২০০২ সাল। ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল। লর্ডসের বারান্দায় টেনশন ভরা মুখ নিয়ে বসে আছে ভারতের বাঙালী ক্যাপ্টেন। ক্রিজে জাহির আর মহম্মদ কাইফ। জাহিরের ব্যাটে বল লেগে চলে গেলো কভারের দিকে। দুই ভারতীয় এক রান নেবার সময় ওভার থ্রো। জয়ের রানটা নেবার সাথে সাথে সৌরভ শার্ট খুলে শূন্যে ঘোরাতে থাকে। সমস্ত বাঙালির নস্টালজিয়ায় ছবিটা ফ্রিজড হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ার অনুপ্রেরণা হয়ে থেকে যায় সেদিনের সেই মুহূর্তটা।
২০০৭এ সদ্য কৃষ্ণনগরে এসেছি। কিন্তু মনের ভেতর সবসময় “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।” জেলা হাসপাতালের সার্জন। প্রচুর অপারেশন করছি। কিন্তু বাইরে প্র্যাকটিস সেভাবে জমেনি। নার্সিংহোমগুলো কম বাজেটের অপারেশনগুলোয় ডেকে পাঠায়। আর ডাক দেয় কঠিন অপারেশনগুলোয়, যেগুলো অন্য সবাই করতে চাইছে না। হাসপাতালের কলিগদের বাইরে যাঁরা শুধু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন তাঁদের সাথেও আলাপ হচ্ছে ধীরে ধীরে।
দাসদা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, চেম্বারে বাচ্চাদের ক্যাঁচরম্যাচর লেগেই থাকে। একজন ডাক্তার স্বপন দাসের বাড়ি চেনাতে গিয়ে বলেছিল “পি এল চ্যাটার্জি লেনে যেখান থেকে সবসময় বাচ্চাদের চেঁচামেচি ভেসে আসে সেটাই ডাঃ দাসের বাড়ি। ওই বাড়িটায় কোনোদিন শব্দ বন্ধ হয়না।”
তো দাসদার চেম্বারে একদিন পেটে ব্যথা নিয়ে চারবছরের এক বাচ্চা এলো। ওনার সন্দেহ সার্জিক্যাল অ্যাবডোমেন, অপারেশন করতে হবে। উনি পাঠালেন ‘বেদ’ নামের একটি আল্ট্রাসাউন্ড সেন্টারে। বেদ খুব ভালো সেন্টার। সেখান থেকে লিখে দিলো যে বাচ্চাটার ইন্টাসাসেপশন হয়েছে, অর্থাৎ একটা নাড়ির ভেতর আরেকটা নাড়ি ঢুকে গেছে। এবং ওই অংশটুকু পচে গেছে।
নার্সিংহোম থেকে বিকেলবেলায় ফোনটা এলো। যখন আমি বাচ্চাটাকে দেখলাম তখন সে মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভীষণ টক্সিক লুক। বুঝতে পারছিলাম বাচ্চাটা অপারেশনের ধকল নিতে পারবেনা। কলকাতায় রেফার লিখে বেরিয়ে আসছিলাম। বাচ্চার বাবা আক্ষরিক অর্থে পা চেপে ধরে বলে যে আলট্রাসোনোগ্রাফি সেন্টার থেকে বলেছে বাচ্চাটাকে কলকাতা নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে মাঝপথেই মারা যাবে।
খুব অসহায় লাগছিল। আমার অ্যানাস্থেসিয়ার ডাক্তারবাবু অজিত রায়কে ফোন করলাম। অজিতদাও আমার সাথে একমত। এই বাচ্চাকে অজ্ঞান করলে আর জ্ঞান ফিরবে না। এবার রোগীর বাবা-মা অজিতদাকে চেপে ধরে। নরম হয়ে অজিতদা আমাকে এক চিলতে ডক্টরস’ রুমে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে যে কতক্ষণ লাগবে অপারেশন করতে।
“রিসেকশন অ্যানাস্টোমিস করতে অন্তত দেড়ঘন্টা” – একটু কমিয়ে বলার চেষ্টা করি অজিতদাকে।
“আমি আধঘন্টা একে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারবো।” অজিতদার সোজাসাপ্টা জবাব।
তাই সই। ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের জটিলতা বেড়ে যাওয়ায় এখন হলে সেই ঝুঁকি নিতে ভাবতাম। বাঁচার সম্ভাবনা যে ছিলই না। যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে কি রোগীর বাড়ির লোক আমায় ছেড়ে দেবে?
যাহোক,খুব তাড়াতাড়ি ওটি তৈরি করে বাচ্চাটাকে টেবিলে তোলা হলো। বাচ্চার মুখে ইনটিউবেট করে অজিতদা বললেন – “স্টার্ট।”
মনে মনে ‘বেদ’ থেকে করা ছবিটা ঝালিয়ে নিই। প্রায় এক স্ট্রোকে পেটের মধ্যে ঢুকি। পৃথিবীতে সেই মূহুর্তে মনে মনে এঁকে নেওয়া বাচ্চার পেটের ভেতরের ছবিটা ছাড়া আমার কাছে আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব ছিলনা। শেষ সেলাইটা যখন দিচ্ছি তখন অজিতদার গলার আওয়াজে চমকে উঠি -” ঠিক তেত্রিশ মিনিট।”
তারপর থেকে রাউন্ডে গেলে বাচ্চাটা আমাকে দেখলেই চেঁচিয়ে কাঁদতো। একটু একটু করে সুস্থ হয়ে ওঠার পর দশদিনের মাথায় ঠিক করলাম ছুটি দেবো। দোতলা নার্সিংহোমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছিলাম। নার্সিংহোমের ম্যানেজার ছুটে এসে বলে যে পেশেন্ট পার্টি টাকা দিতে চাইছে না। ওষুধের দাম বাবদ কিছু টাকা ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড ঝগড়া চলছে। আমি বললাম “আমার আর অজিতদারটা ছেড়ে দাও।”
আরও কিছুক্ষণ বচসার পরে বাচ্চার বাবাকে দেখলাম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। নামার সময় আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। বাচ্চাটা বাবার কাঁধের ওপর দিয়ে আমাকে দেখছিল। হঠাৎ মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে আমাকে হাত নেড়ে টা টা করে।
বিশ্বাস করুন – ডাক্তাররাও মাঝে মাঝে সৌরভ গাঙ্গুলি হয়ে যায়। আমি সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে মনে আমার শার্টটা খুলে হাওয়ায় ঘুরোতে থাকি। শেষ পর্যন্ত যে ট্রফিটা আমার, আমাদের – সমস্ত ডাক্তার সমাজের।
এর উল্টোদিকের গল্পও আছে। সেটা পরে বলবো।
Sir apni bhagwaner ar eak rup . Ami apnake sab samay pujar bhagwaner jaygay bosiye rakhi . Sujay Kumar Biswas (army)
হা । ভগবান ,আল্লা, God এনারা যে মানুষের মধ্যেই বিরাজমান তার একটি উদাহরণ হলেন Sir ।
অনেক ধন্যবাদ সুজয়।❤?
খুব ভালো ঘটনা,যা গল্পের মাধ্যমে পড়লাম, আমার মতো যারা আপনাকে চেনে তারা আপনাকে ভগবানের চোখেই দেখে, তারা জানে রুগি কে সুস্থ করে তোলার মধ্যেই আপনি আনন্দ খুঁজে পান, আবার অপেক্ষায় থাকলাম উল্টো দিকের ঘটনাটা শোনার জন্য ।
একদম ঠিক কথা বলেছেন আপনি।
ধন্যবাদ স্বাতী। ??
Sir, আপনার মধ্যে একটা “Magical power” আছে , যা কখনো রোগী কে নতুন জীবন দেয়, কখনো আবার আপনার লেখনী আমদের মতো সাধারণ মানুষের ভারাক্রান্ত মনে আনন্দের সঞ্চার ঘটায় ।?
তোমাদের রিয়্যাকশনগুলো পাই বলে লিখতে ভালো লাগে। ??
আর আমাদের এই Reaction গুলো হৃদয়ের কেন্দ্রবিন্দু থেকে আসে Sir
আমরা আরও গল্প পড়তে চাই?
এ জীবনে কর্মসূত্রে অনেক ডাক্তার/মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। তাদের মধ্যে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ আছেন, যাদের জন্য এক অদ্ভুত ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে যায়। ডাঃ অনির্বাণ জানা সেই মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভালো থাকবেন স্যার। ?
ভালো থাকবেন। ?❤