ইতালীয় মানুষদের আমার এমনিতেই একটু বেশি ভাল লাগে। কোন অজানা কারণে এরা বাদবাকি ইওরোপীয়দের থেকে অনেক বেশি প্রাণোচ্ছল, আড্ডাবাজ, আমুদে। আজকে এক জোড়া ইতালীয়র গল্প বলি।
আন্দ্রেয়া এবং সারা বিয়াঞ্চি। আন্দ্রেয়ার বয়স ৮১, সারার ৭৮। এদের সাথে আমার আলাপ হয়েছিল হাসপাতালের ওয়ার্ডে।
একটা সোমবারের সকালবেলার কথা, আমি রাউন্ড দিচ্ছি। সাথে কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার আর মেডিকাল স্টুডেন্ট রয়েছে। রুগী দেখার সাথে সাথে একটু একটু পড়াশোনাও চলছে। আন্দ্রেয়ার বিছানার কাছে যখন পৌঁছলাম তখনও ও প্রায় অচৈতন্য। সারারাত নাকি পায়ুদ্বার দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। হিমোগ্লোবিন কমেছে। এক ইউনিট রক্ত দিতে হয়েছে৷ আরেকটা ব্যাগ তখন নার্স সদ্য টাঙিয়ে দিয়ে গেছেন। অন্যান্য রুগীদের মতোই আন্দ্রেয়াকেও পরীক্ষা করলাম। রক্ত পড়া তখন বন্ধ হয়েছে৷ কিন্তু পায়ুদ্বারে পাইলস জাতীয় কিছু খুঁজে পেলাম না। তাহলে রক্তটা পড়ল কোথা থেকে?
এই বয়সে পাইলস বাদে আরেকটা যে কারণে রক্তক্ষরণ হয় সেটা খুব একটা ভাল কিছু না। কোলন ক্যান্সার। জিনগত কারণে এশিয়ার তুলনায় ইওরোপে কোলন ক্যান্সারের প্রকোপও বেশি অনেক।
আন্দ্রেয়ার পাশেই বসেছিলেন প্রৌঢ়া। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। নাম বললেন সারা। আন্দ্রেয়ার স্ত্রী। ওনাকে বললাম আন্দ্রেয়ার অবস্থার কথা। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে, একটু সময় লাগবে ঠিক হতে। তবে দিন দুয়েকের মধ্যে একটা কোলনস্কোপি করতে হবে। মানে ক্যামেরা দিয়ে কোলন দেখা আর কি। সারা সব বুঝলেন, বললেন ‘এবারে একটু আশ্বস্ত লাগছে, এখানে কফিশপটা কোথায় বলতে পারেন প্লিজ?’
পরের দিন রাউন্ডে গিয়ে দেখি আন্দ্রেয়ার অবস্থা একই রকম। রাতে আবার ব্লিডিং হয়েছে। হিমোগ্লবিন অনেক নিচে নেমে গেছে। সারা তখনও পাশে বসে আছেন। শুনলাম ভদ্রমহিলা রাতে বাড়ি জাননি। আমি বললাম, ‘আপনি একটু রেস্ট নিন, আন্দ্রেয়া ভাল থাকবে আমাদের কাছে। চিন্তা করবেন না। সন্ধের দিকে এসে একবার দেখে যাবেন না হয়।’
সারা এক মুখ হাসি নিয়ে বললেন, ‘ কি করে যাই বলুন। ও আমাকে ছাড়া একা থাকতে পারে না। যদি রাতে জ্ঞান ফিরে দেখত পাশে আমি নেই তাহলে ভয় পেত। বয়স হয়েছে তো, তাই এখন মাঝে মাঝে ভুলে যায় এটা সেটা। চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক আছি।’
তিন নম্বর দিনে রাউন্ড দিতে গিয়ে দেখি বুড়ো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বিছানায় বসে আছে। পাশে চেয়ারে বসে সারা। আন্দ্রেয়ার পেটে ব্যথা আছে সামান্য, তার সাথে জ্বর। বাকি সব ঠিক আছে। শেষ ১৬ ঘন্টার মধ্যে রক্তপাত আর হয়নি৷ তিন ইউনিট রক্ত পেয়ে হিমোগ্লবিনও তড়তড় করে উঠছে। আমাকে দেখে সারা বললেন, -দেখ এই ডাক্তার দেখছেন তোমাকে তিনদিন ধরে।
-কিন্তু আমি তো তোমাকে দেখিনি ছোকরা!
বুঝলাম বুড়ো খুব আমুদে, বললাম, -আপনি তো ঘুমোচ্ছিলেন। দেখবেন কি করে?
-ও হ্যাঁ তাও তো বটে। তাই ভাবি এত খিদে পাচ্ছে কেন আজকে।
আন্দ্রেয়াকে বললাম ও আজকে যা খুশি খেতে পারে। রাত বারোটার পরে কিছু আর না খেলেই হল, কাল কোলনস্কপি আছে। ওদের সাথে কথা বলার সময় খেয়াল করলাম দুজনের হাতেই তাসের কার্ডের মতো কিছু একটা ধরা। কিন্তু আমরা যেমন তাস দেখি তেমনটা একেবারেই নয়। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি? সারা বলল এটা ব্রিসকোলা, এক ধরণের ইতালীয় তাস। বুড়ো বলল, -বসে যাও ডাক্তার, তোমাকে ব্রিসকোলা খেলা শিখিয়ে দি।
– এখন তো হবে না, আমি বিকেলের দিকে আসছি।
ওই অদ্ভুত তাস গুলো দেখে নিজেরই খেলাটা শেখার লোভ লাগছিল। তাই হাসপাতালের কাজ মিটিয়ে ৫ টা নাগাদ গেলাম ওয়ার্ডে। তখনও আন্দ্রেয়া আর সারা একই ভাবে ব্রিসকোলা খেলে যাচ্ছে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ওদের সাথে বসলাম। আমাদের গেম অফ কার্ডস এর থেকে একদমই আলাদা খেলাটা। ৫২ টার জায়গায় ৪০ টা কার্ড। চার রকমের চিহ্ন; কয়েন, সোর্ড, পট আর ক্লাব। রাজা, রানী, গোলামও আছে। রাজাকে বলে রে, রানী ডোনা আর গোলাম হল নাইট। প্রতিটা কার্ডের পয়েন্ট আছে। যে বেশি পয়েন্ট করবে সে জিতবে।
দুই বুড়োবুড়িতে প্রবল উৎসাহ নিয়ে আমাকে খেলাটা বোঝাচ্ছিল। তার মধ্যে অনেক গল্পও হল। দুজনেরই বাড়ি উত্তর ইতালির একটা ছোট গ্রামে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে। তারপরে এদেশ সেদেশ ঘুরে থিতু হয় ইংল্যান্ডে। আন্দ্রেয়া লোহার ফ্যাকটরিতে চাকরি করত। সারা কাজ করত একটা বেকারিতে। নিঃসন্তান দম্পতি। এখন অখন্ড অবসর, বছরে একবার ঘুরতে বেরোয়। আর বাকিটা সময় চলে এই খেলা, ব্রিসকোলা।
-এত ভাল লাগে আপনাদের এটা খেলতে!
-আমরা দুজনেই ব্রিসকোলার মায়েস্ত্রো বুঝলে ডাক্তার।
সারা এবারে জনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হেসে বলল, -কিন্তু চ্যাম্পিয়নটা কে সেটা বলে দাও ওকে!
-হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বুড়ির লাকটা খুব ভাল বুঝলে। ১০০ বার খেললে ৮০ বার জেতে। না হলে বুদ্ধি কিন্তু আমারই বেশি। এই খাতাটা দেখছ?
খেয়াল করেছিলাম একটা রুলটানা পাতার খাতায় ওরা স্কোর লিখে রাখছে।
-এই খাতাটাতে আমি সব খেলার হিসাব লিখি। একটাও ছাড়ি না। বাড়িতে এরকম আরো দশ বারোটা খাতা জমা হয়েছে। ঠিক করেছি একদিন বসে সব কটা খাতা খুলে গুনে দেখব। কে জিতল শেষে? বুড়ি না আমি?
তিনজনেই আমরা হাসছি তখন।
।।
পরের কয়েকটা দিন আমার ছুটি ছিল। সত্যি কথা বলছি ওদের কথা আমার আর মাথায় ছিল না। বাড়িতে ঢুকলে হাসপাতালের কথা মনে থাকেও না। কিন্তু ছুটি কাটিয়ে ওয়ার্ডে পা দিতেই মনে পড়ল বুড়োর কথা। বেডে তখন অন্য রুগী। জুনিয়রকে জিজ্ঞাসা করলাম আন্দ্রেয়ার কোলনস্কপির রিপোর্ট কি ছিল। ও বলল ভাল, কোন টিউমার মেলেনি। ছোট্ট একটা পাইলস পাওয়া গেছে, ওইটুকুই। যাক, ভাল খবর তাহলে।
সেদিন দুপুরের দিকে রাউন্ডের শেষে হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাঁটছি এমন সময় পিছন থেকে কে ডাকল, -কি হে ছোকরা, কেমন আছ?
পিছনে ঘুরে দেখি আন্দ্রেয়া! আমি একটু অবাকই হলাম। সদ্য ছুটি হয়েছে ওর। আউটপেশেন্ট ডিপার্টমেন্টে ফলো আপে আসতেও অন্তত সপ্তাহ তিনেক দেরী।
-আপনি কি করছেন এখানে?
-আমি এখন রুগীর বাড়ির লোক বুঝলে।
-মানে?
-মানে রোল রিভার্সাল, বলেই হাহা করে হাসতে লাগল আন্দ্রেয়া।
ওর পিছু পিছু রেসপিরেটরি ওয়ার্ডে এলাম। আন্দ্রেয়ার যেদিন কোলনস্কপি হয় তারপরের দিনই সারার মুখ দিয়ে হঠাৎ কাশির সাথে রক্ত ওঠে। ওয়ার্ডের লোকেরাই ওকে ভর্তি করে দেয়। তারপরে সারার বুক পেটের সিটি স্ক্যান হয়েছে। লাঙ ক্যান্সার, ছড়িয়ে গেছে লিভারে। শেষ স্টেজ।
আমি হতভম্বের মতো সারার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরচ্ছিল না। প্রৌঢ়া যখন সৌজন্যবোধ থেকে জানতে চাইলেন কেমন আছি তখন শুধু ঘাড়টাই নাড়তে পারলাম। এই কদিনে চেহারায় তেমন কোন তফাত চোখে পড়ছে না। বোঝার উপায়ই নেই যে মানুষটা আর কয়েক মাসের মধ্যেই আর থাকবে না। সারার বিছানায় ব্রিসকোলার তাস ছড়ানো। আর সেই খাতাটা খোলা।
দম্পতির খেলা থামেনি।
আমি আমতা আমতা করে আমার মেকী ডাক্তারি স্বরে বললাম, -অঙ্কোলজিস্ট দেখে গেছেন? কেমোথেরাপিতে লাইফ এক্সপেন্টেন্সি একটু হলেও..
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আন্দ্রেয়া বলল, -না না, কেমোথেরাপির দিকে আমরা যাব না ঠিক করেছি। ওসব করলে আমার সারা আর সুন্দরী থাকবে না। চুল উঠে যাবে, চামড়া কালো হয়ে যাবে। কাল একটা বায়প্সি হওয়ার কথা আছে। তারপরেই আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাব। বাড়ি গিয়ে অনেক কাজ, খাতা গুলো খুলে হিসাব মেলাতে হবে। এই বুড়ি পালাবার আগেই জানতে হবে না কে জিতল!
এবারে স্বামী স্ত্রী এক সাথে হাসছিল। আমার মুখেও হাসি ছিল একটা। কাঠের পুতুলের গায়ে একটা বাঁকা দাগ টেনে যেভাবে হাসি আঁকে, তেমন। দুজনকেই বাই বলে বেরিয়ে এলাম ওয়ার্ড থেকে। দেখি পিছন পিছন আন্দ্রেয়া আসছে।
-ডাক্তার তুমি আমার কোলনস্কপির রিপোর্টটা দেখেছ?
-আমি নিজে দেখিনি, আমার কলিগ বলেছে, নর্মাল আছে তো সব।
-তুমি শিওর নর্মাল আছে? ওরা কিছু মিস করে যায়নি? আরেকবার করে দেখবে প্লিজ?
বুড়ো আন্দ্রেয়া তখন হয়ত মনে প্রাণে চাইছিল যদি ওর কোলনস্কপিতেও একটা ক্যান্সার ধরা পড়ত, তাহলে আর একা থাকতে হত না।
একা থাকার চেয়ে ভয়ঙ্কর রোগ তো আর কিছু নেই।
||
প্রেম, ভালবাসা, এগুলোর সংজ্ঞা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। শরীর, যৌনতা বাদ দিয়ে দিলে ভালবাসাটা কেমন থাকে আমি সত্যিই জানি না। এই বয়সে হয়ত সেই উপলব্ধিটা হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু আমি আন্দ্রেয়া আর সারাকে দেখেছিলাম। ওদের সম্পর্কের উষ্ণতাটা অনুভব করেছিলাম। সেখানে কেউ বলে না ‘ভালবাসি’। কোন কাম আর অবশিষ্ট নেই সেই প্রেমে। এই ভালবাসাটা একটা রোজের অভ্যাসের মতো। যা নিজের অবচেতনেই বয়ে যায়। এই অভ্যাসটার সৌভাগ্য কত জনের হয় জানি না। তার জন্য হয়ত বুড়ো হতে হবে।
বুঝলাম শরীর ন্যুব্জ হলে মনের ওজন বাড়ে।
বাড়েই।
অসাধারণ স্যার। কিন্তু সারা ম্যাডাম এর জন্য সত্যি দুঃখ হচ্ছে।মানুষ অমর হয় না, কিন্ত প্রেমটা অমরত্ব পেয়ে যায়। মৃত্যুকে আটকানো সম্ভব নয়, আসন্ন ‘বন্ধু’ বিয়োগের যন্ত্রণা আন্দ্রেয়া কী করে সহ্য করবে জানি না।
কে যেন বলেছিল কাঁদালে তুমি মোরে । ডাক্তার তুমি আমাকে কাঁদালে । তবে তোমার এই লেখাটা আমি আগেও পড়েছি ।
মনে হচ্ছে ঐ couple এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।কী আন্তরিক জীবন্ত বর্ণনা।এমন মরমী না হলে ডাক্তার।
আবার ভালো লাগলো।