নতুন কিছু শিখলেই তা প্রয়োগের জন্য হাত নিশপিশ করে। যেমন নতুন দাঁত উঠলেই বাচ্চারা কামড়াতে চায়। নতুন বিয়ে করা বর, বউ ঘেঁষা হয়ে থাকে। বড়ঞা হাসপাতাল থেকে নো স্ক্যালপেল ভ্যাসেকটমি ট্রেনিং নিয়ে আসার পর আমারও একই অবস্থা হল।
নো স্ক্যালপেল ভ্যাসেকটমি মানে ছুরি ছাড়াই পুরুষদের নির্বীজ-করন অপারেশন। আগে সার্জিকাল ছুরি দিয়ে স্ক্রোটামের দুপাশে কেটে ভ্যাসেকটমি করা হতো। নতুন পদ্ধতিতে কাটাকাটি করার দরকার নেই। এমনকি অপারেশনের পরে সেলাইয়েরও দরকার নেই। খুব ছোটো একটি ছ্যাঁদা করেই অপারেশন করা হয়।
আমি এর আগে ছুরি দিয়ে অথবা ছুরি ছাড়া কোনও ভ্যাসেকটমি’ই করিনি। শিখে আসার পর থেকে হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু করবার মতো লোক খুঁজে পাচ্ছি না। যে পুরুষ রোগীকেই দেখছি আউটডোরে অথবা ইনডোরে, জিজ্ঞাসা করছি, ‘আপনার কটা ছেলেমেয়ে।’ দুই বা তার বেশী বললেই খোঁজ নিচ্ছি তার স্ত্রীর লাইগেশন করা আছে কিনা।
স্ত্রীর লাইগেশন করা নেই শুনলেই বলছি, ‘আপনি তাহলে ভ্যাসেকটমি বা নির্বীজ-করনের অপারেশনটা করে নিন না।’ কিন্তু কেউ আমার প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না।
একজন ডাইরিয়ার রুগীকে নির্বীজ-করনের জন্য বাড়াবাড়ি রকমের কাউন্সিলিং করেছিলাম। সে বেচারা ডাইরিয়া কমার আগেই নিজেই সই করে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেল। একটা বুড়ো লোককে ধরেছিলাম। বুড়ো তো তেড়ে মারতে আসে। বলল, ‘আমার স্ত্রীর বয়স বাহান্ন। ওসব পাট কবেই চুকে বুকে গেছে। এসময় নির্বীজ-করন করে কী হবে? আমি কী পরকীয়া করব নাকি। তোমার তো মতলব ভালো নয় ডাক্তার।’
ভ্যাসেকটমি করলে সরকার এগারো শো টাকা ভাতা রোগীকে দেয়। কয়েকজনকে টাকার লোভ দেখালাম। একজন বলল, ‘আমি টাকার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিয়ে পারি, কিন্তু টাকার জন্য নিজের পুরুষত্ব দিতে পারব না।’
আমি বললাম, ‘পুরুষত্ব হারানোর প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? আপনার যৌন ক্ষমতা একই থাকবে। আমরা শুধু বীর্য বাহী নালি দুটির একটুখানি অংশ গিট্টি মেরে কেটে নেব।’
‘পুরুষমানুষের যদি বীর্যই না থাকে, তাহলে আর রইল কি?’
‘ইয়ে…, বীর্য ছাড়াও পুরুষ মানুষের অনেক কিছুই থাকে। তাছাড়া বীর্যই বা থাকবে না কেন। বীর্য স্বাভাবিকই থাকবে। শুধু তার মধ্যে শুক্রাণু থাকবে না।’
লোকটি আরও ঘেঁটে গিয়ে আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। তারপর বলল, ‘আমি প্রাণ দিতে পারি, কিন্তু শুক্রাণু না কি একটা বললেন, ওইটে দিতে পারব না।’
আমার ধারণা ছিল, পুরুষদের সাহস নারীদের থেকে বেশী এবং লাজ-লজ্জাও কম। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো সত্যিটা সম্পূর্ণ উল্টো। পুরুষেরা ভ্যাসেকটমির নাম শুনলেই আঁতকে উঠে কাপুরুষের মতো পালায়। কেউ আবার নববধূর মতো লজ্জা রাঙ্গা মুখ করে বলে, ‘ছি, ছি। এসমস্ত অসভ্য জিনিস আমার পরিবারে কেউ কোনোদিন করেনি। করবেও না।’
বরঞ্চ রোগা, পাতলা, অ্যানিমিয়ায় ভোগা মেয়েগুলোর সাহস অনেক বেশী। সহ্য ক্ষমতাও বেশী। প্রতি সপ্তাহে দুবার করে মেয়েদের জন্য লাইগেশনের ক্যাম্প হত। এক এক ক্যাম্পে আশি থেকে নব্বই জন রোগী। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত যন্ত্রের মতো তিনজন ডাক্তার অপারেশন করে যেতাম। তাতেও ডেট পেতে ইচ্ছুক মহিলাদের দু-এক সপ্তাহ দেরী হতো। অপারেশনের আগে বা অপারেশনের সময় তাদের কোনও রকম ভয়ভীতি আমার চোখে পড়েনি।
প্রতি বুধবার আউটডোরে লাইগেশনের জন্য ইচ্ছুক মহিলাদের স্ক্রিনিং করা হতো। স্ক্রিনিং করা আমার দায়িত্ব ছিল। পুরুষদের বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এবার মহিলাদেরই বোঝাতে শুরু করলাম।
একজন অপুষ্টিতে ভোগা সাতের নীচে হিমোগ্লোবিন থাকা মহিলাকে ধরলাম। বললাম, ‘মা, তোমার শরীরের যা অবস্থা লাইগেশন করা অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে যাবে।’
‘ঝুঁকি নিয়েই করে দেন ডাক্তারবাবু। বছর বছর আর বিয়োতে পারছি না। চারখান হয়ে গেছে। নিজেদেরই খাওয়া জোটে না, ওদের খাওয়াব কি?’
আমি বললাম, ‘সেক্ষেত্রে তোমার স্বামীকেই ভ্যাসেকটমি করে নিতে বল না। একদমই ঝামেলা নেই। পেট কাটাকাটির ব্যাপার নেই। ব্যথাও লাগবে না। বরঞ্চ লাইগেশনে অনেক ঝামেলা। ইনফেকশনের সম্ভাবনা অনেক বেশী। রক্তপাতের সম্ভাবনাও বেশী। অনেক বেশি ব্যথা লাগে।’
‘এমন তো শুনি নাই। ছেলেদেরও বাচ্চা বন্ধের অপারেশন হয়?’
‘হবে না কেন? অনেকেই করায়। খুব ছোটো অপারেশন। নতুন পদ্ধতিতে করে দেব। এই অপারেশনে ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে। সংক্রমণের সংখ্যা আগের থেকে পাঁচভাগ কমে গেছে। রক্তও প্রায় বেরোয়না বললেই চলে।’
তারপর সেই মহিলাকে নো স্ক্যালপেল ভ্যাসেকটমির পদ্ধতি ও সুবিধা গুলি ভালো করে বোঝালাম। বললাম, ‘বাড়ি গিয়ে স্বামীকে বল। দরকার হলে আমার সাথে এসে কথা বলতে বল। তুমি এই শনিবার স্বামীকে নিয়ে আস।’
শনিবার সেই মহিলা এসে হাজির। একাই এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্বামী কই?’
মহিলা বলল, ‘ও আসে নাই, আমিই অপারেশন করব। যা হয় হোক, সামনের সপ্তাহেই করে দিন।’
‘স্বামীকে একবার নিয়ে আসোনা, আমি বলে দেখি।’
‘বলে কোনও লাভ নেই। ও কিছুতেই অপারেশন করাবে না।’
‘তুমি সঙ্গে করে নিয়ে আস। ডাক্তারের মুখের কথায় রাজি হতে পারে।’
মহিলা মাথা নিচু করে বলল, ‘রাজি হবে না।’
‘তুমি এতটা নিশ্চিন্ত হলে কি করে?’
করুণ হেসে সে বলল, ‘কারণ স্বামীকে অপারেশনের কথা বলার পর, ও একটা চেলাকাঠ দিয়ে আমাকে পিটিয়েছে। সারা শরীরে কালশিটে ফেলে দিয়েছে। আর বলেছে যদি ও কথা এরপরে একবারও বলি, তাহলে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে।’
অনভ্যাসে আমি কনফিডেন্স যখন প্রায় হারিয়ে ফেলেছি, তখন অযাচিত ভাবে একজন নিজেই এসে ভ্যাসেকটমি করার জন্য ভর্তি হল। তোবড়ানো গাল, ভাঙা চেহারা। বয়স যদিও বলছে ছত্রিশ, কিন্তু মুখ দেখে আন্দাজ করা মুশকিল। গায়ে তেল চিট চিটে কাপড়। আর কি গন্ধ! কতদিন স্নান করেনা কে জানে!
চেহারা যাই হোক, আমার কাছে সে তখন ঈশ্বরের দূত। যদিও দেখেই মনে হচ্ছে পাক্কা গেঁজেল। দাঁত গুলোতে নিকোটিনের গাড় হলুদ ছোপ। কিন্তু লোকটা ভ্যাসেকটমি করতে চায়। অতএব তার সব বাহ্যিক আবরণ তখন আমার কাছে তুচ্ছ। আমার হারানো কনফিডেন্স ফিরে পেতে স্বয়ং ঈশ্বরই এঁকে প্রেরণ করেছেন।
যথা সময়ে ওটিতে নিয়ে গেলাম। গ্রুপ ডি কর্মচারী সুকুমার দা বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, একেবারে নেশা করা চেহারা। সাবধানে করবেন।কামড়ে দিলে মুশকিল।’
অপারেশনের জায়গাটা পরিষ্কার করতে গিয়ে থমকে গেলাম। স্ক্রোটামের উপরে যে যায়গায় ফুটো করার কথা সেখানে একটি শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন।
ঈশ্বরের দূতকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কি?
লোকটা হলদে দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘এক্সিডেন্ট হয়েছিল ডাক্তারবাবু।’
সুকুমার দা বলল, ‘মারব এক থাপ্পড়। ইয়ার্কি মারার যায়গা পাও না। কি এমন এক্সিডেন্ট হল, যে ঐ জায়গাতেই ফুটো হল?’
আমি দু আঙুলের ফাঁকে ধরে ক্ষতস্থান দেখছি। এর নিশ্চিত ভাবে আগেও আরেকবার অপারেশন হয়েছে। আমি বললাম, ‘তোমার তো অপারেশন করাই আছে। আবার ভর্তি হলে কেন?’
সুকুমার দা বললেন, ‘কেন আবার। এগারো শো টাকার লোভে। নেশাড়ুরা নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য খুন জখমও করতে পারে।’
লোকটা এবার মুখ খুলল, ‘তাহলে আমার কি হবে? টাকাটা কি পাব না?’
বললাম, ‘নিশ্চয়ই পাবে। তবে এক অপারেশন তো দুবার করা যায় না। তাই ঠিক করেছি একটু বড় অপারেশন করব। দুটো বিচি সহ ফল একেবারে কেটে বাদ দেব। যাতে ভবিষ্যতে আমার মত কোনও ডাক্তার বিপদে না পরে। রাজি থাকলে বল।’
লোকটি বলল, ‘এ আপনাদের ভারি অন্যায়। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার।’ তারপর সে অপারেশন টেবিল থেকে উঠে প্যান্ট পরে গজ গজ করতে করতে হাঁটা দিল।
©ঐন্দ্রিল ভৌমিক
হাসির অনেক খোরাক থাকলেও হাসতে পারলাম না ঐন্দ্রিলদা।
কাহিনীর মধ্যে আমাদের সমাজে মায়েদের যে মর্মন্তুদ সত্যিটা অত সহজে তুলে ধরেছেন তার জন্য সেলাম।
অসাধারণ ।
?
বীর্য স্বাভাবিকই থাকবে। শুধু তার মধ্যে শুক্রাণু থাকবে না।
এই বিষ টা বুঝলাম না। একটু ক্লিয়ার করুন ডাক্তার বাবু।
টেস্টিস বা অন্ডকোষ থেকে তৈরী হয় স্পার্মাটোজোয়া বা শুক্রাণু। যা বীর্যের মোট পরিমাণের মাত্র ২-৫%। ভ্যাসেকটমির সময় এপিডিডাইমিস বেধে দিলে এই শুক্রাণু আসতে পারে না৷ কিন্তু বীর্যের মূল অংশ তৈরি হয় সেমিনাল ভেসিক, প্রস্টেট ইত্যাদি গ্রন্থি থেকে। যা এপিডিডাইমিসের পরে থাকে। ফলে শুক্রাণু ছাড়া বীর্যে সবই প্রায় একইরকম থাকে।
Marattok
?
Khub satti katha egulo …world population control er programm gulo korte giye amio face korechi egulo
ডক্টরস ডায়লগ এ স্বাগত।
হাসব না কাঁদব!
?
হা হা হা। মুর্শিদাবাদ কিন্তু এই ধরণের অভিজ্ঞাতার খনি।
বহরমপুরের একজন ডাক্তার ( নাম বললাম না) রোগীর পেট টিপে জিগ্যেস করছেন ” আম পরে …আম?”
রোগী বললেন ” কি যে বলেন ডাক্তার বাবু….আম পড়লে আপনার জন্য লিয়ে আসবো না?”
?
গ্রামের দিকে বা কিছুটা মফস্বল এলাকায় এখন ও লাইগেশন যতটা জনপ্রিয়, ভ্যাসেক্টমি এখন ও তার সিকিভাগ ও নয়। ভ্যাসেক্টমি করানোটা কোথাও যেন পুরুষের কাছে পৌরুষত্ব হারানোর মত ব্যাপার বলেই মনে করে বেশীরভাগ লোক।
?
উফ,শেষ টুকু পড়ে হাসতে হাসতে মরছি ডঃ ভৌমিক। আপনার রসবোধ সাংঘাতিক।
তবে সমাজ চিত্র টা যেটা তুলে ধরলেন, সেই টা পড়ে এই টাই মনে হল যে আজও গ্রামের দিকে মেয়েদের অবস্থা খুব ই করুন।
অনেককিছু জানলাম । দারুণ লেখাটি।
অসাধারন লেখা ।।
রস ও পেলাম আবার মন খারাপ ও।
কেন জানি শুধু মনে হয়, সরকার (পি.সি.নয়) সবার আগে সব মানুষের শিক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো দেশ টা পাল্টে যেত।।
ভীষণ হাসলাম কিন্তু সমাজের অন্ধকার দিক টাকেও উপস্থাপন করেছেন, অসাধারণ হয়েছে লেখাটা। যেমন প্রতিটি লেখা হয়।
লেখাটা পড়ে কিছু অভিজ্ঞতা হলো।এত সহজ করে বোঝানোর জন্য ধন্যবাদ।।এখন না,তবে ভবিষ্যতে আমি আসবো আপনার কাছে এটা করাতে।তখন একটু সময় দেবেন প্লিজ।
Daarun dada…. anabodya ?
Tomar golpo je hridoyer kothai giye kora nare!!!!! Thik bojhate parbo na….. thank you for sharing ur stories…..
Onobodyo
Asadharan. Rasabodher madhya diye samajer cheharata phutiye tolar janya dhanyabad
গল্পের ছলে ই অসাধারণ….
শেষটুকুর জন্য ???
মাঝের অংশটা পড়ে খুব কষ্ট লাগলো।
নমস্কার, আপনার লেখনীকে ও ভারতীয় মায়েদেরকে।