এক সময় একট গান মাইকে হেব্বি বাজতো, চেহারা কেয়া দেখতে হো, দিল মে উতর কর দেখো না। কুমার শানু, আশা ভোঁসলে। কিন্তু ভালো কথা কানে যায় না। তাই প্যান্ডেলে চেহারাই দেখা হতো। কিন্তু সেই চেহারা একটা নির্দিষ্ট টাইপের হতে হবে, নাহলেই বাতিল। সমাজ শিখিয়ে দিয়েছে, কোন চেহারা সিটি খাবে, কোনটা আওয়াজ। সে ছেলেই হোক বা মেয়ে।এবার আসল গল্পে আসি।
মেরি অ্যান। অনেকের কাছেই ছিলেন দুনিয়ার ‘কুৎসিততম’ মহিলা। নিষ্ঠুরতা, কটুক্তির শিকার হয়েও এই ‘ রূপকে’ হাতিয়ার করেই চার সন্তানকে প্রতিপালন করেছেন তিনি। জন্মগতভাবে মেরি অ্যান এরকম দেখতে ছিলেন না। অসুখে তাঁর ওই অবস্থা হয়েছিল। তাঁর ঘটনা আজকের দিনেও বহু মহিলাকে অনুপ্রাণিত করতে বাধ্য।
ইংল্যান্ডের নরহ্যামে ১৮৭৪ সালে জন্মেছিলেন মেরি অ্যান। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। পাড়া- প্রতিবেশীরা তার রূপের প্রশংসা করত। যদিও সেসবে খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না তিনি। আট ভাইবোনের সংসারে কীভাবে আর্থিক সুরাহা হবে সেই চিন্তা তাঁর মাথায়। তাই কম বয়সেই রোজগার শুরু করতে হয় তাঁকে। নার্সের চাকরি নেন তিনি। ১৯০৩ সালে বিয়ে হয় টমাস বিভাব নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁদের চারটি সন্তানও হয়। যদিও বিয়ের পর থেকেই নানারকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে থাকে তাঁর। কখনও গাঁটে, পেশীতে ব্যথা তো কখনও মাইগ্রেন। যদিও নিজের কাজ, সন্তান সামলাতে গিয়ে নিজের শরীর নিয়ে ভাববার মতো সময় তাঁর ছিল না। ওই সব শারীরিক সমস্যা সামলে নিলেও যখন নতুন করে আরেক সমস্যা শুরু হয় তখন ডাক্তারের কাছে যেতেই হয়। সমস্যা ছিল মুখের হাড় অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকা। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান, মেরি অ্যানের অসুখের নাম ‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’। এই অসুখে শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় হরমোন নিঃসৃত হয়। এই কারণেই হাড়, পেশি এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে পেশিতে তীব্র যন্ত্রণা এবং মাথাব্যথাও হয়। এখন এই অসুখের চিকিৎসা থাকলেও অতদিন আগে ছিল না।
এরপর তাঁর জীবনে আসে আরেক বিপদ। বিয়ের পর মাত্র এগারো বছরের মাথায় মেরি অ্যানের স্বামী মারা যান। কীভাবে সংসার চালাবেন বুঝে উঠতে পারেন না। আচমকাই নজরে পড়ে খবরের কাগজে দেওয়া বিজ্ঞাপন- পৃথিবীর ‘কুৎসিততম’ মহিলা খোঁজার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। জিতলে নগদ অর্থ পাওয়া যাবে।বিন্দুমাত্র দেরি না করে সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। জিতেও যান। তাঁর এই খেতাব জয়ের পর আমেরিকার এক সার্কাস দল তাঁকে আমন্ত্রণ জানান সেখানে কাজ করার জন্য। সার্কাসের জোকারদের মতো তারও কাজ ছিল সবাইকে হাসানো। তিনিও রাজি হয়ে যান। সবাইকে হাসালেও মেরি অ্যান নিজে যে কী মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন তাঁর খোঁজ পাননি কেউ। তাঁর চেহারাকে বিদ্রূপ করার জন্য কিছু চিকিৎসক প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, বলেছিলেন একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে নিয়ে এভাবে মজা করা অন্যায়। তা সত্ত্বেও মেরি অ্যানের শো চলেছিল তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
এবার আর চেহারা নয়, মানুষটাকে দেখি। কালো, বেঁটে, রোগা, মোটা, টেকো, ল্যাংড়া, কানাই, নিমাই, মোষ, ভাল্লুক বলার আগে, মানুষটাকে চিনি। হয়তো আমার নিজেরও এমন কোনো নাম আছে যা আমি জানি না।