মর্নিং ওয়াকে ফাঁকি দিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসেছিলাম। এমন সময় এক ছোকরা এসে আমার পাশে ওই বেঞ্চিতেই বসল। মুখটা ভারি চেনা চেনা।
এই এক দোষ আমার। মুখ কিছুতেই মনে রাখতে পারি না। ছোকরা কিন্তু বেশ অন্তরঙ্গ ভাবেই বলল, – এই এ’দিক পানে এয়েছিলাম এট্টুস। তোকে দেকলাম। উঃ কতদিনের পর বল তো।
কিছুটা চটেই গেলাম। এই মহা পাকা ছেলেটা, কথা নেই বার্তা নেই, পাকাচুল আমার সঙ্গে তুই তোকারি করছে কেন?
ভুরু কুঁচকে তাকাতেই, ছেলেটা বলল, – আরে, আমি বিরু রে। বিরিঞ্চি খাসনবিশ। রোল নাম্বার একত্রিশ।
– অসম্ভব, হতেই পারে না। মানে এরকম কম বয়সের চেহারা…
– কারও কারও বয়স বাড়ে না রে সলিল। আঃ এমন কচ্চিস যেন ভূত দেখচিস। এই দেখ হাতে উল্কি করা বিরিঞ্চি খাসনবিশ। তুইও তো করিয়েছিলি।
উল্কির কথাটা ঠিক বলেছে। কিন্তু ও যে বিরিঞ্চিই মানতে চাইছে না মন।
ও আবার বলল, – তবে ধরে নে না, আমি ভূতই। ভুলে গেলি, সেই যে… বলে বিরিঞ্চি আমায় খানকতক পুরোনো দিনের গোপন পাপের কথা বলল। ভারি লজ্জার ইতিহাস সে সব।
অকাট্য প্রমাণে মানতেই হচ্ছে এই ছোকরা বিরিঞ্চি মানে বিরুই।
তবু গোঁ ধরে বললাম – আমি বিশ্বাস করি না।
– তুই বলতে চাচ্ছিস, তুই আমাকে বিশ্বাস করচিস না।
– মোটেই তা বলিনি। বলেছি আমি ভূত বিশ্বাস করি না।
– ওই একই হল। আমি তোকে ভূত যে আচে সেই কথাটা বলছিলাম।
– তুই বললেই আমি মেনে নেব?
– তুই বিজ্ঞান তো মানিস, না কি?
– আজ্ঞে হ্যাঁ, তা মানি। সায়েন্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি, ভুলে গেলি? অ্যাডিশনাল বায়োলজি।
– ব্যাস ব্যাস, তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেল। তুই তবে ভূতও মানিস।
– মানে, গায়ের জোরে মানাবি?
– আরে না না, গায়ের জোরের প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? এই তো আমায় দেখছিস। এই চেহারায় তোর সঙ্গে গায়ের জোরে পারব? বলছিলাম কি ফিজিক্স তো পড়েছি। ওইখানেই তো ভূতের প্রমাণ আছে!
– ফিজিক্সের বইয়ে ভূতের প্রমাণ? হাসালি বিরু!
– ওরে রমাবাবু স্যার এই জন্যেই বলতেন, ওপর ওপর পড়বি না কোনও কিছু। ইন বিটুইন দি লাইনস পড়বি। পড়িস নি সেটাই। তাই আমাকে মানতে এত কষ্ট তোর।
– ফিজিক্সে লেটার পেয়েছিলাম। তা ছাড়া বিএসসিতেও ফিজিক্স অনার্স ভুলে যাস না।
– আরে ওই সব আজকালকার ছেঁদো ডিগ্রির চোতা সব ভুয়ো, আমি জানি। এই তোকে দেখেই তো বুঝতে পারছি তা। তুইই সাক্ষাৎ প্রমাণ। মূর্তিমান পল্লবগ্রাহিতা।
– তুই কিন্তু ঘুরিয়ে অপমান করছিস আমায়। এর পর আর সম্মান বজায় রাখতে পারব না!
– সম্মান তো এর মধ্যেই যথেষ্ট লেবড়ে ফেলেচিস। আহাহা, আমার সম্মান না, ফিজিক্স বেচারার! লীন তাপের পুরো কনসেপ্টটা ভুলে মেরে দিয়েচিস?
– ভুলে গেছি? শোন তবে। লীন তাপ কাকে বলে?
পদার্থের তাপমাত্রা বা উষ্ণতার কোন পরিবর্তন না ঘটিয়েও কেবল অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পদার্থ কর্তৃক যে পরিমাণ তাপ গৃহীত বা বর্জিত হয় তাকেই ঐ পদার্থের লীন তাপ বলে।
– ওঃ, এই মুখস্তটুকু তো পরীক্ষার খাতায় ওগরাবার জন্য। কিন্তু ইন বিটুইন দি লাইনস না পড়লে হবে?
– এর আবার ইন বিটুইন দি লাইনস কি? বরফ জল আর বাষ্পের গল্প তো!
– একই কাণ্ড যে অন্য পরিবর্তনের বেলাও খাটে সেটা ভেবে দেখলি না? বাংলাটাও দেখছি বেজায় ফাঁকি দিয়েচিস!
– বেশ তো ফিজিক্স হচ্ছিল। এর মধ্যে আবার বাংলা এল কোত্থেকে?
– আনলি বলেই এলো! লীন তাপের সংজ্ঞাটি তো বললি। যদি জিজ্ঞেস করি, এই পংক্তি কয়টিতে কবি কী বলিতে চাহিয়াছেন? কী উত্তর দিবি শুনি?
– মানে?
– মানে হচ্ছে ওই ইন বিটুইন দি লাইনস। সব বিষয়ের সব বিবৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ওই প্রশ্নটি। কবি কী বলিতে চাহিয়াছেন?
– বিরু, সব সাবজেক্টেই?
– না তো কী? এই ভূগোল ব্যাপারটাই ধর না কেন। ভূগোল হচ্ছে বিজ্ঞানের সেই শাখা যেখানে পৃথিবীর ভূমি, এর গঠন বিন্যাস, এর অধিবাসী সম্পর্কিত সমস্ত প্রপঞ্চ সংক্রান্ত বিষয়াদি আলোচিত হয়। এর মানে কি খালি গ্লোব আর ম্যাপ? কবি কী বলিতে চাহিয়াছেন? ভূগোল জানতে গেলে ইতিহাস জানতে হবে। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি অঙ্ক, এমনকি মহাকাব্য, সব জানতে হবে? হ্যাঁ, মহাকাব্যও। নইলে লাস্টে পৃথিবী দ্বিধা হও, বললে বুঝবি?
– লীন তাপের ব্যাপারটা কী বলছিলি?
– হ্যাঁ, কাম টু দি পয়েন্ট। অবস্থার পরিবর্তন। ইজি খুব ইজি। বরফ কে লীন তাপ দিলে জল। আবার জলকে লীন তাপ দিলে বাষ্প।
– হ্যাঁ, তা তো বটেই। কিন্তু ভূত?
– সেই রকমই, যারা বেঁচে আছে বলে ভাবচিস… দেকতে পাচ্চিস, তাদের লীন ইয়ে দিলে ভূত। আবার ভূত কে লীন ইয়ে দিলে আত্মা।
– ওই ইয়েটা কী বস্তু?
– সেই ইয়েটা? হে হে, মুখে বলে বোঝানো যাবে না। এই যেমন ধর এখন আমারই যেমন। তোর সাথে কথা বলতে বলতে টের পাচ্ছি, ভেতরে সেই ইয়েটি জমছে ক্রমশ। আর একটু পরেই দেখবি আমি ভূত হয়ে যাব। আমাকে বিশ্বাস করবি তো তখন? আচ্ছা, চলি তবে… দেখা হবে পরে কোনওদিন।
এই না বলে পার্কের বেঞ্চিতে আমার সামনে বসা বিরিঞ্চি ছোকরা কেমন যেন প্রথমে ধোঁয়ার মত হয়ে তারপরে উবে গেল।
তক্ষুনি আমার মনে পড়ল, বিরিঞ্চি সেই কবেই বিএসসি পড়তে পড়তেই মরে গেসল। বাসের ধাক্কায়। পঞ্চাশ বছর আগে। ভারি ভুলো মন হয়েছে আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে।
আবার দেখা হবে বলে গেল। কে জানে ইয়ে জমে জমে তার মধ্যেই বিরিঞ্চি, ওই কী বলে, যদি আত্মা হয়ে যায়? তবে কী আর…
বলেই দুশ্চিন্তা হল ভারি। নিজেকে চিমটি কেটে দেখলাম, আমার মধ্যেও অল্প করে, ওই ‘ইয়ে’ জমছে নাকি?