“বড্ড বেশী ফ্যাকাশে লাগছে – এই ঘোষালদা একটু কৌশিককে ডাকুন তো” বাইরে বর্ষার আকাশ ঘনঘোর। দূরে তালগাছের মাথায় মেঘ আটকে আছে। চারপাশে গাছগাছালি ভীড় করে রয়েছে। একটু দূরে ঋষিরাজের কোয়ার্টার। সাজানো গোছানো ঘরদুয়ার। এই বুনো জায়গায় ঋষি ওর বৌ মিতালি আর শিশু বাবাইকে নিয়ে থাকে। মাঠে জঙ্গলে দৌড়ে – বৃষ্টিতে ভিজে রোদ্দুরে পুড়ে বাবাই বড় হচ্ছে। আর পাশের কোয়ার্টারে থাকে কৌশিক। সদ্য ডাক্তার। ভাবুক – শিল্পী। দেশে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা আর বাবা থাকেন। ওদের গানে হাসিতে বাবাইয়ের চিৎকারে স্বাস্থ্য কেন্দ্র সরগরম হয়ে থাকে।
“কালো পায়খানা হয়েছে নাকি?”
বাড়ির লোক উত্তর দিলো “কাল থেকেই হচ্ছে – আজ কিরকম নেতিয়ে পড়েছে”
“হুম প্রেসার তো মাপাই যাচ্ছে না – মনে হচ্ছে রক্ত দিতে হবে – ওকে বড় হাসপাতালে নিয়ে গেলেই ভালো হয়।”
“ডাক্তারবাবু আমরা গরীব লোক একটু যদি দ্যাখেন – ”
ঋষি ভুরু কোঁচকায়। কৌশিকও হাজির। “ঋষিদা কোল্ড সোয়েটিং হচ্ছে – এতো ইর্রিভার্সিব্ল শকে চলে যাচ্ছে!”
“একটু স্যালাইন ট্যালাইন চালান না – বমি পায়খানা – কয়েক বোতল স্যালাইন টানলেই ঠিক হয়ে যাবে” প্রধানের গলা শোনা গেল “ডাক্তারবাবু এটা আমার ভাইপো একটু দেখে দিন”
“কৌশিক রেফার করতে গেলে স্বাস্থ্য ভবনের পার্মিশান লাগবে – তাই না?”
প্রধান আবার মুখ খুললো “আমি এমএলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি, এই নিন” বলে ফোনটা এগিয়ে দিলো। কথা বলতে বলতে ঋষির ভুরু কুঁচকে উঠলো- দু একবার কী বলতে গিয়ে বাধা পেলো, তারপর ফোনটা ফেরৎ দিয়ে ঘোষালদাকে স্যালাইন রেডি করতে বললো। এটা একটা ছোট্ট স্বাস্থ্য কেন্দ্র- মোটামুটি কাজ চালানো গোছের ব্যবস্থা আছে।
সন্ধ্যা নামছে- ঋষি বললো “কৌশিক রে, ইনফিউশন পাম্প নেই যে একটু নর অ্যাড চালাতে পারলে লড়াই করা যেতো …”
কৌশিক অপেক্ষমান জনতাকে বললো “আপনাদের ব্লাড আসতে কত দেরী? হিমোগ্লোবিন তিন গ্রামের নীচে …. এখনো ভেতরে রক্তপাত হচ্ছে …”
ছেলেটার বাবা পাশে দাঁড়িয়ে আছে – ফ্যাশফ্যাশে গলায় বলে উঠলো “ডাক্তারবাবু শরীরটা বড্ড ঠান্ডা লাগছে – চোখ উল্টে দিয়েছে ..”
ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলো “বাবুরে এ তোর কী হোলো রে – এই শূয়োরের বাচ্চারা আমার জোয়ান ছেলেটাকে মেরে ফেললো রে -” তার কান্না স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছাড়িয়ে পাশের ঘন গাছে আকাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।
সাত্যকি মন্ডল একুশ বছর, অতিরিক্ত রক্তপাতে মৃত। পরিজনের চিৎকারে কান পাতা দায়। বাবার আর্ত কান্না – মায়ের ডুকরানো হাহুতাশ আর দুই নিস্তব্ধ নিশ্চল মূর্তিবৎ তরুণ ডাক্তার।
একজন ঋষির জামার কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছে- ঋষির নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে- রক্তে জামা ভেজা- “যদি তোর ছেলে তোর সামনে মরে যেত তাহলে বুঝতিস বাঞ্চোৎ সন্তান হারানোর কষ্ট কেমন লাগে!”
সবাই রক্তাক্ত ঋষিকে ধরে রেখেছে- চারজন মিলে- চেপে রেখেছে। ঋষির চোখ বিস্ফারিত- মুখে গ্যাঁজলা উঠছে। কয়েকজন ওর কোয়ার্টার ঘিরে কেরোসিন ছেটাচ্ছে- দেশলাই ধরালো- “দ্যাখ বাঞ্চোৎ চোখের সামনে সন্তান মরলে কেমন লাগে?”
আগুনে আগুনময় হয়ে গেলো- মেঘে ঢাকা বনভূমি আগুনের আভায় লাল হয়ে উঠলো। হে মেঘ একটু বৃষ্টি দাও- দু ফোঁটা জল ঢেলে দাও প্রজ্জ্বলিত আগুনে। ঋষির গায়ে অমিত শক্তি জন্মালো- সব হাত ছাড়িয়ে আগুনে প্রবেশ করলো- জ্বলন্ত আগুনের মতো একটা মানুষ দুহাতে চাবি ঘোরাচ্ছে- তমসো মা জ্যোতির্গময়- মৃত্যুং মা অমৃতং গময়- জীবন থেকে মৃত্যু পার হয়ে অমৃতলোকে যাও ঋষি- ওই কি আকাশে ওদের দেখা যাচ্ছে? কেউ একটা কান্নার শব্দও শোনে নি।
সকাল হয়ে গেল। পুলিশ এলো- খুঁজে পেতে অস্থিভস্ম কুড়িয়ে নিয়ে গেলো- পোস্টমর্টেম হবে।
পুলিশ সাহেব এসে বসলেন- “কৌশিকবাবু আর কষ্ট করে দাহ করতে হবে না, আগুনই সৎকার করে দিয়েছে।”
আর কে এসেছে পাশে? কৌশিক জানে না- শুধু আগুন- আগুনে মিশে যাওয়া তিনটে শরীর।
পাশে রয়েছেন এমএলে সাহেব “এই মন্ডলদা বাড়ি থেকে খাবার এনেছো? ডাক্তারবাবু খেয়ে নিন- দুপুর হয়ে গেছে- মন্ডলদা ক্ষমা চেয়ে ডাক্তারদাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিন বাঃ এই তো ব্যাস মিটে গেলো তো? পুলিশসাহেব দেখুন ডাক্তারবাবু খাচ্ছেন- এটাকে দুর্ঘটনা বলে লিখে দিন- এমা বোকা ছেলে খাওয়ার সময় কাঁদতে নেই- দেখুন মন্ডলদা আপনার জন্যে কচি পাঁঠার ঝোল এনেছে- রসগোল্লা এনেছে- লক্ষ্মী সোনা ডাক্তার খেয়ে নিন”
রাত বাড়ছে। সবাই ঘরে ফিরে গেছে- কৌশিক ছুটি চায়। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে – ঐ তো লেখা আছে ছুটির খবর।
সকাল বেলা স্বাস্থ্য ভবনের আধিকারিক ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। খবর স্ক্রোল করছে । পঞ্চান্ন গ্রামে ডাক্তারের আত্মহত্যা- আগের দিন রাত্রে ওনার সহকর্মী ডাক্তার ঋষিরাজে সপরিবারে একটি দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান- মানসিক অবসাদে ডাক্তার কৌশিক ভট্টাচার্য মাঝরাতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আধিকারিক ভুরু কুঁচকোলেন যাঃ শালা আরেকটা ভ্যাকেন্সি তৈরী হলো।