ছিলোনা। তিতির ফোন বার করতেই একজন ওর দিকে তেড়ে আসে। আর তখনি জিজি ঘরে ঢোকে। ওরা বুঝতে পারে পেশেন্টের মারা যাওয়ার খবরটা বাইরে ছড়িয়ে গেছে। তিতিরকে একজন তাড়া করে যায়। বাইরের লবিতে বেরিয়ে এককোণে লুকিয়ে পড়ে খুব অস্থির হয়ে একটা নাম্বারে ফোন লাগায় তিতির।
কিছুক্ষণের মধ্যে ভেতরের হইচই ঝিমিয়ে আসে। কেউ যেন চেঁচিয়ে বলে পুরো হাসপাতাল পুলিশে ঘিরে ফেলেছে। তিতির একটু আশা নিয়ে উঁকি মারে।
শেষের কথা
এক পুলিশ অফিসার অন্য আরেকজনের সাথে কথা বলছিল। বড়কর্তা নাকি ভীষণ আর্জেন্ট আর ইম্পরট্যান্ট বলেছেন এই অ্যাকশনটাকে। ওনার ব্যাচের এক আই পি এস বন্ধু ফোন করেছিলেন হায়দ্রাবাদ থেকে। ডাঃ জনার্দন গৌড় নামের এক ডাক্তারকে সেফলি বার করে আনতে হবে।
আর তিতির নামের একজনকেও। ওনার উড বি বৌমা। গায়ে যাতে একটাও না আঁচড় পড়ে।
Beautiful ending.