প্রাককথন
২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একক মাত্রা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। দশ বছর পরে ফিরে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমেনি। অন্য কথায় বলা যায়, আমরা রবীন্দ্র-পূজার বহুতর আয়োজনের মাঝে তাঁকে ভুলে থাকার অভ্যাস রপ্ত করেছি। রোগ হবার পরে হাসপাতাল ডাক্তারখানায় চিকিৎসা নিয়ে আমাদের যেটুকু হইচই, জনস্বাস্থ্য নিয়ে সেটুকুও নেই। ফলে কর্পোরেট আমাদের জন্যে স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করে দেবে, আমরা স্রেফ টাকার থলিটা জোগাড় করতে পারলেই ভূরিভোজে বসে যাব, নানাবিধ চিকিৎসা-বিভ্রাট সত্ত্বেও এমন ভাবনা আমাদের এখনও ছাড়েনি।
তাই পুরনো লেখাটি কিঞ্চিৎ ঘষামাজা করে এখানে রাখছি। দীর্ঘ লেখায় ফেসবুকে পাঠক জোটে না। তাই লেখাটি ভেঙ্গে নিয়েছি চারটি পর্বে। প্রতিটি পর্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, কিন্তু এক-একটি পর্ব পড়লে তার বিষয় আলাদা করে পড়ে বুঝতে অসুবিধা হবার কথাও নয়।
পর্ব ৩
(দ্বিতীয় পর্বের পরে)
জনস্বাস্থ্যের সামাজিক প্রেক্ষিত ও রবীন্দ্রনাথ
সমাজের উন্নতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা সম্পর্কে দুটি সাধারণীকরণ করা যায়।
প্রথমতঃ, শিক্ষাই প্রাথমিক উপায়।
দ্বিতীয়তঃ, বাইরে থেকে ভাল করার শেষ নেই। তা দাতাকে তৃপ্তি দেয় সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে উপকৃতের সত্যিকারের ভাল হয় না, বরং তার সর্বনাশ স্থায়ী রূপ পায়। দরকার হল শিক্ষা দিয়ে গ্রহীতাকে স্বাবলম্বী করে তোলা।
স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের কাজ ও চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ‘শিক্ষা’। জনস্বাস্থ্য নিয়েও তাঁর চিন্তার মূল জায়গাটা ছিল জন-এর শিক্ষা। এমন শিক্ষা যা মানুষকে স্থায়ীভাবে পরনির্ভর করে না, যা তাকে স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজটুকু অন্তত নিজে করে নিতে শক্তি যোগায়। নিজের ভালমন্দ নিজে বুঝে নিতে সক্ষম করার মত শিক্ষা।
কিন্তু এটাই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সম্পর্কিত চিন্তার একমাত্র দিক নয়। তাঁর চিন্তায় আরেকটি দিক ছিল যাকে এর প্রায় বিপরীতমুখী বলে মনে হয়। সেই দিকটি হল, প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে ধর্ম ও সামাজিক সংগঠন বড়মানুষের ওপর কিছু উপকার করার দায় চাপিয়েছিল। ব্রিটিশের দ্বারা ওপর থেকে করে দেওয়া জনহিতকে রবীন্দ্রনাথ সুনজরে না দেখলেও, এদেশীয় বড়মানুষের দায় পালনকে তিনি মহিমান্বিত করেছেন বলা যায়।
ব্রিটিশ এদেশে আসার আগে পুণ্য-অর্জন বা সামাজিকতার খাতিরে যে যৎসামান্য ‘সামাজিক ব্যয়’ এদেশের রাজা-রাজড়া জমিদার-জায়গীরদার শ্রেষ্ঠিরা করতেন। তাঁর জন্মের আগে থেকেই সে ব্যয় ক্রমশ কমে আসছিল। বড়লোকেরা তাদের পারলৌকিক সুবিধের আশাতে অর্থব্যয় করছেন, এটা তিনি মেনে নিতেন। তারপরেও তিনি বলতেন, তাতেই সামাজিক হিতসাধন হচ্ছে, আর এতদিন এভাবেই ভারতবর্ষ বেঁচে বর্তে ছিল। ব্রিটিশ আগমনে বড়োলোকের ‘সামাজিক ব্যয়’ কমে গেল, নিজের আর্থিক উন্নতি মুখ্য, এমনকি একমাত্র হয়ে দাঁড়াল। ধর্মের নামে তার এতদিনকার চলে আসা খরচাটা নিছক বাজে খরচ মনে করে সে তা বন্ধ করে দিল।
“যারা সেকালে কীর্তি অর্জন করতে উৎসুক ছিল, যাঁরা উচ্ছপদস্থ ছিলেন, তাঁদের উপর দেশের লোক দাবি করেছে। তাঁরা মহাশয় ব্যক্তি – তাঁদের জল দেবার … আরো অন্যান্য অভাব মোচন করে দেবার দাবি করেছি – তাঁদের পুরস্কার ছিল ইহকালে কীর্তি ও পরকালে সদগতি।” [‘ম্যালেরিয়া’, অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটিতে কথিত, ফেব্রুয়ারী ১৯২৪]
“বেশিদিনের কথা নয়, নবাবি আমলে দেখা গেছে, তখনকার বড়ো বড়ো আমলা যাঁরা রাজদরবারে রাজধানীতে পুষ্ট … অর্জন করেছেন শহরে, ব্যয় করেছেন গ্রামে। মাটি থেকে জল একবার আকাশে গিয়ে আবার মাটিতেই ফিরে এসেছে, নইলে মাটি বন্ধ্যা মরু হয়ে যেত। আজকালকার দিনে গ্রামের থেকে যে প্রাণের ধারা শহরে চলে যাচ্ছে, গ্রামের সঙ্গে তার দেনাপাওনার যোগ আর থাকছে না।” [‘পল্লীপ্রকৃতি’, ফেব্রুয়ারী ১৯২৮]
লক্ষ্য করার যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ধর্মের সঙ্গে ‘সামাজিক ব্যয়’-এর একটা সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেন। বিষয়টা যে গণ-অধিকারের বিষয়, একে যে রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যেতে পারে, সেটা তিনি মনে করছেন না। তাঁর কাছে এ ক্ষেত্রে রাজনীতি অতি সংকীর্ণ, রাষ্ট্রনীতি মাত্র। কিন্তু রাজনীতি তো শুধুমাত্র রাষ্ট্রনীতি নয়, রাজনীতি হল ক্ষমতা বজায় রাখার প্রকরণ। কেবল গায়ের জোরে তক্ত দখল করলেই চলে না, নিঃস্ব মানুষের ওপর রাষ্ট্রের বিবিধ ভার চাপাতে হয়। তাদের যথাসম্ভব কম দিয়ে যথেষ্ট দেবার ঠাট বজায় রাখলে রাষ্ট্রযন্ত্র মসৃণভাবে চলে। সভ্যতার পিলসুজ যারা বইছে তারা মাথা চাড়া দিলে ওপরতলার সবার সমস্যা। তাই নীচে থাকা মানুষদের ভুলিয়ে রাখতে হয় ধর্মের বেশে। কেননা ধর্মের মার আরামের মার, সে শুধু মারে না, সে ভোলায়ও। রবীন্দ্রনাথ সেটা অন্য কারো চাইতে কম জানতেন না। কিন্তু তবু তিনি ভেবেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুশাসনের প্রত্যক্ষ ফল যে শাসকের কৃপাদৃষ্টি, তার দান, সেটার ওপরেই ভরসা করে একদা পল্লী বেঁচে ছিল। ব্রিটিশ-বনিকতন্ত্রে বড়মানুষ সেই কৃপার দান করে না বলেই দুর্গতি জন্মেছে। বড়মানুষ গ্রামে বাস করলেই গ্রামে খানিকটা স্বচ্ছলতা স্বাভাবিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পুণ্যার্জনের সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতি আর জনস্বাস্থ্যকে সরাসরি জুড়ে দিলেন। ভাবলে কিঞ্চিৎ আশ্চর্যই লাগে। মনে হয় নিজে বড়মানুষ হিসেবে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা তিক্ত ছিল বলেই তিনি বড়লোকের দান দিয়ে দরিদ্রকে ভোলানোর স্বরূপটি দেখতে পাননি, বা দেখতে চাননি।
“আমাদের দেশে পুণ্যের লোভ দেখিয়ে জলদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতএব যে লোক জলাশয় দেয় গরজ একমাত্র তারই। এইজন্য যখন গ্রামের লোক বললে, ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’ তখন তারা এই কথাটাই জানত যে, এ ক্ষেত্রে যে মাছটা ভাজা হবার প্রস্তাব হচ্ছে সেটা আমারই পারত্রিক ভোজের, অতএব এটার তেল যদি তারা জোগায় তবে তাদের ঠকা হল। এই কারণেই বছরে বছরে তাদের ঘর জ্বলে যাচ্ছে, তাদের মেয়েরা প্রতিদিন তিন বেলা দু-তিন মাইল দূর থেকে জল বয়ে আনছে, কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত বসে আছে যার পুণ্যের গরজ সে এসে তাদের জল দিয়ে যাবে।” [‘পল্লীর উন্নতি’, মার্চ ১৯১৫]
কিন্তু সমাজনীতি ধর্মপালন এসব হঠাত গজিয়ে ওঠা কোনো আকাশকুসুম তো নয়। পুকুর কেটে জলদানের পূণ্য অর্জন করে যে জমিদার ব্যক্তিগতভাবে তার মনে যাই থাকুক না কেন, যে সব ধর্মপ্রণেতারা ‘জলদান অতি পূণ্যকর্ম’ এমন অনুজ্ঞা চালু করেছিলেন তাঁরা জ্ঞানী ছিলেন। তাঁরা জানতেন, যাদের শ্রম আত্মসাৎ করে রাজাগজারা তক্তে বসে আছেন, তাদের ভুলিয়ে রাখতে হবে। ভোলানোর যে ক’টি কায়দা আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে বোধ করি ধর্ম সবচেয়ে পুরনো হয়েও এখনও ভারী কার্যকর। ধর্ম তো শুধু পুরুত-পাণ্ডা-মোল্লার বেশে ভোলায় না, তা ভোলায় জমিদারের পুকুর কাটার পুণ্যকর্মের মধ্যে দিয়ে, পুজো-আচ্চার পরে দরিদ্র-নারায়ণের জন্য মহাভোজের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন ‘শ্রদ্ধয়া দেয়ম’। কিন্তু শ্রদ্ধায় হোক বা অশ্রদ্ধায়, ন্যায্য পাওনা না দিয়ে মাঝে মধ্যে ‘দরিদ্র নারায়ণ’ বলে শ্রদ্ধাপ্রকাশ আসলে দরিদ্রকে ভোলানো। আপন কর্মের অধিকারী হিসেবে তাদের দাবি রয়েছে জমিদারের কাটানো পুকুরে, কাঙ্গালভোজন বা দরিদ্র-নারায়ণ সেবায়। তাদের দাবি রয়েছে সমস্ত সামাজিক সম্পদে। রাজাগজা দাতাবেশীরা পরান্নভোজী পরজীবী মাত্র। যারা ধনীর সম্পদ সৃষ্টি করে তারাই দাতা-ধনীর দান গ্রহণের ফলে ভিক্ষুকে পরিণত হয়।
অথচ এইটাই একমাত্র রবীন্দ্রনাথ নন। আরেকজন রবীন্দ্রনাথ আছেন, যিনি স্বচ্ছদৃষ্টিতে দেখতে পান সংগঠিত ধর্ম আর দয়াধর্ম হল একই রাজনীতির এপিঠ ওপিঠ। তার কোনও একটির বশবর্তী হলে মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। রাশিয়ার চিঠিতে তিনি দ্বর্থ্যহীন ভাষায় সে কথা লিখছেন।
“ঠিক আমাদেরই দেশের জন-মজুরদের মতোই নিরক্ষর নিঃসহায় নিরন্ন … তাদেরই মত অন্ধসংস্কার এবং মূঢ় ধার্মিকতা। দুঃখে বিপদে এরা দেবতার দ্বারে মাথা খুঁড়েছে; পরলোকের ভয়ে পান্ডাপুরুতের হাতে এদের বুদ্ধি ছিল বাঁধা … যারা এদের জুতোপেটা করত তাদের সেই জুতো সাফ করা এদের কাজ ছিল।” [‘রাশিয়ার চিঠি’]
রাজনীতিকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রনীতি বলে ভাবলে, তাকে এড়িয়ে গিয়ে, সমাজের মধ্যে দরিদ্র মানুষের মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেবার সমস্যা আছে। কেননা অর্থ-ক্ষমতা-সমাজ-শিক্ষা-ধর্ম-রাষ্ট্র সবই যে জটিল রসায়নে সম্পর্কিত তারই চলতি নাম হল রাজনীতি। রবীন্দ্রনাথ হয়তো তাকে খানিকটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর অপরিসীম মনীষা ও সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে সাময়িক কিছু সফলতা দিয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতা ও নেশন স্টেটের গড়ন ও আদর্শ তাঁর শিক্ষা ও সামাজিক আদর্শকে আত্মসাৎ করে ফেলল। ফলে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে যে আত্মনির্ভর পল্লী-উন্নয়নের আদর্শ কিছুটা রূপায়িত হয়েছিল সেটা ভারতের ‘রোল মডেল’ হবার বাস্তবতা তৈরিই হল না। দান-ধ্যানের ঘাড়ে চেপে সে মহাযঞ্জ হবার কথাও নয় বোধ হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় কিন্তু কোনোরকম ফাঁকি ছিল না। তিনি নিজে টাকা ধার করে, তাঁর প্রবল কর্মশক্তি ব্যয় করে, তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে যেটুকু করতে পেরেছিলেন সেটা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। গড়পড়তা লোকে এ কাজ পরে আর করে উঠতে পারেনি, এমনকি চালিয়ে যেতেও পারেনি। পারার কথাও নয়।
কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পরে তাঁরই চিন্তার প্রতিধ্বনি তুলল যেন। পরের পর্বে আসব সে কথায়।
(ক্রমশ)
তথ্যসূত্র
লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রচনার সূত্র উল্লেখ করা আছে।
চিত্র পরিচিতি
১) রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন
২) রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজী—রাজনীতি ও গ্রামগঠন