কথা শুরু
প্রতিদিনই কেউ না কেউ নিজের স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শর জন্য আমাদের দ্বিজেন চক্রবর্তী স্মৃতি সেবা সদনে আসেন। কেউ নিজের প্রেসার চেক করাতে কেউ আবার প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ওষুধ গুলো ঠিক আছে কিনা বুঝতে। কেউ আবার প্রাইভেটে চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পেরে আমাদের কাছে এসে বলছেন বারাসাত সিটিজেনস ফোরামে চিকিৎসা করালে কত খরচ?
২০১৩ সাল থেকে আমরা সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবিতে সোচ্চার হলেও স্বাস্থ্য এখনো যে ভিক্ষার ঝুলিই হয়ে আছে তা আমাদের এলাকার বিশেষ করে আমার নিজস্ব এলাকায় মানুষেরদের নিয়ে স্বাস্থ্য সমীক্ষায় তার চিত্র পরিষ্কার। গরীব মানুষগুলোর একমাত্র ভরসা সরকারি হাসপাতাল, তাও বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে সেটাও বন্ধ। কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে লোকাল প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেলেও সেখান থেকেও সুগারের ওষুধ মেটফরমিন যেগুলো বেশ কয়েকদিন আগে এক পেসেন্টকে দেওয়া হয়েছিলো সেগুলো খাওয়ার পর সেই ট্যাবলেট নাকি গোটাটাই পায়খানার সাথে বেরিয়ে গেছে। সেই ওষুধ আমরা নিজেরা দীর্ঘক্ষণ জলে ভিজিয়েও গলাতে পারিনি শক্ত পাথরের মতো হয়ে ছিলো। সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
ফেলো কড়ি মাখো তেল
এমতাবস্থায় অগত্যা গ্রামের মানুষকে ছুটতে হয় প্রাইভেট চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসকের ভিজিট এবং ওষুধের খরচ বহন করতে না পারা মানুষগুলো শেষমেশ বিনা চিকিৎসায় বাকি জীবনটুকু ভাগ্যের দোহাই দিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। কেউ আবার অনেক কষ্টে কিছু টাকা পয়সা যোগার করে প্রাইভেট চিকিৎসকের কাছে যান। কিন্তু এখানেও যে সাধারণ মানুষ কি ভাবে প্রতারিত হচ্ছেন আসুন তারই একটি বাস্তব চিত্র আজ আপনাদের তুলে ধরে ধরি।
মিশ্রিত ওষুধঃ কার লাভ কার ক্ষতি
ছেলেটি আমাদের পাড়ার। অভাবের সংসার দুই সন্তান ও স্ত্রী সহ মাকে নিয়ে থাকেন। নিজের এলাকারই মিউজিকের একটি ছোট্ট কারখানায় কাজ করেন। বর্তমান লকডাউনে সেটা বন্ধ। মাঝে মধ্যে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাছের ব্যাবসা করলেও শারীরিক কারণে সেটাও বন্ধ। বহুদিন ধরে ছেলেটির এলার্জির সমস্যা সাথে উচ্চ রক্তচাপ এবং সুগার। এলার্জির জন্য আয়ুর্বেদ ওষুধ খান।
আয়ুর্বেদ কেনো?
অনেকদিন এই ওষুধ খাই তো তাই।
বললাম যে টাকা দিয়ে কিনে আয়ুর্বেদ ওষুধ খাচ্ছিস তার অনেক কম টাকায় এলার্জির ওষুধ কিনতে পাওয়া যায়।
আবারও উওর খেয়েছি কাজ হয়নি।
আয়ুর্বেদ ওষুধের নমুনা দেখে এবার বললাম – এর মধ্যে যে স্টেরয়েড মেশানো নেই তার কি গ্যারান্টি আছে।
এবার চুপ ছেলেটি।
বেশ কিছুদিন আগে প্রেসার মেপে দেখি প্রেসার অনেকটাই বেশি। আমাদের বারাসাত সিটিজেনস ফোরামে একবার দেখিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলেও শেষমেশ লোকাল চিকিৎসককে দেখান। রিপোর্টে উচ্চ রক্তচাপ তার পাশাপাশি ছেলেটির রক্তে ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর ওই প্রাইভেট চিকিৎসককে আবার দেখিয়ে আমার কাছে এসে জানতে চাইছেন ওষুধগুলো ঠিক আছে কিনা। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো -এই একপাতা করে ওষুধ কিনতেই এত টাকা চলে গেলো তবে সারা মাস ওষুধ কিনে খাবো কি করে।
যাইহোক ওষুধের পাতাগুলো ছেলেটির থেকে নিয়ে ওষুধের নামের উপর চোখ বোলাতেই চমকে উঠলাম একি ! এতো ২০১৫ সালে ভারত সরকার ডায়াবেটিসের এইসব মিশ্রিত ওষুধকে নিষিদ্ধ করেছে। যে চিকিৎসক এই ওষুধগুলো ডায়াবেটিসের রোগীকে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি কি জানেন না এগুলো অবৈজ্ঞানিক মিশ্রণ নাকি সব জেনেও…
আমি আর একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুনরায় ডা. পুণ্যব্রত গুণের লেখা কথা শিল্প থেকে প্রকাশিত ‘ওষুধবিষুধ কিছু দরকারি কথা’ বইটিতে পুনরায় চোখ বোলালাম। দেখলাম হ্যাঁ পরিষ্কার উল্লেখ আছে মেটফরমিন, পায়োগ্লিটাজোন এবং গ্লিমেপিরাইডের মিশ্রণ সাতটি। এগুলো নিষিদ্ধ তালিকায়।
নিষিদ্ধ ওষুধ বনাম কার্যকরী ওষুধ
সত্যি কথা বলতে ওষুধ বিষয়ে সাধারণ মানুষের জানার কথাও নয় কোনটা সঠিক ওষুধ আর কোনটা ভুল ওষুধ। বিশিষ্ট চিকিৎসকদের লেখা স্বাস্থ্য বিষয়ক বইপত্র পড়ে যতটুকু জেনেছি ডায়াবেটিস সাধারণত দু’ ধরনের যেমন টাইপ ১ এবং টাইপ ২। টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা করা হয় ইনসুলিন দিয়ে এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা করা হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে। মুখে খাওয়ার প্রধান ওষুধ দু’ধরনের হয় যেমন সালফোনিলইউরিয়া এবং বাইগুয়ানাইডস।
সালফোনিলইউরিয়াগুলির মধ্যে গ্লিমেপিরাইড এবং বাইগুয়ানাইডসগুলির মধ্যে মেটফরমিন ব্যবহৃত হয়। আমাদের সিটিজেন ফোরামে আসা ডায়াবেটিস রোগীদের কেস হিস্ট্রির সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের প্রেসক্রিপশন ঘেঁটে দেখেছি আমাদের চিকিৎসক বন্ধুরা এই দুটো ওষুধ দিয়েই রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। আরও ওষুধ আছে সাধারণত সেগুলো আমাদের ক্লিনিকে কমই ব্যবহার হয়, দৈনিক ৫০ জন রোগীর ক্ষেত্রে হয়তো তিন থেকে চার জনের। সাধারণ একেবারে কম ডায়াবেটিস রোগীদের শুধুমাত্র মেটফরমিন দিয়েই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে। যাই হোক আমি চিকিৎসক নই চিকিৎসকদের ভুল ধরাটা আমার কাজ নয় এবং অধিকারও নেই। এই ভুল ধরার জন্য উপর মহলে অনেক বিশিষ্ট চিকিৎসকরা আছেন তারাই বিচার করবেন এই অযৌক্তিক প্রেসক্রিপশন আদৌও যুক্তিসম্মত বিজ্ঞানভিত্তিক কিনা।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি আমাদের পরিচিত চিকিৎসক বন্ধুরা সুগারের রোগিদের রক্তে সুগারের মাত্রা বুঝেই শুরুতেই শুধুমাত্র পরিমাণ মতো ‘মেটফরমিন’ দু’বেলা দিয়েই পেসেন্টের রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছেন। সেখানে ডায়েট চার্ট, নিয়মিত ভাবে ৩০ মিনিট ঘাম ঝড়িয়ে হাঁটার পরামর্শও উল্লেখ থাকে। জানিনা এক্ষেত্রেও এত মিশ্রিত ওষুধ আদৌও প্রয়োজন ছিলো কিনা।
যাইহোক মাফ করবেন আমি চিকিৎসক নই। শুধু একজন সামান্য স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে যতটুকু আমার পরিচিত মানবিক চিকিৎসক বন্ধুদের কাছ শিখেছি এবং জেনেছি তার পরিপ্রেক্ষিতেই ছেলেটিকে যা বলেছিলাম সেই কথাগুলোই আপনাদের কাছে শেয়ার করছি।
প্রেসক্রিপশনে পরামর্শে উল্লেখ ছিলো
Tenepure – M ( 20/500 ) একটি করে ট্যাবলেট প্রতিদিন সকালে টিফিনের আগে।
Glimiprex MF ( 2/500 ) একটি করে ট্যাবলেট দিনে দুবার খাওয়ার আগে।
প্রথম ডায়াবেটিসের ওষুধটি Teneligliptin 20 mg এবং Metformin Hydrochloride 500 mg এর মিশ্রণ এবং দ্বিতীয় ওষুধটি Metformin Hydrochloride 500 mg এবং Glimepiride 2 mg এর মিশ্রণ।
প্রেসক্রিপশনে দুটি ওষুধই ওষুধ কোম্পানির দেওয়া নাম উল্লেখ আছে। একমাত্র ওই চিকিৎসক এবং ওষুধের দোকানদারই বুঝবেন আপনার পকেট থেকে কত খসলো এবং ওষুধ কোম্পানির ঘরে কত মুনাফা ঢুকলো।
শেষের কিছু কথা
মেটফরমিন খেতে হয় সব সময় খাবার পরে। কিন্তু প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ আছে খাবার আগে। আর গ্লিমেপিরাইড খেতে হয় খাবার ১৫ মিনিট আগে অথচ প্রেসক্রিপশনে সময় উল্লেখ নেই। এই রকম মিশ্রণ ওষুধে একাধিক ওষুধ থাকে যা বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার নীতি লঙ্ঘিত হয়।
এটা আমার কথা নয় যারা দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষদের যুক্তিসম্মত চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন সেই শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের চিকিৎসক বন্ধুদের কথা। অথচ দেখুন আলাদা ভাবে মেটফরমিন এবং গ্লিমেপিরাইডের দাম খুবই সামান্য। এবং এই ওষুধগুলো সরকারি হাসপাতাল থেকেই বিনামূল্যে দেওয়া সম্ভব। এমনকি ন্যায্য মুল্যের ওষুধের দোকান থেকে কিনলেও বাজারের দোকান থেকে অনেক কমে পাওয়া যায়।
এর আগেও একই ভাবে আমার পরিচিত এক পেসেন্টকে এই অবৈজ্ঞানিক মিশ্রিত ওষুধ দেওয়া হয়েছিলো বর্তমানে তিনি আমাদের বারাসাত সিটিজেনস ফোরামে নিয়মিত চিকিৎসাধীন। এর পর ছেলেটি কি করবে ভাবনাটা ওর উপরই ছেড়ে দিলাম।
৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। সবার জন্য স্বাস্থ্য এখনো অধরা। এমত পরিস্থিতিতে আমরা কি স্বাস্থ্য বিষয়টিকে ভিক্ষার পাত্র হিসেবেই দেখবো নাকি সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবিতে সোচ্চারে দাবি তুলবো ‘স্বাস্থ্য মোদের ভিক্ষা নয় স্বাস্থ্য মোদের অধিকার’ ভাবতে বলবো আপনাদেরও…