তরুণীটিকে প্রায় কোলে করে নিয়ে এলো তার বাবা। তরুণীর দুটো পা গত সাতদিন ধরে প্যারালাইসিস। বাড়ি বারাণসী। এখানে থাকে লিলুয়াতে। নির্মাণ শ্রমিক। বয়স উনিশ। ওজন তিরিশ কিলো। একেবারে হাড্ডিসার চেহারা। সঙ্গে জ্বর আর শ্বাসকষ্ট। পিঠে ব্যথা। জন্ডিস। তীব্র রক্তশূন্যতা। দুটো ফুসফুসে জল। এক্সরে আর এমআরআই বলছে মেরুদণ্ডে পিঠের মাঝখানে যক্ষ্মারোগের (TB) আক্রমণ। যক্ষ্মারোগের ওষুধ শুরু করেও তা পালটাতে হয়েছে- জন্ডিসের জন্য। কলকাতার বড় বড় হাসপাতালগুলো হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমিও দেখেশুনে প্রথমে বলে দিয়েছিলাম যে, আমি পারব না। এই রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।
রোগীর বাবা আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপ হি শেষ ভরসা হ্যায় ডাক্তার সাহাব। অপারেশন কর দিজিয়ে। যো কুছ হোগা, দেখা যায়েগা। আপ জিম্মেদার নেহী হোঙ্গে। হামলোগ আপকো কুছ নেহী কহেঙ্গে।’ বাবার চোখে হার না মানা শেষ লড়াই-এর আগুন। মায়ের চোখে অবিরল ধারা।
রোগী ভর্তি হলো। আই সি ইউ-তে। বক্ষ বিশেষজ্ঞ দেখলেন। যক্ষ্মার ওষুধ ঠিক করে আবার শুরু হল। ফুসফুসের সিটি স্ক্যান হল। একটু উন্নতি – চারদিন বাদে রোগীকে সাধারণ ওয়ার্ডে দেওয়া গেল। কিন্তু প্যারালাইসিসের কোন উন্নতি তো নেই-ই, বরং বাড়ছে। সুতরাং সার্জারি।
কিন্তু অ্যানাসথেটিস্ট বেঁকে বসলেন। হিমোগ্লোবিন খুব কম। তাছাড়া জ্বর। রক্ত দেওয়া হলো। দুদিন পরে জ্বর কমলে সার্জারির পরিকল্পনা করা হল। কিন্তু অ্যানাসথেটিস্ট বললেন, ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় নেওয়া যাবে না। নাহলে রোগীকে অজ্ঞান অবস্থা থেকে ফেরত আনা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া, জীবনের ঝুঁকি আছে – সেটা জানিয়ে অপারেশনের রিস্ক বন্ডে সই নিতে হবে।
তার মানে আড়াই ঘণ্টার সার্জারি করতে হবে এক ঘণ্টায় । খুব কঠিন বিষয়। দুজন সার্জেন একসাথে অপারেশন শুরু করলাম। প্রায় লিটার খানেক পুঁজ বেরোল। তার সঙ্গে পচা হাড়ের টুকরো। স্নায়ু ও স্পাইনাল কর্ডকে চাপ মুক্ত করা হলো ভালভাবে। কিন্তু সময় অভাবে এবং হাড়ের হাল অত্যন্ত খারাপ হওয়াতে মেরুদন্ডের ফিক্সেশন মনের মতো হল না। রোগীর জীবন বাঁচাতে কিছুটা আপস করতে হল। যক্ষ্মায় খেয়ে যাওয়া হাড়ের গর্ত ভরাট করতে কোমর থেকে হাড় নিয়ে লাগাতে হয়েছিল।
তার পরের ঘটনা বেশ দ্রুত। প্রচুর রক্ত দিতে হল। সেইসাথে আমাদের বিনিদ্র রজনী কাটানো। তবে উন্নতি হতে শুরু হল এরপর। তিন মাস পরে মেয়েটা হাঁটতে পারল। যক্ষ্মা সেরে গেল ওষুধে। তারপর বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর দেখাতে আসত। পড়াশোনা করতে আবার কলেজে ভর্তি হয়েছিল।
সেই রোগী আবার এসেছিল গত সপ্তাহে। তেরো বছর পরে। এবারে তার ভাইকে দেখাতে। সে নিজে সম্পূর্ণ সুস্থ। বত্রিশ বছর বয়স। এখন একটা বেসরকারি ব্যাংকের সহকারী ম্যানেজার। জীবনের পরবর্তী পর্বে প্রবেশ করতে চলেছে সে। তার জন্য নিমন্ত্রণ করে গেল তার বাবা-মা।