আমাদের দেশের জনসাধারণের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল ভাইরাল হেপাটাইটিস। আমাদের শরীরে যকৃৎ বা লিভারে ভাইরাস সংক্রমণের ফলে প্রদাহের সৃষ্টি হলে তাকে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলে।
এই রকম ভাইরাস প্রধানত পাঁচ প্রকারের হয় – হেপাটাইটিস A, B, C, D, E। সংক্রমণ দুই রকমের – স্বল্পমেয়াদী (Acute) বা দীর্ঘকালীন (Chronic) হেপাটাইটিস হতে পারে। সাধারণত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে আক্রান্ত হলে দীর্ঘকালীন হেপাটাইটিস হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাইরাল হেপাটাইটিসে জন্ডিস হয়ে থাকে, কিন্তু মনে রাখতে হবে জন্ডিস এবং ভাইরাল হেপাটাইটিস সমার্থক নয়। জন্ডিস অনেক কারণে হতে পারে। সব জন্ডিসের কারণ হেপাটাইটিস নয়।
অন্যদিকে ভাইরাল হেপাটাইটিস জন্ডিসবিহীনও (anicteric) হতে পারে। এমনকি সম্পূর্ণরুপে উপসর্গহীনও (asymptomatic) হতে পারে।
সংক্রমণ
হেপাটাইটিস A ও E ভাইরাস মূলত খাদ্যনালীর মধ্য দিয়ে জল ও খাদ্যের সঙ্গে শরীরে সংক্রমিত হয়। অন্যদিকে হেপাটাইটিস B, C ও D ভাইরাস রক্তের মাধ্যমে বা যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে বা জন্মগতভাবে সংক্রমিত হতে পারে।
উপসর্গ ও রোগ লক্ষণ
জন্ডিস এই রোগের মূল উপসর্গ। জন্ডিস কোন রোগ নয়, এটি একটি লক্ষণ। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরের চামড়া, চোখের সাদা অংশ বা স্ক্লেরা, মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। জন্ডিস পরীক্ষা করার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট জায়গা হলো চোখের স্ক্লেরা। দিনের আলোয় চোখের উপরের পাতা সরালেই স্ক্লেরার হলুদ রং স্পষ্টভাবে দেখা যায়। সাধারণত জন্ডিস দেখা দেবার ৪-৫ দিন আগে বমি বমি ভাব, খাদ্যে অরুচি, মাথা ব্যথা, শরীরে দুর্বলত, ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। জন্ডিস সাধারণত ১-৪ সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
এটা মনে রাখা জরুরী – অনিয়ন্ত্রিত বমি, ঝিমিয়ে পড়া, অস্বাভাবিক আচরণ এইসব উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
এই রোগে রক্তের পরীক্ষা লিভার ফাংশন টেস্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে রক্তের বিলিরুবিন, এস জি ও টি (S.G.O.T.) এবং এস জি পি টি (S.G.P.T.) উৎসেচকের মাত্রা বেড়ে যায়। জন্ডিসের কারণ নির্ণয়ের জন্য রক্তের হেপাটাইটিস ভাইরাল মার্কার এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম করানোর দরকার পড়তে পারে।
চিকিৎসা
এই রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে মানুষের মনে নানারকম কুসংস্কার প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, জন্ডিস মানেই গরম। অতএব, কোনোভাবে ঠাণ্ডা লাগাতে পারলে ভালো হয়ে যাবে। এজন্য দিনে অনেকবার স্নান করা, বরফ প্রয়োগ, প্রচুর পরিমাণে ডাব খাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে শরীর ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেন। অনেক ‘শিক্ষিত’ মানুষও বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা না করিয়ে মালা, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচের মতো নানা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে পড়েন।
আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বল্পমেয়াদী হেপাটাইটিস A ও E নিজের থেকেই ভালো হয়ে যায়। এখানে ওষুধের কোনও ভূমিকা প্রায় নেই বললেই চলে।
তবে হেপাটিক ফেইলিওর বা ডিহাইড্রেশন-এর মতো জটিলতা তৈরি হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
রোগীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এতে করে রোগীর শরীরের বেসাল মেটাবোলিক রেট কম রাখা যায়।
পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা আবশ্যক।
আর দরকার স্বাভাবিক রুচিসম্মত খাবার খাওয়া। জন্ডিসে প্রচলিত ডাবের জল, আখের রস ইত্যাদি খাবার খেতে পারেন। অনেকে মনে করেন এই রোগে হলুদ মশলা খাওয়া নাকি নিষেধ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে জন্ডিসের হলুদ এবং খাবারের হলুদের কোন সম্বন্ধ নেই। এই রোগে এমনিতেই খাবারে রুচি কমে যায়, তাই মশলা বিহীন বিস্বাদ খাবার খাওয়া একেবারেই যুক্তিযুক্ত নয়। আমিষ হোক বা নিরামিষ হোক রোগীর দরকার স্বাভাবিক রুচিসম্মত খাবার।