দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ১৫
রাজ্যের সামগ্রিক চিকিৎসকদের বিভিন্ন সমস্যাবলী নিয়ে চিরকালই IMA, Bengal State branch-এর একটা সদর্থক ভূমিকা ছিল যদিও দীর্ঘসূত্রিতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতা এবং দাবি আদায়ে অনমনীয় মনোভাবের অভাবের কারণে চিকিৎসকদের একটা অংশ সবসময়েই বিরক্ত থাকতো। এ সব সত্ত্বেও IMA-কেই চিকিৎসকদের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে মেনে নিতে রাজ্যের চিকিৎসকরা অভ্যস্ত ছিল। দলীয় রাজনীতি অবশ্যই ছিল; কিন্তু তাতে সমস্ত দলের বা দলের বাইরের চিকিৎসকদের একসঙ্গে কাজ করতে বা আলোচনা-বিতর্কে অংশ নিতে খুব একটা অসুবিধা হতো না। সমস্যা হলো ২০১১-এর পর থেকে, যখন সম্পূর্ণ রাজনীতিকরণের ফলস্বরূপ শাসকদলের বাইরে আর সকলের জন্য IMA-এর দ্বার প্রায় রুদ্ধ হয়ে যায়। অবস্থা চরমে ওঠে যখন বহু বিতর্কিত clause সহ সম্পূর্ণ একতরফাভাবে সরকার West Bengal Clinical Establishment বিল আনয়ন করে আর দ্রুত আইনেও রূপান্তরিত করে (WBCEA’17), আর IMA State Committee তৎক্ষণাত তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে দেয় সম্ভবতঃ পুরোটা না পড়েই।
এতটা মেনে নেওয়া ডাক্তারদের পক্ষে কখনই সম্ভবপর ছিল না আর প্রতিক্রিয়া হয় প্রায় বিস্ফোরক। ইদানীং কালে শুধু নয় স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে ক্ষোভে ফেটে পড়া এত স্বতঃস্ফূর্ত চিকিৎসক আন্দোলন এই রাজ্য দেখেছে কিনা সন্দেহ তাও IMA কে সম্পূর্ণরূপে bypass করে !! চিকিৎসক আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়। IMA রাজ্য শাখা ছাড়া পুরোনো নতুন সমস্ত চিকিৎসক সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে তৈরি করে এক সংগ্রামী মঞ্চ। প্রায় দেড় থেকে দু বছর ধরে সভা-মিছিল-বিক্ষোভে আন্দোলিত হয় রাজ্যের প্রায় আপামর চিকিৎসক সমাজ। জীবনে কোনও দিন যারা মিছিলে যাবার কথা ভাবেও নি, তারাও অতি উৎসাহের সঙ্গে পা মেলায় প্রাচীন-অর্বাচীন সমস্ত মিছিলকারীদের সাথে। দাবী আদায় কতটা হয়েছিলো সেটার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এক অভূতপূর্ব আত্মপ্রত্যয়ের বোধ..কারুর সাহায্য বা দয়া দাক্ষিণ্য ছাড়াই পেশাগত আন্দোলন সংগঠিতভাবে করা সম্ভব!!!
পরবর্তীকালে নানা ঘাত প্রতিঘাতে আন্দোলনের সার্বিক ঐক্য ব্যাহত হয়, কিছু সংগঠন আলাদা হয়ে যায়। আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠা চরিত্র রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে চলে যায়, IMA-এর রাজ্য শাখাও নিজের অতি বেহাল অবস্থাকে মেরামতিতে প্রয়াসী হয়।
ফলতঃ, আন্দোলনের সেই স্বতঃস্ফুর্ততা, ব্যাপকতা ও অসাধারণ উন্মাদনা অনেক অংশেই আজ স্তিমিত। কিন্তু, পরিস্থিতির যে খুব বেশী তফাৎ ঘটেছে তা কিন্তু নয়। কোভিডের কারণে সবচেয়ে বিপর্যস্তদের তালিকায় সামনের সারিতে আছে চিকিৎসকরা, একের পর এক চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, জুনিয়র ডাক্তারদের উপর নেমে আসছে অদ্ভুত খামখেয়ালি সব সিদ্ধান্ত যেগুলির বেশীরভাগই সার্বিকভাবে তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। বস্তুতঃ, IMA রাজ্য শাখা আগের ভূমিকার. সামান্য পরিবর্তন করলেও, চিকিৎসকদের পাশে এসে দাঁড়ানো থেকে অনেক মাইল দূরত্বে…..!!
এই পরিস্থিতিতে, গত এক বছরের কিছু বেশী সময় ধরে, পাঁচটি সংগঠন (WBDF,, AHSD, HSA, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও Doctors for Democracy) ‘Joint Platform of Doctors’ তৈরি করে আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করছে দাবী দাওয়াগুলি নিয়ে সোচ্চার হতে, যদিও সেই সভা সমিতি মিছিলে ব্যাপকভাবে জমায়েত করা বা আন্দোলনকে সার্বিক রূপ দেওয়ার ক্ষমতা তার অনুপস্থিত। সেই সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই, Joint Platform কে প্রয়াস চালাতে হচ্ছে যত বেশী সংখ্যক এবং যত বেশী স্তরের চিকিৎসককে আন্দোলনের সামগ্রিক রূপরেখার মধ্যে নিয়ে আসতে। বস্তুতঃ, এ ছাড়া কোনও রাস্তা বা বিকল্প নেই। পেশাগত ভাবে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা তো আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে, পরিস্থিতি অনুকুল/প্রতিকুল যাই হোক না কেন।
মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা দুক্ষেত্রেই আগামী দিনে আরও অনেকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শুধু প্রবল নয়, বোধকরি ক্রমবর্দ্ধমান। নিত্যনতুন নিয়ম পদ্ধতি আসছে শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকারগুলিকে ক্রমাগত খর্ব করতে আর সৎ পরিশ্রমী চিকিৎসকদের জীবন আরও দুর্বিষহ করতে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় তো আমাদেরই বার করতে হবে। নতুন যারা পাশ করছে তাদেরকেই অনেক সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে ঐক্যবদ্ধ চেতনা ও কর্মক্ষেত্রে। রাজনৈতিক মতবাদ যার যা খুশী থাকুক পেশাগত আন্দোলনের জায়গায় তাকে কখনই প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। আগামী দিনে, এই নতুন প্রজন্মের উপরেই কিন্তু নির্ভর করছে চিকিৎসক আন্দোলনের দিকনির্দেশ ও তার সম্ভাব্য সফলতা।
পরিশেষে বলি, চিকিৎসক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ সংগঠিত করতে IMA-কে সামিল করার চেষ্টা কিন্তু লাগাতার ভাবে চালিয়ে যেতে হবে। রাজ্যের ক্ষেত্রে যতই বিরূপ মনোভাব থাকুক, এ কথা ভুললে চলবে না সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সমস্ত চিকিৎসককে প্রতিনিধিত্ব করে এক ও অদ্বিতীয় Indian Medical Association..। তাকে কোনও ভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না। তবে, সর্বভারতীয় মঞ্চ ব্যবহার করতে গেলেও প্রয়োজন যথাযথ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা।