এক সপ্তাহের মধ্যে মেদিনীপুর এর ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ বেরা, ম্যাঙ্গালোরের ডাঃ সাক্ষিক শেট্টি, আহমেদাবাদ এর ডাঃ বিধি আর দিল্লির ডাঃ বিকাশ সোলাঙ্কি – ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সের এই তরতাজা চিকিৎসকদের করোনা সংক্রমণ থেকে মৃত্যু যেন শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত ঢেলে দিল । ইতিমধ্যেই সাড়ে তিনশোরও বেশী চিকিৎসক মারা গেছেন করোনায়, মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছেন নিশ্চিতভাবেই আরো কয়েকশো। এঁরা অনেকেই পঞ্চাশোর্ধ, কেউ ষাটের বেশি, অনেকেরই তথাকথিত ‘কো-মর্বিডিটি’ ছিল এক বা একাধিক।
কিন্তু উপরে নাম বলা এই চারজনই ছিলেন পঁয়ত্রিশ এর নীচে – সুস্থ, সতেজ, উদ্যমী। জীবনের গাড়ির চলা সবে আরম্ভ হয়েছিল। ওঁরা চারজনেই চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। না – হেলমেটহীন অবস্থায় উদ্দাম বাইক চালিয়ে মাথা থেঁৎলে নয়, সিগারেট ফুঁকে লাং ক্যানসারে নয়, মদ গিলে লিভার সিরোসিসে নয়, জন্মগত কোনো দুরারোগ্য রোগে নয়। স্রেফ ‘পাতি ঠাণ্ডা লাগা জ্বর’ করোনায়। আরেকজন কোনো করোনা আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা করতে গিয়ে – খুব সম্ভবত নিজেদের অজান্তেই। বয়স, কো-মর্বিডিটি, ৯৮% সুস্থতার হার – কোনো থিয়োরি ই কাজ করল না।
সত্যি বলছি – ক্লান্ত, অবসন্ন, আতঙ্কিত লাগছে। এর পরে কে? আরও কতজন? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন – আরও কত মাস বা বছর? কোথায় ভ্যাকসিন? কোথায় Herd Immunity?
কারণ আদালত তাই বলুন, সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনারা যা খুশি গালি দিন – আমরা পেশাদার সৈনিক বা মগজ ধোলাই হওয়া আত্মঘাতী জঙ্গি কোনোটাই নই। মৃত্যু জীবনের অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু এই মৃত্যুগুলি – একজন রুগীর চিকিৎসা করতে করতে তাঁর কাছ থেকে রোগটি নিজের দেহে নিয়ে জীবনের শুরুতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া – এ বড় দুঃসহ, যন্ত্রণাময়। ‘শহীদ’, Warrior – কোন তকমাতেই এ জ্বালা জুড়োয় না।
কি করব? আত্মার শান্তি কামনা? ‘শহীদ’কে বিদায় অভিবাদন? পরিবারকে সমবেদনা? দুঃখিত, এসব লিখতে পারছি না। যদি ওঁদের আত্মা সত্যিই কোথাও থেকে থাকে – আমি নিশ্চিত এ শান্তি, শহীদের তকমা ওঁরা চাননি। নিজেদের কাজটা করে পরিবার নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন, ভাল ডাক্তার হবার স্বপ্নকে সাকার করতে চেয়েছিলেন।
অ-ডাক্তার পাঠকরা ভাবতে পারেন – তরুণ চিকিৎসকরা মারা যাচ্ছেন বলেই আমি এত বিচলিত। হবে হয়ত। সহযোদ্ধার মৃত্যুতে টলে যাবনা – আমরা ত সত্যিই অসুর নই, যেমন ভগবান ও নই, হতে চাইও না। মানুষের মতই অবসাদ আসে, অসহায়তা গ্রাস করে – এর পরে কে? কারণ, সংখ্যাতত্ত্ব বলছে সাধারণ মানুষের তুলনায় করোনায় ডাক্তারদের মৃত্যুহার আমাদের দেশে পনেরো গুণ বেশী – যা অন্য দেশের তুলনাতেও বেশি। সম্ভাব্য কারণ উঠে আসছে অনেক – কিন্তু নির্দিষ্ট কিছুই জানা যাচ্ছে না।
আপনারা সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন। মানুষ-মারা ডাক্তারদের কথা ভাবতে হবে না। দেশের কথাও নয়। শুধু নিজেকে আর পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন। আবারও বলছি – দাগের ওপারের দুই শতাংশের মধ্যে কে ধরা পড়বে, তা কিন্তু কোনো বিশেষজ্ঞই মেলাতে পারছেন না।
মাস্ক পড়ুন, মাস্ক পড়ুন, মাস্ক পড়ুন।
দারুন হেডিং। আপনারাও তো মানুষ, এই টুকু বুঝতে আমাদের যে আরও কত মৃত্যু লাগবে। ভালো থাকবেন।
খুব ই প্রয়োজনীয় ও মর্মস্পর্শী লেখা। সত্য কে নিয়ে এই সাবলীল কষাঘাত , এক কথায় ……অপূর্ব। ।